‘আই ডোন্ট নো হাউ মাচ ইউ পে টু দিস সিনিয়র গাইস। এনিওয়ে কনগ্রাচুলেশনস, ওয়েলকাম টু দ্য টিম।’
বক্তার নাম চান্দিকা হাতুরুসিংহে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর। হাতুরুসিংহে বাদ দিলেও সিনিয়র ক্রিকেটারদের পরামর্শে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট দলে মুমিনুল হক অন্তর্ভুক্ত করেন বিসিবি সভাপতি। তারপর দলের সঙ্গে প্রথম দিনের অনুশীলনে নেটে ব্যাটিং করতে যাওয়ার আগে মুমিনুলকে কথাগুলো বলেছিলেন সেই সময়ের কোচ হাতুরুসিংহে।
জাতীয় দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটারের জবানবন্দিতে শুনেছিলাম এ কথাগুলো। ওই সিনিয়র ক্রিকেটার বলেছিলেন, কতটা ক্রোধ জমা থাকলে মানুষ এমনটা বলতে পারে। যদিও মুমিনুল নাকি কথাগুলো ঠিকমতো শুনতে পাননি, হয়তো বুঝতেও পারেননি। কারণ একটু দূর থেকে কথাগুলো বলেছিলেন এই লঙ্কান কোচ।
আবির্ভাবেই ব্যাট হাতে প্রতিভার স্বরুপ তুলে ধরেছিলেন মুমিনুল। তার মাঝে পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যানের ছায়া খুঁজেছিল বাংলাদেশ। হাথুরুসিংহে আসার পরই সীমিত ওভারের দুই ফরম্যাট (ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি) থেকে ছেঁটে ফেলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে। তার অধীনে টেস্টেও বিবর্ণ হতে শুরু করে মুমিনলের ব্যাট। আত্মবিশ্বাস নেমে যায় তলানীতে। এই সুযোগেই কোপটা মারতে চেষ্টা করেছিলেন হাথুরুসিংহে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের কারণে ওই মিশনে পুরো সফলতা পাননি লঙ্কান কোচ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে হাতুরুসিংহে যুগের অবসান হতেই আবার যেন খোলস মোচন হলো মুমিনুলের। ব্যাটে বইতে শুরু করলো রানের ফল্গুধারা। ২০১৮ সালে ব্যাটিংয়ে ফিরলেন সেই আগের মুমিনুল। বছরজুড়ে ধারাবাহিকভাবে রান করে গেলেন। বলা বাহুল্য, তার ব্যাটেই গেল বছরে বিশ্বসেরা হয়েছে বাংলাদেশ, তিনি গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০১৮ সালে গোটা ক্রিকেট দুনিয়ার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হাতুরুসিংহের কাছে ব্রাত্য হয়ে থাকা মুমিনুল। শুধু রানই নয়, গত বছর এই ফরম্যাটে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিকও তিনি। নয় সেঞ্চুরিতে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন তিনি।
মুমিনুল বছরটা শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) ষষ্ঠ আসরে দু’টি সেঞ্চুরি দিয়ে, যার মধ্যে ছিল একটি ডাবল সেঞ্চুরি (২৫৮)। তারপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি দিয়ে স্বাগতম জানিয়েছিলেন হাথুরুসিংহেকে। পরে জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে করেছেন একটি করে সেঞ্চুরি। এছাড়া জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল) একটি এবং বিসিএলের সপ্তম আসরে আরও দু’টি সেঞ্চুরি করেছেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
২০ ম্যাচের ৩৬ ইনিংসে নয় সেঞ্চুরিতে মুমিনুলের করা ১৭৯১ রান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০১৮ সালে ক্রিকেট বিশ্বে সর্বোচ্চ। গৌরবের বিষয়, তার পরের স্থানটিও এক বাংলাদেশির। ১৯ ম্যাচে সাত সেঞ্চুরিতে ১৫৭৩ রান করে দ্বিতীয় স্থানে তুষার ইমরান।
