আশির দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশকের মাঝামাঝি অবধি ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে নাগিন ড্যান্স খুব সাড়া ফেলেছিলো। একটার পর একটা সাপ কেন্দ্রিক সিনেমা তৈরী হচ্ছিলো তখন। আর এসব সিনেমার অবধারিত এক অংশ ছিলো নাগিন ড্যান্স।
সেই নাগিন ড্যান্স এবার রূপালী পর্দা ছেড়ে ক্রিকেট মাঠে ফিরে এলো।
বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কার দর্শকরা নাগিন ড্যান্স নাচছেন। নাগিন ড্যান্স নাচছেন বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা। এমনকি সুনীল গাভাস্কারের মতো কিংবদন্তী ক্রিকেটারও কমেন্ট্রিবক্সে নাগিন ড্যান্স করে নিলেন। আর এই সবকিছুর মূলে আছেন বাংলাদেশী এক নাগিন।
হ্যাঁ, নাজমুল ইসলাম অপু।
অপুর নাগিন ড্যান্সের তালে এখন ক্রিকেট দুনিয়া মাতোয়ারা। এই নাগিন ড্যান্স এখন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের উদযাপনে এবং প্রতিপক্ষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে জবাব দেওয়ার অস্ত্রে। কিন্তু কোত্থেকে এলো এই নাগিন ড্যান্স?
রাজশাহী কিংস থেকে।
হ্যাঁ, নাগিন ড্যান্সের উৎপত্তি খুঁজতে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে ২০১৬ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। সেবারের বিপিএলে অপু ছিলেন রাজশাহী কিংসের সদস্য। ড্যারেন স্যামির দল টানা চার ম্যাচ হেরে যখন বিপর্যস্ত, তখনই তৈরী হয়েছিলো নাগিন ড্যান্স।
কিভাবে তৈরী হয়েছিলো, সেই গল্পটা বললেন ‘নাগিন অপু’ নিজেই,
“আমরা তখন চার ম্যাচে চারটেই হেরে খুব খারাপ অবস্থা। খেলোয়াড়রা সবাই মন মরা হয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো, আমরা আর জিততে পারবো না। সেরকম সময় আমাদের সবাইকে চাঙ্গা করার জন্য স্যামি একটা অনুষ্ঠান মতো করলো।
আমরা সবাই গোল হয়ে বসলাম। নিয়ম হলো, সিরিয়ালি সবাইকে কিছু না কিছু করে দেখাতে হবে। আমি বসেছিলাম স্যামির পাশে। আমার পালা এলে আমি কিছু না ভেবে কাগজে একটা সাপ আঁকলাম। এরপর ছিলো কেসরিক উইলিয়ামস। সে-ও কয়েকটা সাপ আঁকলো। তো আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সাপ কেনো আঁকলে?’
আমি বললাম, ‘স্পিনাররা তো সাপের মতো। তাদের উইকেটে ছোবল মারতে হয়।’
সবাই খুব মজা পেলো। সেদিন আমরা ঠিক করলাম, পরের ম্যাচে উইকেট পেলে আমি হাত কপালে তুলে সাপের মতো ভঙ্গি করবো। তা-ই হলো। পরের ম্যাচে উইকেট পেলে সাপের মতো ভঙ্গি করলাম। সেটা ঠিক নাগিন ড্যান্স ছিলো না।”
তাহলে! তাহলে পুরোপুরি নাগিন ড্যান্স শুরু হলো কোত্থেকে?
সেটা শুরু হলো গত বিপিএল থেকে। গত বিপিএলে অপু ছিলেন রংপুর রাইডার্সে। দলের কেউ কেউ মনে রেখেছিলেন আগেরবারের সাপের মতো ওই ভঙ্গি। ফলে কে যেনো অপুকে বললেন, এবার ওই ভঙ্গিটা না করে একেবারে নাচ শুরু করে দিতে। ব্যাস, অপু তা-ই করলেন। শুরু হয়ে গেলো নাগিন ড্যান্স।
এখানে মাশরাফির কন্যা হুমায়রার একটা ভূমিকা আছে। অপু বলছিলেন, “আমি প্রথম যেদিন নাগিন ড্যান্স করলাম, তারপর হোটেলে মাশরাফি ভাইয়ের মেয়ের সাথে দেখা হলো। ও খেলাটা দেখেছিলো। ও আমাকে বললো, আঙ্কেল তোমার নাচটা ভালো লেগেছে। উইকেট পেলে এটা করো। তারপর ভাবলাম, এখন থেকে এটা নিয়মিত করবো।”
সেই থেকে বিখ্যাত হয়ে উঠলো নাগিন ড্যান্স এবং নাগিন অপু।
নাগিন অপু নামে খ্যাত হয়ে যাওয়া নাজমুল হোসেন অপুর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। খেলোয়াড় জন্মানোর উর্বর এই ভূমিতে জন্ম নেওয়া অপু ছোটবেলায় ছিলেন খুব পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া এক বালক। ক্রিকেট তাকে এতটাই টানতো যে, প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এই ক্রিকেটের জন্য পিটুনি সহ্য করতে হতো।
পড়া, স্কুল; সব রেখে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন খেলার টানে।
