একটা সময়ের জন্য ভারতের সবচাইতে পছন্দের ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। টাইগার পতৌদি, আব্বাস আলী বেগদের মতো পড়াশোনাও করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে, কিন্তু অভ্যস্ত ছিলেন না তাদের মতো বিলাসবহুল জীবনযাপনে। তার মাঝে একটা সরলচিত্ত ব্যাপার ছিল। একটা লাজুকতা ছিল, একজন আন্তর্জাতিক সুপারস্টারের ক্ষেত্রে যা বড্ড বেমানান।
অস্ট্রেলিয়াতে যখন তাকে স্লেজিং করা হয়েছিল, কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি তখন। ধর্মভীরুতা, ভদ্রতা, নম্রতা, মিষ্টভাষিতা- একজন ভারতীয় ক্রিকেটারকে যে সকল মানবীয় গুণের কারণে ভালোবাসা যায়, সবই ছিল তার। ব্যাটটাকেও যেন বানিয়ে ফেলেছিলেন জাদুদণ্ড। আলতো ছোঁয়ায় ফ্লিক করে বলকে বাউন্ডারিতে পাঠানোর মাঝেও ছিল অদ্ভুত এক সৌম্যশান্ত ভাব। দ্রুতই হয়ে উঠেছিলেন ভারতের প্রত্যেকটি পরিবারের ‘ঘরের ছেলে’। তিনি মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, সকলের ভালোবাসার ‘আজ্জু’।
তার কব্জির মোচড়ে খেলা শটগুলো গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, জহির আব্বাস এমনকি রণজিৎসিংজিকেও মনে করিয়ে দিত। এমন ক্রিকেটারকে ভালো না বেসে উপায় ছিল?
এই ভালোবাসার প্রতিদানও কিন্তু দিচ্ছিলেন আজহার। টানা তিন শতক দিয়ে উড়ন্ত সূচনা করেছিলেন ক্যারিয়ারের। এরপর অকল্যান্ড, লর্ডস, অ্যাডিলেড, কেপ টাউন, কলম্বো, ওয়েলিংটন – কোথায় ব্যাট হাতে ছড়ি ঘোরাননি তিনি! অকল্যান্ডে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯২ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসের পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার প্রিয় শট সম্পর্কে। উত্তরে আজহার বলেছিলেন,
“The shot that goes exactly where I want to go.”
ততদিনে ভারতের অধিনায়কত্বও পেয়ে গেছেন আজহার।
তারপরে আসে তার ফিল্ডিং। কভার,পয়েন্ট, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট থেকে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে বল ধরে সুনিপুণ দক্ষতায় উইকেট বরাবর ছোড়া, কিংবা স্লিপে অবিশ্বাস্য ক্যাচ তালুবন্দী করা – আজহারউদ্দীনকে তাই এখনো মানা হয় ভারতের অন্যতম সেরা অলরাউন্ড ফিল্ডার হিসেবে। ফিল্ডিংকে ভালোবাসতেন আজহার।
সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নবাণ সামলাতে হিমশিম খেতে হতো প্রায়ই। তথাপি তার চরিত্রের মাঝে ছিল অদ্ভুত মার্জিত ভাব। বোর্ডকর্তা থেকে সাধারণ মানুষ – সবার স্নেহভাজন ছিলেন আজহার।
আজহারের অধিনায়কত্ব পাওয়ার কথা বলেছিলাম শুরুতে৷ সে সময় অধিনায়কত্ব যারা পেতে পারতেন, তাদের সম্ভাব্য তালিকায় আজহার ছিলেন না। ছিলেন রবি শাস্ত্রী-কপিল দেব। কিন্তু তাদের কাউকে অধিনায়কত্ব দিলে বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়ে বোর্ডের নাম ডোবাবেন, এই ভয় ছিল। তাই ‘সেইফ অপশন’-এর দিকে গেল বোর্ড। অধিনায়ক হলেন আজহার। তার গুণাবলি বর্ণনা করেছি আগেই। সুতরাং বোর্ড ছিল নিশ্চিন্ত।
এদিকে ব্যাটসম্যান আজহারউদ্দীন উড়ছিলেন রীতিমতো। তার পরিসংখ্যানও এর পক্ষে কথা বলে। টেস্টে ৪৫ গড় আর ওয়ানডেতে ৩৭ গড় তার ধারাবাহিকতার পরিচায়ক ছিল৷ টেস্টে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন ৪৩ বার, তার মধ্যে ২২ বারই করেছেন সেঞ্চুরি। একমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ে সবার বিপক্ষে ছিল চল্লিশোর্ধ্ব গড়৷ কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারের ব্যাটন তার সাথেই হাতবদল হয়েছিল, শচীন টেন্ডুলকার যে তখনো নতুন।
কিন্তু আকস্মিকভাবে কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছিল আজহারের মাঝে, কথা বলার ভঙ্গি থেকে হাতে পরা রিস্টওয়াচে। যে আজহার সংবাদ সম্মেলন সামলাতে হিমশিম খেতেন, সেই তিনি এখন উল্টো সাংবাদিকদের আক্রমণ করছেন। সাদাসিধে আজহার হঠাৎ বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করলেন। অর্থবিত্ত তো কম নেই, তা করতেই পারেন। তবে আজহার বলেই হয়তো চোখে লাগছিল।
‘৯৬ বিশ্বকাপ-পূর্ব ক্যাম্প হওয়ার কথা ছিল চেন্নাইতে। কিন্তু আজহার চাইছিলেন, সেটা ব্যাঙ্গালোরে হোক। কিন্তু ব্যাঙ্গালোর তখনো প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আজহার নাছোড়বান্দা, সাথে পেলেন বোর্ডের সমর্থন। ততদিনে আমূল পাল্টে গেছেন আজহার। ভুলভাল কারণে শিরোনাম হওয়া শুরু করেছেন। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল বিবাহিত আজহার ও অভিনেত্রী সঙ্গীতা বিজলানির প্রেমের গুঞ্জন। পরে জানা গিয়েছিল, সঙ্গীতার সাথে দেখা করতে সুবিধা হবে এই ভেবেই আজহার ক্যাম্প সরিয়ে নিয়েছিলেন ব্যাঙ্গালোরে।
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের দু’দিন আগে ঘটল নজিরবিহীন ঘটনা। ইডেনে অনুশীলন করলো না ভারত দল। পরে জানা গেল, সঙ্গীতাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়েছিলেন আজহার, যার জন্যে ঘটে এই ঘটনা। এবার বিস্ময়ের পালা। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যকে ডেকে দলের ম্যানেজার অজিত ওয়াড়েকর বললেন,
“আজ্জুকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না।”
সেমিফাইনালে টস জিতে বিতর্কিতভাবে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন আজহার। শোচনীয় ব্যাটিং পারফরম্যান্সের কারণে যখন দল হারার মুখে, তখন দর্শকেরা শুরু করল তাণ্ডব। বিনোদ কাম্বলির কান্নাজড়িত অবস্থায় মাঠ ছাড়ার দৃশ্যটা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। নিজের মাটিতে বিশ্বকাপ স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল ভারতের।
কিন্তু ‘আজ্জুকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না’ এর মানে কী? বোর্ডকর্তাদের ‘সেইফ অপশন’ আজহার তবে কি কিছু করছিলেন, যা দল বা বোর্ডের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে?