রানের দিক থেকে দুই বাংলাদেশির পর সেরা পাঁচের বাকি সদস্যরা হচ্ছেন ইংল্যান্ডের রোরি বার্নস (১,৫৫৭ রান), দক্ষিণ আফ্রিকার ডেন ভিলাস (১,৫২৫ রান) এবং কলিন অ্যাকারম্যান (১,৪৮১ রান)। সেঞ্চুরির তালিকায় মুমিনুল-তুষারের পর ছয়টি করে সেঞ্চুরি আছে দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাকবস পিয়েনার, ইংল্যান্ডের ইয়ান বেল, অস্ট্রেলিয়ার উসমান খাজা এবং ম্যাট রেনশ’র।
মুমিনুলের চোখে সেরা ২৫৮
রান উৎসবে পূর্ণ ২০১৮ সালের মূল্যায়নে ২৭ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান বলেছেন,
‘আলহামদুলিল্লাহ এমন গেলে তো ভালোই যায়। অবশ্যই ভালো, নিজের কাছে ভালোই লাগে। এমন বছর তো ভালো লাগারই কথা। সবসময় চাই যে এমন কিছু করতে। চাইবো আরও ভালো হোক সামনে। শুধু এরকম নয়, আরও ভালো করতে চাই সামনে, এমনই চিন্তাভাবনা। চেষ্টা করবো আগামী বছরও যেন এমন ভালো হয়। কোনো কোনো জায়গায় তারপরও হয়তো একটু ঘাটতি ছিল। সেগুলো যদি ভালো করতাম, তাহলে দলের জন্য ভালো হতো, আমার জন্যও ভালো হতো।’
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৭৬, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৬১ রানের ইনিংস আছে। বিসিএলের সপ্তম আসরে ১৯৪ রানের ইনিংস আছে। তবে মুমিনুল এগিয়ে রাখছেন বছরের শুরুতে বিসিএলের ষষ্ঠ আসরে খেলা ২৫৮ রানের ইনিংসকে, যা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস।
বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান বলেছেন,
‘আমার কাছে মনে হয় বিসিএলে ২৫৮ যেটা করছিলাম, ওইটা বেশি আমাকে খুব সাহায্য করেছে… আসলে ওই সময়ে তো রানে ছিলাম না। ওই ইনিংস থেকে অনেক কিছু শিখছি আমি। প্রত্যেকটা ব্যাটসম্যানেরই রানে ফেরার জন্য একটা নির্দিষ্ট ইনিংস লাগে। ওই ইনিংসটা আমার খুব বেশি কাজে দিছে। ওই ইনিংস থেকে আমি রানে ফেরা শুরু করছি। কীভাবে খেলবো না খেলবো, অনেক কিছু শেখা গেছে। ওইটা অবশ্যই এগিয়ে থাকবে। কিন্তু আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে চারটা সেঞ্চুরি হয়েছে। চারটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তার মধ্যে দুইটা ইনিংস ম্যাচ জেতানোর মতো, দুইটা ছিল ড্র করার মতো।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৯৩ ম্যাচে ৬ হাজার ৫৮১ রান, ১৯ সেঞ্চুরির সঙ্গে রয়েছে ৩০টি হাফ সেঞ্চুরি। তারপরও টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ থেকেই যাচ্ছে মুমিনুলের। তবে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে অত ভাবতে চান না এই তরুণ। বলেছেন,
‘এটা নিয়ে অত চিন্তা করি না। খেলতে থাকলে হয়তো একসময় হয়ে যাবে। কিন্তু চিন্তা করে লাভ নেই। ওই সময়টা (ডাবলের কাছাকাছি গিয়ে) আরও ধৈর্য্য ধরে খেলতে হবে। হয়তো ফিটনেসের কোনো সমস্যা আছে, হয়তো মাইন্ডসেটের কোনো সমস্যা আছে। ওই জায়গায় গেলে মাইন্ডসেট হয়তো পরিবর্তন করতে হবে।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অত অর্জন থাকলেও ২০১৮ সালে কিছুটা অতৃপ্তিও সঙ্গী হয়েছে কক্সবাজারের ছেলে মুমিনুলের। সাড়ে তিন বছর পর ওয়ানডে দলে ফিরেছিলেন এই বাঁহাতি টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান। সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপে সুযোগ পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেননি। ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দু’টি, রান করেছেন ১৪।