বাবা বিদেশে থাকতেন। তাই একলা মায়ের জন্য খুব কঠিন ছিলো এই অশান্ত ছেলেকে সামলানো। এই সময়ে অপুর মা খবর পেলেন বিকেএসপি বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে সাভারে, যারা কিনা খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনা করায়। তাই ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া অপুকে নিয়ে ভর্তি করে দেওয়া হলো বিকেএসপির ক্লাস সেভেনে।
অন্য কারো ক্ষেত্রে হলে গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। বলা যেতো, এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু অপুর ক্ষেত্রে গল্পটা একটু আলাদা। অপুর গল্প এখানে শেষ হলো না। তাকে আরও সংগ্রাম করতে হলো।
বিকেএসপিতে সতীর্থদের চেয়ে তিনি যেহেতু ছোট ছিলেন, তাই বিকেএসপির ক্রিকেট দলে তার জায়গা হতো না। ওখান থেকে কোনো দলও পাননি কখনো। ফলে বিকেএসপি থেকে যখন পাশ করে বেরোলেন, তখন অপু ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
অপু বলছিলে সেই সময়ের কথা, “আমি কোনো দল পাচ্ছিলাম না। ক্রিকেটে কোনো ভবিষ্যতও দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম বিদেশে চলে যাই। বাবা থাকেন বিদেশে। উনিও বললেন, এখানে চলে আয়।”
বিদেশ যাওয়ার আগে ছুটি কাটাতে অপু গেলেন নারায়ণগঞ্জে। সেই সময় একদিন এক চায়ের দোকানে দেখা হয়ে গেলো গোলাম রসুল নামের এক স্থানীয় কোচের সাথে। গোলাম রসুল বললেন, “তুই তো ভালো স্পিন করিস। কাল আমার ক্লাবে একটা ম্যাচ খেলে দে।”
অপু রাজী হলেন এবং সেই ম্যাচ খেলতে নেমে ৬টা উইকেট নিলেন।
এরপর গোলাম রসুল গিয়ে অপুর মাকে বললেন, “ওর বিদেশ যাওয়া কয়েক দিনের জন্য পিছিয়ে দেন। ওকে আমি ঢাকায় লিগ খেলাবো।”
অনেক কষ্টে অপুর মা রাজী হলেন। ইস্টার্ন ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ খেললেন একটা মৌসুমে এক ম্যাচ। সেই ম্যাচে ৫ উইকেট পেলেন। পরের বছর খেললেন রূপালী ব্যাংকে প্রথম বিভাগ। ৬ ম্যাচে নিলেন ১৮ উইকেট। তার পরের বছর চলে এলেন প্রিমিয়ার লিগে ওরিয়েন্ট ক্লাবে। আর এই ওরিয়েন্ট ক্লাবের হয়েই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সারোয়ার ইমরানের।
ওরিয়েন্টের সাথে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ছিলো আবাহনীর। সেই ম্যাচে ৪ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিলেন। দল হারলেও তার ওপর চোখ পড়লো বাংলাদেশের ক্রিকেট গুরু ও আবাহনীর কোচ সারোয়ার ইমরানের। পরের বছর তাই আবাহনীতে চলে এলেন অপু।
আর এবার আমরা বলতে পারি, এখান থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি অপুকে।
বিপিএল খেলছেন সেই প্রথম মৌসুম থেকেই। নিজেকে টি-টোয়েন্টির দারুণ প্রয়োজনীয় বোলার হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তবে এবার বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে নিজেকে জাতীয় দলের যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করে ফেলেছেন। সেজন্য মাশরাফিকে অনেক কৃতিত্ব দেন অপু, “আমি এর আগে বড় ক্যাপ্টেনের আন্ডারে সেভাবে খেলি নাই। মাশরাফি ভাই একদিন আমার বোলিং দেখেই বললো, তুই তো অনেক ভালো বোলার। তারপর উনি কিছু টিপস দিলো। সেগুলো খুব কাজে লেগেছে। পুরো সিজন উনি আমাকে অনেক গাইড করেছেন। উনিই বলেছেন, তুই জাতীয় দলে সুযোগ পাবি। সেখানে এই নাগিন ড্যান্স করিস।”
মাশরাফির কথা সত্যি হয়েছে। এখন অপু জাতীয় দলেই নাগিন ড্যান্স করছেন। তার ড্যান্স আরও অনেকে করেছেন। এখন অপুর লক্ষ্য নিজেকে জাতীয় দলে স্থায়ী করা এবং সাকিবের দেখানো পথ ধরে হাঁটা, “শ্রীলঙ্কায় আমার বোলিং নিয়ে শিখর ধাওয়ান আলাদা করে ডেকে অনেক কথা বলেছে। বলেছে, তুমি অনেকদূর যেতে পারবে। আমি সাকিবকে দেখে এগোই। ও বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হয়েছে। আমি কেন সেরা বোলার হতে পারবো না? আমার লক্ষ্য এখন এটাই।”
ফিচার ইমেজ © AP Photo/Eranga Jayawardena