বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ওয়ানডে সিরিজ শেষ হওয়ার মধ্যে ২০১৮ সালের ওয়ানডে ক্রিকেটের পর্দা নামে। চলতি বছরে আর কোনো আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ মাঠে গড়াবে না। ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ২৬টি ম্যাচ খেলেছে জিম্বাবুয়ে। এছাড়া ইংল্যান্ড ২৪টি, ভারত, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান ২০টি করে ম্যাচ খেলেছে। ম্যাচ জয়ের দিক দিয়ে ইংল্যান্ড সবার উপরে অবস্থান করছে। ২০১৮ সালে ইংলিশরা ১৭টি ওয়ানডে ম্যাচ জিতেছে। ভারত ১৪ ম্যাচে জয়লাভ করে দ্বিতীয় স্থানে এবং বাংলাদেশ ১৩ ম্যাচ জিতে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে।
ইংল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের সাফল্যের পেছনে তাদের দলের বেশ কিছু ক্রিকেটারের অবদান রয়েছে। তারা ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত সময় কাটিয়ে দলকে জয় এনে দিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাটে-বলে উজ্জ্বল নৈপুণ্য দেখানো ক্রিকেটারদের নিয়ে সাজানো হলো রোর বাংলার দৃষ্টিতে বর্ষসেরা ওয়ানডে দল।
১. রোহিত শর্মা
২০১৮ সালের ওপেনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করেছেন ভারতের ওয়ানডে দলের ওপেনার রোহিত শর্মা। এই ডানহাতি ওপেনার ২০১৮ সালে ১৯ ম্যাচে ৭৩.৫৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ১০০.০৯ স্ট্রাইক রেটে ১,০৩০ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন পাঁচটি ও অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন তিনটি।
তিনি এ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ১১৫ রানের ইনিংস খেলেছেন। ইংল্যান্ডেও তিনি শতক হাঁকিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি মাত্র ১১৪ বলে অপরাজিত ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেছেন। এছাড়া চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে দুবাইতে এশিয়া কাপের ম্যাচে অপরাজিত ১১১ রানের ইনিংসও খেলেছেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অন্যতম এই ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে তিনি অপরাজিত ১৫২ রান এবং ১৬২ রানের ইনিংস খেলে বছর শেষ করেছেন।
২. জনি বেয়ারস্টো
২০১৮ সালে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সহস্রাধিক রান পূর্ণ করেছিলেন ইংল্যান্ডের জনি বেয়ারস্টো। এই বিধ্বংসী ওপেনার এ বছর ২২ ম্যাচে ৪৬.৫৯ ব্যাটিং গড়ে এবং ১১৮.২২ স্ট্রাইক রেটে ১,০২৫ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন চারটি ও অর্ধশতক দুটি। ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের দিক থেকে তিনি তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছেন। ওপেনারদের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়।
বেয়ারস্টো এ বছরে চারটি শতকের মধ্যে তিনটি টানা তিন ইনিংসে হাঁকিয়েছেন। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ দুই ম্যাচে তিনি ১৩৮ এবং ১০৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপরের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছেন ১০৫ রানের ইনিংস। তিনটি ইনিংসেই ঝড়ো ব্যাটিং করেছেন তিনি। কিউইদের বিপক্ষে চতুর্থ ওয়ানডেতে ১০৬ বলে ১৩৮ রান এবং পঞ্চম ওয়ানডেতে ৬০ বলে ১০৪ রান করেন। স্কটিশদের বিপক্ষে মাত্র ৫৯ বলেই ১০৫ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নটিংহ্যামে ৯২ বলে ১৩৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
৩. বিরাট কোহলি
বিগত কয়েকবছরের মতো এবারও ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। ২০১৮ সালে তিনি মাত্র ১৪ ম্যাচে ছয়টি শতক এবং তিনটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। এ বছরে তার ব্যাটিং গড়ও অকল্পনীয়। ১৩৩.৫৫ ব্যাটিং গড়ে ও ১০২.৫৫ স্ট্রাইক রেটে ১,২০২ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও কোহলি।
