ফুটবল ম্যাচে দর্শকরা তো কোনো একজন খেলোয়াড়কে অভিবাদন জানাতেই পারে, এ আর এমন আশ্চর্য কী! কিন্তু ইউরোপিয়ান ফুটবল সংস্কৃতি ঠিক এমন না। আমরা কি এমনটা দেখি সাধারণ খেলাগুলোয়? প্রতিপক্ষের পায়ে যখন বল তখন ঘরোয়া দর্শকগণ সিটি বাজাচ্ছে, দুয়ো দিচ্ছে। পুরো স্টেডিয়ামকে প্রতিপক্ষের জন্য এক দুর্গে পরিণত করে ফেলাও সফল সমর্থকগোষ্ঠীর এক গুণের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই ধারার মাঝেও এমন কিছু ঘটনা আছে যা ফুটবলের চিরায়ত সৌন্দর্যের পরিচায়ক। সেটা হলো, প্রতিপক্ষের মাঠে অভিবাদন পাওয়া।
মূলত দুয়ো দেয়া বা কোরাস গাওয়ার মতো সম্মিলিত ঘটনাগুলো আগে থেকেই ঘরোয়া সমর্থকদের জানা থাকে। তারা প্রস্তুত হয়েই আসেন দুয়ো দিতে। ঠিক এই কারণেই প্রতিপক্ষের মাঠে অভিবাদন পাওয়াটা এত মাহাত্ম্যের, কারণ এটা হয় স্বতস্ফুর্ত। এটা পূর্বপরিকল্পিত কোনো কিছু না, যে যার অবস্থান থেকে ওই খেলোয়াড়কে বৈরিতার উর্ধ্বে গিয়ে অভিবাদন জানায়। আজ দেখে নেয়া যাক, তেমনই কিছু ঘটনা।
রোনালদো বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (২০০৩)
সদ্য ২০০২ সালে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জয়ী রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক নকআউট পর্বের ম্যাচে ওল্ড ট্রাফোর্ডে আসেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্টেডিয়াম ওল্ড ট্রাফোর্ডকে বলা হয় ‘থিয়েটার অব ড্রিম’। সেই ম্যাচে ৪-৩ গোলে হেরে যায় রিয়াল মাদ্রিদ, কিন্তু দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৫ গোলে জিতে নেয় রিয়াল। রিয়ালের হয়ে হ্যাটট্রিক করে ইউনাইটেডের আশায় পানি ঢেলে দেন রোনালদো। ইউনাইটেড ডিফেন্সকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া রোনালদোর হ্যাটট্রিক পূর্ণ হওয়ার পর পুরো ওল্ড ট্রাফোর্ড দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় এই ব্রাজিলিয়ান মহাতারকাকে। হয়ত রেড ডেভিল ফ্যানরা বুঝতে পেরেছিল যে, তাঁরা এক বিশেষ মুহুর্ত অবলোকন করছেন।
স্টিভেন জেরার্ড বনাম চেলসি (২০১৫)
জেরার্ড আদ্যোপান্ত একজন লিভারপুল-ম্যান। গোটা ক্যারিয়ার তাঁর লিভারপুলেই কেটেছে। আবার চেলসি ও লিভারপুলের বৈরিতাও সর্বজন বিদিত। জেরার্ড তাঁর লিভারপুল ক্যারিয়ারে অনেকবার চেলসির সমর্থকদের থেকে দুয়ো পেয়েছেন। এমনকি ২০১৪ সালে চেলসির সাথে জেরার্ডের পা পিছলে যাওয়ার কারণে লিভারপুল হাতছোয়া দূরত্বে এসেও লিগ জিততে পারেনি। এটা নিয়েও বিস্তর মজা করেছেন চেলসি সমর্থকরা। কিন্তু অবসরের ঘোষণা দেয়ার পর জেরার্ড যখন চেলসির মাঠে তাঁর জীবনের শেষ ম্যাচ খেলতে আসেন, সেই ম্যাচে উঠে যাওয়ার সময় গোটা স্টেডিয়াম তাঁকে অভিবাদন জানায়।
মেসি বনাম এটলেটিকো মাদ্রিদ (২০০৯)
মাদ্রিদ-কাতালোনিয়ার দ্বন্দ্ব কে না জানে? আর মাদ্রিদের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠে কাতালান কোনো ক্লাবের একজনের অভিবাদন পাওয়াটা চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু আমরা এমন একজনের কথা বলছি যিনি ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা একজন; লিওনেল মেসি। ২০০৯ সালে কোপা দেল রের এক ম্যাচে বার্সেলোনা এটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠে তাঁদের ৩-১ গোলে হারায়। সেই ম্যাচে মেসি একক নৈপুণ্যে হ্যাটট্রিক করেন। এটলেটিক মাদ্রিদ ফ্যানরাও দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান এই জাদুকরকে।
