২০১৪ সালে ব্রাজিলে এই ট্রফিটা মাথার ওপর তুলে ধরেছিলেন ফিলিপ লাম। ২৪ বছর পর কোনো জার্মান অধিনায়ক হিসেবে জিতেছিলেন ফিফা বিশ্বকাপ। এই ট্রফি জয়ের সাথে সাথে ফুটবল বিশ্বে সবচেয়ে সফল অধিনায়কদের একজন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঘরোয়া লিগ, কাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, কআলাব কাপ এবং বিশ্বকাপ; এত ট্রফির সংগ্রহ বিশ্বে খুব কম খেলোয়াড়েরই আছে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পরপরই নিজের অবসরের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিলেন এই ফুল ব্যাক। ৩৪ বছর বয়সে তিনি আবার ফিরে আসছেন আজ বিশ্বকাপের ফাইনাল মঞ্চে।
লাম ফুটবলের বৃহত্তম আসরের শ্রেষ্ঠতম মঞ্চ ফাইনালে বিশ্বকাপ ট্রফিকে নিয়ে আসবেন। মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে তিনিই হস্তান্তর করবেন এই ট্রফি। লাম বলেছেন, তিনি আসলে জার্মান ফুটবলের যে গর্ব ছিলো চার বছর ধরে, সেটা নতুন কারো হাতে তুলে দিতে চান। লাম ফিফা ডট কমকে বলেছেন, এই মুহুর্তটা তাদের ও জার্মানির জন্য দুঃখের মুহুর্ত। তবে এটা একইসাথে ট্রফিটা আবার জার্মানিতে ফেরানোর একটা অনুপ্রেরণাও হতে পারে।
ক্রোয়েশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে ফাইনালের আগে ফিফা ডট কমকে এই ট্রফি হস্তান্তরের অনুভূতি বিস্তারিত বলেছেন সাবেক জার্মান অধিনায়ক ফিলিপ লাম।
চার বছর আগে এই ট্রফিটা জিতেছিলেন। আর খানিক সময়ের মধ্যেই এটা আপনাকে নতুন চ্যাম্পিয়ন দলের কাছে হস্তান্তর করে দিতে হবে। এই সময়ের অনুভূতিটা আসলে কেমন?
আমি জার্মান জাতীয় দলের একজন প্রতিনিধি হিসেবে বা জার্মানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে ট্রফিটা তুলে দেবো। গত চার বছর ধরে আমরা যে গর্ব অনুভব করেছি, সেটা আমরা নতুন কারো কাছে তুলে দেবো। এর ভেতর দিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে নিবিঢ় অনুভূতি সেটার এক অর্থে সমাপ্তি হবে। আমরা আমাদের গর্বটা নতুন বিজয়ীর কাছে হস্তান্তর করে দেবো।
ট্রফি হস্তান্তরের সেই মুহুর্তটায় আপনার মাথায় আসলে কী কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে?
এটা অসাধারণ একটা মুহুর্ত। কারণ, এটাই সেই মূল ট্রফি। বাস্তবতা হলো, কয়েক মুহুর্তের জন্যই মাত্র এটা হাতে ধরার সুযোগ পাওয়া যায়। একজন অধিনায়ক হিসেবে এটা হাতে নিলে সেসব খেলোয়াড়ের কথা মাথায় আসে, যারা এটা বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন এবং অন্যকে দিয়েছেন। জার্মানির অধিনায়ক ফ্রিৎজ ওয়াল্টার, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও লোথার ম্যাথিউস। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অধিনায়করা; যেমন ববি মুর, কার্লোস আলবার্তো, ড্যানিয়েল প্যাসারেলা, দিনো জফ, ডিয়েগো ম্যারডোনা, কার্লোস দুঙ্গা, দিদিয়ের দেশম, কাফু, ফ্যাবিও ক্যানাভারো ও ইকার ক্যাসিয়াস এই ট্রফিটা ধরতে পেরেছেন।
ব্রাজিল-২০১৪ আসর সম্পর্কে ভাবতে গেলে কী স্মৃতি মনে পড়ে?
আমার ফাইনালে শেষ বাঁশিটার কথা মনে পড়ে কিছু ভাবতে গেলে। মারিও গোটশে গোলটা করার পর থেকে ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিটগুলো ছিলো আমার জীবনের দীর্ঘতম সময়। আমি স্রেফ চিন্তা করছিলাম, ‘প্লিজ, প্লিজ, বাঁশিটা বাজাও।’ আমার মনে পড়ছে, এরকম সময়ে আর্জেন্টিনা একটা ফ্রি কিক পেয়ে গেলো। আর লিওনেল মেসি ঠিক ক্রসবারের ওপর থেকে জোরে মেরে দিলো। তখন ম্যানুয়েল নয়্যার গোল কিক নিলো এবং বাঁশিটা বেজে উঠলো। ওই ম্যাচের শেষ কয়েকটা মিনিট এবং ম্যাচের পরের দুই একটা ঘন্টা আমার সমস্ত চিন্তা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো।
কার্লোস পুওল মারাকানায় আপনার হাতে ট্রফিটা তুলে দিয়েছিলো। রবিবার আপনার হাত থেকে নিয়ে কে ট্রফিটা উচু করে ধরবে বলে মনে হচ্ছে?