বছরের শুরুটা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডারবানে ১১২ রানের ইনিংস খেলার মধ্য দিয়ে। এরপর ঐ সিরিজে আরও দুটি শতক হাঁকিয়েছেন তিনি। কেপটাউনে অপরাজিত ১৬০ এবং সেঞ্চুরিয়ানে অপরাজিত ১২৯ রানের ইনিংস খেলে ভারতকে সিরিজে জিততে সহায়তা করেন তিনি।
ইংল্যান্ডের মাটিতে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে শতকের দেখা না পেলেও ৭৫, ৪৫ এবং ৭১ রানের ইনিংস খেলেন কোহলি। এরপর ঘরের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম তিন ম্যাচের তিনটিতেই শতক হাঁকান তিনি। তিন ম্যাচে যথাক্রমে ১৪০, ১৫৭* এবং ১০৭ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
৪. জো রুট (অধিনায়ক)
ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জো রুট ২০১৮ সালে ওয়ানডেতে ৯৪৬ রান সংগ্রহ করেছেন, যার ফলে এ বছর সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তিনি চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছেন। ২৪ ম্যাচে তিনটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৯.১২ ব্যাটিং গড়ে তিনি এই রান সংগ্রহ করেছেন।
ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে জোড়া শতক হাঁকিয়ে তিনি ইংল্যান্ডকে সিরিজ জেতান। লর্ডসে তার অপরাজিত ১১৩ এবং লিডসে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংসের উপর ভর করে ভারতকে হারায় ইংল্যান্ড।
জো রুট ২০১৮ সালে নিজের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এছাড়া নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ডানেডিনে ১০২ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
৫. রস টেইলর
২০১৮ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা বেশি। মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে নিউ জিল্যান্ডের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান রস টেইলরই সব দিক বিবেচনায় সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। তিনি এ বছর মাত্র ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ১০ ইনিংসে ব্যাট করে দুটি শতক এবং চারটি অর্ধশত রানের ইনিংস খেলে ৯১.২৮ ব্যাটিং গড়ে ৬৩৯ রান সংগ্রহ করেছেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডানেডিনে তার অপরাজিত ১৮১ রানের অনবদ্য ইনিংসের উপর ভর করে নিউ জিল্যান্ড পাঁচ উইকেটের জয় তুলে নেয়। ইংল্যান্ডের দেওয়া ৩৩৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে নিউ জিল্যান্ডের দুই ওপেনার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরে যান। এরপর ব্যাট হাতে ক্রিজে নেমে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছিয়ে মাঠ ছাড়েন রস টেইলর। তিনি ১৪৭ বলে ১৭টি চার এবং ৬টি ছয়ের মারে ১৮১* রান করেছিলেন। ঐ সিরিজের প্রথম ম্যাচেও তার ১১৩ রানের উপর ভর করে ইংল্যান্ডকে হারায় নিউ জিল্যান্ড। পাকিস্তানের বিপক্ষে আবুধাবিতে দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার মাঝেও তিনি ৮০ এবং ৮৬* রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
৬. জস বাটলার (উইকেটরক্ষক)
২০১৮ সালের বর্ষসেরা ওয়ানডে দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসাবে একাদশে জায়গা করে নিলেন জস বাটলার। এই হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যান এ বছর ১৮ ইনিংস ব্যাট করে ৫১.৬১ ব্যাটিং গড়ে এবং ১১৩.৫৩ স্ট্রাইক রেটে ৬৭১ রান করেছেন। এর মধ্যে দুটি শতক এবং চারটি অর্ধশত রানের ইনিংস রয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য পারফরমেন্সের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যানচেস্টারে অপরাজিত ১১০ রানের ইনিংসটি। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২০৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১১৪ রান তুলতে ৮ উইকেট হারিয়ে পরাজয়ের প্রহর গুনছিল ইংল্যান্ড। সেখান থেকে অপরাজিত ১১০ রানের ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডকে ১ উইকেটের নাটকীয় জয় এনে দেন বাটলার। বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনিতে ৮৩ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডের জয়ে বড় অবদান রাখেন তিনি। এছাড়া এ বছর সবচেয়ে বেশি ৩৫টি ডিসমিসাল তার দখলে।