আস্তে আস্তে জট খোলা শুরু করল। ভারত এমন ম্যাচ হারল, যা তাদের জেতা উচিত ছিল। হঠাৎ যেন মনে হলো, গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা পরিণত হয়েছে ‘অগৌরবময় নিশ্চয়তার খেলা’-তে।
হ্যানসি ক্রনিয়ে ম্যাচ গড়াপেটার দায় স্বীকার করলেন। এও জানালেন, তাকে জুয়াড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া মানুষটি আর কেউ নন, ভারতের সবার প্রিয় ‘আজ্জু’।
ক্রনিয়েকে নিয়ে স্থানীয় এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল,
“তাকে আমরা ভালোবেসেছিলাম। তার জন্যে গলা ফাটিয়েছিলাম। আমরা যখন তার ব্যর্থতার জন্য ভুগছিলাম, তখন সে টাকা গুনছিল৷ আমাদের নায়ক কেবলই আরেকজন লোভী মানুষ ছাড়া আর কিছু নন।”
হাজারো কিলোমিটার দূরে আরো একজনকে নিয়ে ভারতবাসীর অনুভূতি যে কিছুমাত্র ভিন্ন ছিল না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজহার তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ গড়াপেটা করেছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯৯৬ সালে রাজকোটে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৯৭ সালে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে। তবে পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে নিজের বক্তব্য অস্বীকার করলেও বোর্ডের সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়েনি৷ আজহার আজীবন নিষিদ্ধ হন ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে।
টালমাটাল ভারতীয় ক্রিকেটকে ভঙ্গুর অবস্থা দেখে উদ্ধার করার জন্য ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে ভারতের সোনালি প্রজন্ম, যাদের অবদানে একটা প্রজন্ম সেই অন্ধকার অনিশ্চিত দিনগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল।
২০১২ সালে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আজহারের উপর থেকে আজীবন নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়। ততদিনে যা অর্জন করেছেন, তার থেকে অনেক বেশিই বোধহয় খুইয়েছিলেন তিনি। যাকে ভালোবেসে খেলা দেখতে বসতো ভারতীয়রা, সেই আজহারকে ততদিনে ঘৃণা করতে শুরু করা মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক।
মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাঘব বোয়ালদের সাথে আঁতাত ছিল আজহারের। এমনকি ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে যে জঙ্গি হামলা হয়েছিল, তার হোতাদের সাথেও আজহারের ছবি পাওয়া গিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল যে, শারজাহতে অনুষ্ঠিত ম্যাচসমূহের অনেকগুলোতেই স্পট ফিক্সিং ও ম্যাচ ফিক্সিংয়ে শামিল ছিল মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই মাফিয়ারা।
তবে কি সেই ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে টস জিতে ফিল্ডিং নেয়াও এসবের অংশ ছিল? তবে কি ‘আজ্জুকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না’ এর মানে এতটা গভীর?
আজহার মুক্তি পেয়েছেন সত্য, তার মানে কি এই যে, তিনি শতভাগ নির্দোষ? তিনি ম্যাচ গড়াপেটায় কীভাবে জড়িত ছিলেন বা আদৌ জড়িত ছিলেন কি না, তা কেবল আজহারই জানেন।
রণজিৎসিংজিকে না দেখার আক্ষেপ যে তরুণটা ঘুচিয়েছিল আজহারকে দেখে, তার বিশ্বাস ভেঙে দেয়া সেই আজহারকে সে আদৌ ক্ষমা করতে পেরেছে? হয়তো পেরেছে, হয়তো পারেনি।
ভালোবাসা, বিস্ময়, ঘৃণা- এই তিনের দোলাচলে ভেসেছে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের জীবন। টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ৯৯টি, টেস্টে সর্বোচ্চ রান ১৯৯। সংখ্যা দুটোর মাঝেই লুকিয়ে আছে তার জীবনের অপূর্ণতা, আক্ষেপ। সম্ভবত এজন্যই একবার আজহার বলেছিলেন,
“Sometimes life takes you to places where you don’t want to go.”