ম্যাচেই সেটা ঠিক হবে। আমি কোনোভাবেই কোনো ফেবারিট বাছাই করতে রাজী নই। অবশ্যই আমি কল্পনা করতে পারি হুগো লরিসের কথা। ফ্রান্সের জন্য এটা কী অর্থ বহন করে, তা আমি বুঝতে পারি। দেশম ও জিদানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই খেলোয়াড়রাও সেই কাজটা করতে চায়। আবার লুকা মদ্রিচ ও ক্রোয়েশিয়ার জন্যও একই কথা। ওরা এই প্রথমবার নিজেদের ইতিহাসে ফাইনাল খেলতে এসেছে। ওরাও চাইবে ট্রফিটা তুলে ধরতে।
আপনি কী সেমিফাইনালে চারটি ইউরোপের দল দেখে একটু বিস্মিত হয়েছেন?
হ্যা, আমি খানিকটা বিস্মিত হয়েছি। আমি সবসময় আশা করছিলাম, একটা অন্তত দক্ষিণ আমেরিকান দল শেষ চারে পৌঁছাবে। সেটা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা উরুগুয়ে কেউ হতে পারে। সবসময়ই দক্ষিণ আমেরিকায় আশীর্বাদপ্রাপ্ত ফুটবলাররা জন্মায় বিপুল প্রতিভা নিয়ে। আমাদের ইউরোপে অব্শ্যই সেরা অবকাঠামো আছে। এছাড়া জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি ও ফ্রান্সে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ লিগগুলো অনুষ্ঠিত হয়। আমরা সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে এখানে লিগ আয়োজন করি এবং সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ চ্যাম্পিয়নশিপগুলো এখানে হয়। ফলে ইউরোপের জাতীয় দলগুলো এর ভেতর দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এমনকি তুলনামূলক ছোট দেশগুলোও, যেমন বেলজিয়াম বা ক্রোয়োশিয়াও এতে উপকৃত হয়।
জার্মানির পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার কী মনে হলো?
একসঙ্গে জড়ো হওয়া, একটা দল হিসেবে গড়ে ওঠা এবং ইউরোপিয়ান বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া; এসব একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা কোনো জাদু নয়। আমরা যেটা দেখলাম, জার্মানির খেলায় শিল্প বলে কিছু না। আমি নিশ্চিত জার্মানির সেই শক্তি আছে যে, তারা আবার শক্ত হয়ে ফিরে আসতে পারবে। তারা নতুন একটা প্রজন্মকে শক্তিশালী জার্মান দল হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। যারা গ্যারি লিনেকারের সেই কথাকে সত্যি বলে প্রমাণ করবে, “ফুটবল একটা সরল খেলা। বাইশ জন মানুষ নব্বই মিনিট ধরে একটা বলকে ধাওয়া করে এবং শেষে জার্মানরা জেতে।”
জার্মানির আগেভাগে বিদায়ের পরও আপনি ফাইনালে জার্মানির জার্সি পরবেন। ট্রফিকে বিদায় জানানোটা কেমন হবে?
চার বছর আগে জার্মান ফুটবল যে গর্ব অনুভব করেছিলো, আমি সেই গর্ব হস্তান্তর করে দেবো। গর্বটা নতুন বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা সুন্দর একটা খেলার শক্তিশালী একটা চিত্রে পরিণত হবে। এই মুহুর্তটা আমাদের জন্য, জার্মানির জন্য একটু দুঃখের একটা মুহুর্ত হবে। তবে একইসাথে এটা নতুন করে এই ট্রফিটা ফিরে পাওয়ার একটা প্রেরণাও হবে। আমরা এই মুহুর্তকে পরের বিশ্বকাপ জয়ের জন্য শক্তি এক করতে ব্যবহার করতে পারে। একইসাথে ২০২৪ ইউরো আয়োজনের জন্য এবং আরেকটা ফুটবল উৎসব পৃথিবীকে উপহার দেওয়ার জন্য আমরা এই মুহুর্তটাকে কাজে লাগাতে পারি।
ফিলিপ লাম
১৯৮৩ সালের ১১ নভেম্বর মিউনিখে জন্ম এই ফুটবলারের। সারাটা জীবন মিউনিখেই কাটিয়েছেন। বায়ার্ন মিউনিখের দ্বিতীয় দলের হয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর ২০০২-২০১৭ সাল অবধি বায়ার্নের মূল দলে খেলেছেন। এর মধ্যে শুরুর দিকে দুই বছর অবশ্য ধারে খেলেছেন ভিএফবি স্টুটগার্টে।
জার্মানির একেবারে অ্যাকাডেমি থেকে শুরু করেছেন। জার্মানির পাঁচটি বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন বিভিন্ন স্তরে। ২০০৪ সালে জার্মান মূল দলে অভিষেক তার। জাতীয় দলের হয়ে ১১৩টি ম্যাচ খেলে ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ের পর অবসর নেন এই ফুটবলার।
বায়ার্নের হয়ে ৮টি বুন্দেস লিগা, একটি ক্লাব বিশ্বকাপ, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটি উয়েফা সুপার কাপ জিতেছেন। অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক ক্যারিয়ারের মালিক ছিলেন লাম।