ভাগ্যে বিশ্বাসী মুমিনুল বলেছেন, আক্ষেপ নেই। তবে তার বিশ্বাস ভাগ্যে থাকলে একদিন ঠিকই ওয়ানডেতে ফিরবেন। সঙ্গে নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন একদিবসী ক্রিকেটে জাতীয় দলে ফিরতে।
বাংলাদেশের হয়ে ২৮ ওয়ানডে খেলা এই ব্যাটসম্যান বলেছেন,
‘না না, আমার আক্ষেপ নাই। এগুলো আমার মাঝে কম কাজ করে। আমি সবসময় যে জিনিসটা বিশ্বাস করি ভাই, আমার ভাগ্যে যদি ওয়ানডে থাকে তাহলে ওয়ানডে আমি অবশ্যই খেলবো। কিন্তু আমাকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে আরকি। আমার দিক থেকে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। হয়তো আজকে না হোক, এক বছর পরে হোক, দুই-তিন বছর পরে হোক, কপালে থাকলে আমার ব্যাট যদি ঠিকমতো কাজ করে, আমি ঠিকই ফিরবো (ওয়ানডেতে)। এভাবেই আমি চিন্তা করি।’
সেরার কাতারে রাজ্জাক
শুধু ব্যাটসম্যান মুমিনুল নন, ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকও ঠাঁই পেয়েছেন সেরাদের কাতারে। গেল বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনটি প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট হয়েছে, যার দু’টিতেই সেরা উইকেটশিকারী ছিলেন রাজ্জাক। বছরের শুরুতে বিসিএলের ষষ্ঠ আসরে ৪৩ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। একই টুর্নামেন্টের সপ্তম আসরে ৩৪ উইকেট শিকার করেছেন অভিজ্ঞ এই স্পিনার। তবে জাতীয় ক্রিকেট লিগের (এনসিএল) ২০তম আসরটা খুব ভালো যায়নি, পেয়েছিলেন মাত্র ৯ উইকেট। এর বাইরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রাজ্জাকের শিকার সর্বমোট ৯১ উইকেট।
তাতেই এই ফরম্যাটে ক্রিকেট বিশ্বে বছরের চতুর্থ সেরা বোলার রাজ্জাক। সর্বোচ্চ ১০৬ উইকেট ইংল্যান্ডের সিমন হারমারের। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আব্বাস ১০৪, দক্ষিণ আফ্রিকার ডুয়ানে অলিভিয়ের ১০১ উইকেট নিয়েছেন। ৯১টি করে উইকেট নিয়ে রাজ্জাকের পাশে আছেন নিউজিল্যান্ডের জিতান প্যাটেল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মরনে মরকেল। তবে আরেকটা তালিকায় অবশ্য রাজ্জাক দ্বিতীয় সেরার অবস্থানে থেকে ২০১৮ সালটা শেষ করেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ইনিংসে সর্বোচ্চ ১০ বার পাঁচ উইকেট নিয়ে শীর্ষে পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আব্বাস। ৯ বার পাঁচ উইকেট নিয়ে আব্বাসের পরই বাংলাদেশের এই ৩৬ বছর বয়সী স্পিনার।
ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি মিলে ২০১৮ সালে তিনটি বহুজাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল হেরেছিলো বাংলাদেশ। তারপরও গেল বছরটা খারাপ কাটেনি টাইগারদের। এসবের মাঝে মুমিনুল-রাজ্জাকদের ব্যক্তিগত অর্জন ২০১৮ সালটাকে আরও আলোকিত করেছিল। ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বিশ্বসেরা হওয়ার মিছিলটা চলতি বছরেও অব্যাহত থাকুক।