
বলা হয়, এই প্রজন্মের ফুটবল দর্শকরা ইতিহাসের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান দর্শক। কারণ, এরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন সর্বকালের সেরা দুই ফুটবলারের লড়াই।
হ্যাঁ, লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর লড়াই।
এই দুজন গত দেড় দশকে কী কী কীর্তি করেছেন, সে আর বলে বোঝানোর দরকার নেই। একটার পর একটা রেকর্ড একজন গড়েছেন, আরেকজন সেটাকে ভেঙে আরও উঁচুতে নিয়ে গেছেন। ক্যারিয়ারের প্রাথমিক পরিচয়ে দুজনের কেউই স্ট্রাইকার নন। তারপরও গোলবন্যায় একটার পর একটা ইতিহাস তৈরি করেছেন মেসি ও রোনালদো।
গত দশ বছর ধরে ফিফা ও ব্যালন ডি’অরের শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো এই দুজনের মধ্যেই। তারাই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এই সময়ের সবগুলো সেরার পুরষ্কার।
সর্বশেষ কয়েক বছরে এই ব্যাপারটা আরও মজার হয়েছিলো। রোনালদো এসে যোগ দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। আর মেসি আগে থেকেই ছিলেন বার্সেলোনায়। একই স্প্যানিশ লিগে জমে উঠেছিলো দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বছরে নিয়ম করে কয়েক বার পরস্পরের বিপক্ষে লড়তেন তারা। সারা বছর দুই খেলোয়াড়ের সমর্থকদের মধ্যে থাকতো এই নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, এই দেখার অপেক্ষা চলতো।

অবশেষে সেই লড়াই যেন একটা বিরতি পেলো। রোনালদো চলে গেলেন রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে। একটা শূন্যতা তো হাহাকার তৈরি করলোই দর্শকের বুকে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়, ইউরোপিয়ান আসরে এখনও মেসি-রোনালদো লড়াইটা থাকবে। কিন্তু লা লিগায় তো আগের মতো এই লড়াইটা আর থাকলো না। এ নিয়ে দুই পক্ষের সমর্থকদেরই একটু মন খারাপ করার কথা।
রোনালদোর এই চলে যাওয়ায় মেসিও সম্ভবত একটু কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু নিজের কষ্টের কথা নয়, তিনি বরং রিয়াল মাদ্রিদের দিকে তাকিয়ে একটু আহত হচ্ছেন।
সাধারণত মেসি খুব পরিষ্কার করে কোনো সিদ্ধান্তমূলক কথাবার্তা সংবাদ মাধ্যমে বলেন না। কিন্তু রোনালদো চলে যাওয়ায় রিয়াল মাদ্রিদ যে একটু দুর্বল একটা দলে পরিণত হলো, এটা বলতে দ্বিধা করেননি। কাতালুনিয়া রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মেসি বলছিলেন,
“অবশ্যই তারা (মাদ্রিদ) বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি দল। তাদের অসাধারণ একটা স্কোয়াড আছে, অসাধারণ কিছু খেলোয়াড় আছে। কিন্তু হ্যাঁ, ক্রিস্টিয়ানো চলে যাওয়ায় এই স্কোয়াডটা আগের চেয়ে একটু কম শক্তিশালী হয়ে যাবে।”
একদিকে মেসি রিয়াল মাদ্রিদকে যেমন দুর্বল হয়ে যেতে দেখতে পাচ্ছেন, তেমনই দেখছেন জুভেন্টাসের আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা। রোনালদোকে পেয়ে জুভেন্টাস এখন চ্যাম্পিয়নস লিগে অন্যতম ফেবারিট হয়ে উঠবে বলে মেসির ধারণা,
“এটা জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের জন্য পরিষ্কার ফেবারিট করে তুলবে। কারণ তাদের আগের যে দল ছিলো সেই দলের তুলনায় তাকে (রোনালদোকে) সহ দল অনেক বেশি সেরা হবে।”
এ তো গেলো দুই দল নিয়ে রোনালদোর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে পার্থক্যের কথা। কিন্তু রোনালদো যাওয়ায় মেসির নিজের অনুভূতিটা কী?
এটাও লুকাননি আর্জেন্টাইন এই তারকা। পরিষ্কার বলেছেন যে, তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি আশা করেননি যে, মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে কখনো চলে যাবেন রোনালদো,
“আমি তার এই সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছি। আমি কখনো মনে করিনি, ও মাদ্রিদ ছেড়ে যাবে। বা ও যে জুভেন্টাসে যাবে, এটাও ভাবিনি কখনো। বিশ্বে অনেক দলই তো রোনালদোকে নিতে চেয়েছিলো। সে তুলনায় এই দৌড়ে আমি জুভেন্টাসের নাম কম শুনেছি। তবে জুভেন্টাস একটা দারুন দল।”