বার্গক্যাম্প বনাম ম্যানসিটি (২০০২)
২০০০ সালের দিকের অপ্রতিরোধ্য আর্সেনালের অন্যতম কান্ডারী ছিলেন ডাচ তারকা বার্গক্যাম্প। ম্যানসিটির মাঠে এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আর্সেনালকে নিজেই হ্যাটট্রিক করে জেতান। সেই ম্যাচে শুধু হ্যাটট্রিক না, সার্বিক পারর্ফরমেন্স বার্গক্যাম্পের এতই অসাধারণ ছিল যে, গোটা সিটি স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় এই ডাচ তারকাকে।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বনাম লিভারপুল (২০১৪)
২০০৬ বিশ্বকাপে পর্তুগাল বনাম ইংল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে রুনি কড়া ট্যাকেল করে বসেন পর্তুগালের কারভালহোকে। সেই সময় রুনির ক্লাব সতীর্থ রোনালদো রেফারিকে চাপ দিতে থাকেন লাল কার্ড দেয়ার জন্য। রেফারি দিয়ে দেন কার্ড, ইংল্যান্ড বাদ পড়ে যায়। ক্ষোভে ফুসতে থাকা ইংলিশ সমর্থকরা সিদ্ধান্ত নেন রোনালদোর জীবনকে অতিষ্ঠ করে দেয়ার। শুরু হয় সব স্টেডিয়ামে রোনালদোকে অতিমাত্রায় দুয়ো দেয়া।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলের মাঠেও অনেক দুয়ো দেয়া হতো। এরপর ইউনাইটেড ছেড়ে রিয়ালে চলে যান তিনি। রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক ম্যাচে লিভারপুলের মাঠে খেলতে আসেন। রজার্সের লিভারপুলের সাথে অনবদ্য এক প্রদর্শনীতে ৩-০ গোলে হারায় রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ম্যাচে রোনালদো এতটাই দারুণ ছিলেন যে, লিভারপুলের মাঠের বেশ বড় একটা অংশ তাঁকে সম্মানিত করে করতালির মধ্য দিয়ে।
রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে বিশেষ কিছু অভিবাদনের ঘটনা
দেল পিয়েরো বনাম রিয়াল (২০০৮)
রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামে দেল পিয়েরো তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা পারফর্মেন্স দেন। বাম পায়ের বাঁকানো শটে প্রথম গোল দেন আর দ্বিতীয় গোলটি করেন অসাধারণ ফ্রি কিকে। তাঁর এই অসাধারণ পারফর্মেন্সে রিয়ালের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও গোটা বার্নাব্যু দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় এই জুভেন্টাস তারকাকে।
ইনিয়েস্তা বনাম রিয়াল (২০১৫)
২০১৫ সালের বার্নাব্যু এল ক্লাসিকোতে রিয়ালের সামনে সমীকরণ ছিল এমন যে, জিতলে রিয়াল লিগে এগিয়ে যাবে। কিন্তু বার্নাব্যুতে অনবদ্য এক প্রদর্শনীতে বার্সা ৪-০ গোলে হারায় রিয়াল মাদ্রিদকে। ইনিয়েস্তা সেই ম্যাচে খুব চোখ ধাঁধানো কিছু না করেও গোটা ম্যাচ একাই নিয়ন্ত্রণে রেখে দেখিয়ে দেন বয়সকে পেছনে ঠেলেও কিভাবে দলকে খেলানো যায়। যখন ইনিয়েস্তা মাঠ ছাড়েন, গোটা বার্নাব্যু উঠে দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে সম্মান জানায় সর্বজননন্দিত এই তারকাকে।