৭. সাকিব আল হাসান
অলরাউন্ডার হিসেবে এ বছর কোনো ক্রিকেটার উল্লেখযোগ্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারেনি। সে তুলনায় ইনজুরিতে ভোগা সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে বেশ উজ্জ্বল ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি ১৩ ইনিংসে ব্যাট করে পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৮.২৩ ব্যাটিং গড়ে ৪৯৭ রান করেছেন। বল হাতে ২৬.৮০ গড়ে ২১ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।
৮. রশিদ খান
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বর্তমানে বিশ্বের সেরা স্পিনার আফগানিস্তানের রশিদ খান। ২০১৮ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। মাত্র ২০ ম্যাচে ১৪.৪৫ বোলিং গড়ে ৪৮ উইকেট শিকার করেছেন এই লেগস্পিনার। ম্যাচে ৫ উইকেট শিকার করেছেন দুবার। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনি ৫ উইকেট শিকার করেছেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শারজাহতে ২৪ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট শিকার করেছেন, যা এ বছর তার সেরা বোলিং ফিগার।
৯. কুলদ্বীপ যাদব
২০১৮ সাল ছিলো লেগস্পিনার, চায়নাম্যান বোলারদের বছর। রশিদ খান, কুলদ্বীপ যাদব, আদিল রাশিদ, যুযবেন্দ্র চাহাল, শাদাব খানসহ আরও বেশ কয়েকজন রিস্ট স্পিনার এ বছর সাফল্যের মুখ দেখেছেন।২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট সংগ্রাহকদের মধ্যে সবাই রিস্ট স্পিনার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি কুলদ্বীপ যাদব ১৯ ম্যাচে ১৭.৭৭ বোলিং গড়ে ৪৫ উইকেট শিকার করেছেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নটিংহ্যামে মাত্র ২৫ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট শিকার করে ভারতকে জয় এনে দিয়েছিলেন কুলদ্বীপ। তার স্পিনের সামনে পুরো সিরিজেই ভুগেছিল ইংলিশ টপ-অর্ডাররা। তিনি এশিয়া কাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও ছন্দে ছিলেন।
১০. লুঙ্গী এনগিডি
দক্ষিণ আফ্রিকার ডানহাতি পেসার লুঙ্গী এনগিডির ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২০১৮ সালেই। অভিষেকের পর থেকেই দলের বোলিং আক্রমণে অন্যতম সদস্যে পরিণত হয়েছেন তিনি। এ বছর ১৩টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২৩.০৩ বোলিং গড়ে ২৬ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে পোর্ট-এলিজাবেথে ৪টি এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাল্লেকেলেতে ৪টি করে উইকেট শিকার করেছেন তিনি।
১১. মুস্তাফিজুর রহমান
২০১৮ সালে পেসারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার মুস্তাফিজুর রহমান। এ বছর ১৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২১.৭২ বোলিং গড়ে এবং ৪.২০ ইকোনমি রেটে তিনি ২৯টি উইকেট শিকার করেছেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপের অঘোষিত সেমিফাইনালে ৪ উইকেট শিকার করে বাংলাদেশের জয়ের অবদান রেখেছিলেন তিনি। এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম এবং অ্যাওয়ে, দুই সিরিজেই স্বরূপে ছিলেন মুস্তাফিজ।
** ** **
২০১৮ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে রোহিত শর্মা এবং জনি বেয়ারস্টো ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন ওপেনার রানের মধ্যে ছিলেন। শিখর ধাওয়ান, শাই হোপ, ফখর জামান, ইমাম উল হক, জেসন রয় এবং তামিম ইকবালও রানের মধ্যে ছিলেন।
মিডল-অর্ডারে ইয়ন মরগান, ব্রেন্ডন টেইলর, মুশফিকুর রহিমও ছন্দে ছিলেন। অলরাউন্ডারদের মধ্যে সাকিব আল হাসানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জিম্বাবুয়ের সিকান্দার রাজা এবং আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবী। এছাড়া শ্রীলঙ্কার থিসারা পেরেরাও ব্যাটে-বলে দারুণ এক মৌসুম কাটিয়েছেন। স্পিনারদের মধ্যে আদিল রাশিদ এবং মুজিবুর রহমান দুর্দান্ত বোলিং করলেও একাদশে জায়গা করে নিতে পারেননি।