রোনালদো চলে গেলেন। মেসিও কি চলে যাবেন?
মেসিকে নিয়ে প্রায়শ’ গুঞ্জন শোনা যায় ম্যানচেস্টার সিটি বা পিএসজি তার দিকে হাত বাড়াতে পারে। কিন্তু মেসি পরিষ্কার বললেন, তার এরকম চলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই,
“এখানে (বার্সেলোনায়) আমার সবকিছু আছে। আমি এখানে ১৩ বছর বয়সে এসেছি। এটাই এখন আমার জীবন। এটা বিশ্বের সেরা ক্লাব। এটা বিশ্বের সেরা শহর না হলেও, অন্যতম সেরা বটে। আমার সন্তানরা কাতালুনিয়াতে জন্ম নিয়েছে। ফলে আমার এখান থেকে কোথাও যাওয়ার কোনো কারণ নেই।”
এই সাক্ষাতকারে মেসি শুধু রোনালদো, রিয়াল মাদ্রিদ আর জুভেন্টাস নিয়েই কথা বলেননি। তার নিজের দল বার্সেলোনা নিয়েও বলেছেন। বার্সেলোনা গত কয়েকটি চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিচ্ছে। অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ফেলেছে। ফলে এখন আরেকটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি জেতা মেসির জন্য জরুরি হয়ে গেছে।
এই প্রয়োজনীয়তাটা উপলব্ধি করতে পারা মেসি বলছিলেন,
“এটা এখন জরুরি। কারণ, গত তিন বছরে আমরা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে গেছি। আর গত বছরের ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছে, তা তো জঘন্য ছিলো।”
“আমরা এটা নিয়ে মনোযোগ দিচ্ছি। কারণ, এটা জেতা আমাদের পক্ষে সম্ভব। আমাদের যেরকম একটা স্কোয়াড আছে, তাতে আমরা এই প্রতিযোগিতায় লড়াই করতে পারি।”
“কিছু বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগ আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। গার্দিওলা যুগে ইন্টার ও চেলসির বিপক্ষে খুব সামান্য কিছু কারণে আমরা হেরে গিয়েছিলাম। এখন প্রতি বছর এই প্রতিযোগিতাটা আরও সমতাপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ ক্লাবগুলো এখন এই প্রতিযোগিতাটা জিততে আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করছে এবং আরও খেলোয়াড় কিনছে। দুটো ম্যানচেস্টার ক্লাব, চেলসি, মাদ্রিদ, আমরা, পিএসজি এবং কয়েকটা ইতালিয়ান ক্লাব আছে এই দৌড়ে।”

দৌড়ে যারাই থাক, বার্সেলোনার জন্য এই টুর্নামেন্টে হারাটা যে কতটা হতাশার, সেটা মেসি ব্যাখ্যা করেই বললেন। গত আসরে এখান থেকে ছিটকে পড়ার পর ছেলে থিয়াগোর সাথে অবধি আলাপ করতে পারেননি বলে বললেন মেসি,
“আমার প্রথম ছেলে জন্মানোর পর থেকে এসব ব্যাপার আমি একটু ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করি। তারপরও গত বছর এখানে হারার পর আমি খুব ভুগেছি। আমার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোটা কঠিন ব্যাপার ছিলো।”
“ড্রেসিংরুম সবসময় আরও কিছু চায়। ওই সময় (হারের পর) আমার সাথে কথা বলতে আপনাকে কয়েক দিন অবধি অপেক্ষা করতে হতো। থিয়াগো এখন এসব বোঝে এবং আমাকে জানে। এই পরাজয়ের পর আমি ওর সাথেও কথা বলতে পারিনি।”
বার্সেলোনা এই চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাকে মাথায় রেখেই এবারের দলবদলে দলে ভিড়িয়েছে বেশ কিছু নতুন মুখ। আর এদের নিয়ে বেশ সন্তোষ প্রকাশ করলেন মেসি,
“যারা এসেছে এরা সবাই খুব চমৎকার। বিশেষ করে আর্থার আমাকে খুব বিস্মিত করেছে। আমি ওকে আসলে চিনতাম না সেভাবে।”
“সে জাভির মতো খেলে। সে বল রাখতে, ছোট পাস দিতে এবং বল না হারাতে পছন্দ করে; খুব দৃঢ় ছেলে। সে আমাকে অবাক করেছে। তবে আমি এদের সবাইকে পছন্দ করেছি। আর্থারের ওই স্টাইল আছে। সে ট্রেনিংয়ে খুব দ্রুত বুঝে ফেলতে পারে।”
“বার্সেলোনা সমর্থকরা সেই সব খেলোয়াড়কেই পছন্দ করে, যারা বল পায়ে রাখতে ও বল পজেশন ধরে রাখতে পারে। আমি মনে করি আমাদের জন্য আর্তুরুর (ভিদাল) মতো খেলোয়াড়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ফুটবল একাধারে ট্যাকটিকস ও শারীরিক খেলা।”

শেষ অবধি এই সাক্ষাতকারে সেই অবসরের প্রসঙ্গটাও উঠলো। মেসি এখনই সেই অবসরটা দেখতে পাচ্ছেন না। এটা মানলেন যে, চল্লিশ বছর বয়সে তিনি খেলবেন না। কিন্তু এখনই সেই না খেলার সময়টা নিয়ে ভাবতেও রাজি নন,
“আমি নিজেকে ৪০ বছর বয়সে খেলতে দেখতে পাই না। তবে যখন খেলা বন্ধ করবো, তখন কী করবো, এখনও জানি না।”
“আমি এখন যেখানে আছি, যা করছি, এ নিয়েই ভাবতে চাই। খেলাটা চালিয়ে যেতে চাই। আর কিছু নয়। যখন সেই সময় আসবে, আমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করার জন্য খুঁজে পাবো। এখন আমি স্রেফ আমার চুক্তি শেষ হওয়া অবধি কী হতে পারে, সে নিয়ে ভাবতে পারি। তারপর আমি ক্লাবের সাথে কথা বলবো যে, আমি কী করতে পারি।”
“আমার পরিকল্পনা হলো বার্সেলোনাতে থেকে যাওয়া। আমার বাচ্চাদের এখানে বন্ধু আছে, স্কুল আছে। আর এগুলো আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”