কিন্তু এর জবাবটা বার্সা সমর্থকরা খুব একটা ভাল দেননি। ২০১৬ সালে ভ্যালেন্সিয়ার চেরিশেভকে বার্সা সমর্থকরা ৭-০ গোলে জেতা এক ম্যাচে অভিবাদন জানান। কেন জানেন? সাবেক রিয়াল এই খেলোয়াড়কে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও ভুল করে নামানোয় স্প্যানিশ কাপ থেকে ভাদ দেয়া হয় রিয়ালকে। আর এ নিয়ে মশকরা করতেই চেরিশেভকে হাততালি দেয় ক্যাম্প ন্যু। লরি কানিংহ্যাম নামে একজন রিয়াল খেলোয়াড়কে ১৯৮০ সালের দিকে এক ম্যাচে ক্যাম্প ন্যুতে অভিবাদন দেয়া হয়, যদিও তা খুব একটা স্বতস্ফুর্ত কিছু ছিল না।
ম্যারাডোনা বনাম রিয়াল (১৯৮৩)
ম্যারাডোনার বার্সা অধ্যায়টা ছিল ঠিক তাঁর খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের মতো। উত্থান-পতনের এই সময়ে বার্নাব্যুতে হওয়া এক ক্লাসিকোতে এক গোল বানিয়ে দেন এবং অসাধারণ এক গোলে বার্সাকে দুই গোল ব্যবধানে এগিয়ে দেন। বার্নাব্যু সমর্থকগণ আর্জেন্টাইন মহাতারকাকে সন্মানিত করতে ভোলেননি। বৈরিতা ভুলে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকেন ম্যারাডোনাকে।
ফ্রান্সেসকো টট্টি বনাম রিয়াল (২০১৬)
টট্টি একজন রোমা লিজেন্ড। রোমায় আজীবন খেলে যাওয়া এই তারকা বার্নাব্যুতে খেলতে আসেন ২০১৬ সালে। মোটামুটি যখন রিয়াল রুটিন জয়ের পথে ঠিক তখন টট্টি মাঠে নামেন। তাঁর ক্যারিয়ারও প্রায় সায়াহ্নে তখন। রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরা এই মহাতারকাকে সম্মান দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। সোল্লাসে বার্নাব্যু স্বাগত জানায় টট্টিকে। ঠিক একইভাবে স্টিভেন জেরার্ডকেও সম্মানিত করেছিল বার্নাব্যু।
রোনালদিনহো বনাম রিয়াল (২০০৫)
রোনালদিনহো সেই সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা। বার্সাকে এনে দিয়েছেন নবযুগ। রিয়ালের আধিপত্যে দিয়েছেন বড় ধাক্কা। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে অনুষ্ঠিত সেবার ক্লাসিকোতে রিয়ালকে ৩-০ গোলে হারায় বার্সা। সেই ম্যাচে রিয়াল ডিফেন্সকে বলতে গেলে এক শিক্ষাই দিয়েছিলেন রোনালদিনহো। বাম পাশ দিয়ে বারবার রামোসকে পরাস্ত করে বার্নাব্যুকে এতটাই মোহাবিষ্ট করেছিলেন যে, তাঁর দ্বিতীয় গোলের পর বার্নাব্যু দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় এই ব্রাজিলিয়ান জাদুকরকে।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বনাম জুভেন্টাস (২০১৮)
এবার ২০১৭-১৮ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে জুভেন্টাসের মাঠে মুখোমুখি রিয়াল মাদ্রিদ। শুরু থেকেই রোনালদোর পায়ে বল যাওয়ার সাথে সাথেই পুরো স্টেডিয়াম প্রচন্ড দুয়ো দিচ্ছিল। শুরুতেই দলকে এগিয়ে দেন রোনালদো ক্ষিপ্র ফিনিশিংয়ে। এরপর ৬৭ মিনিটে অনন্য এক ওভারহেড গোলে জুভেন্টাসকে বিদায়ের দুয়ারে ঠেলে দেন রোনালদো। সেই পর্যন্ত প্রচন্ড দুয়ো দিতে থাকা স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানায় এই পর্তুগিজ মহাতারকাকে। ম্যাচশেষে চিয়েল্লিনি পর্যন্ত বলেন যে, রোনালদোর কীর্তি আসলেই অনন্য, কারণ জুভেন্টাসের স্টেডিয়াম সাধারণত কাউকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন দেয় না। রোনালদোও জুভেন্টাস সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এত বিশাল মাপের অভিবাদন আমি আর কখনো পাই নি।”
ফিচার ছবিসত্ত্ব: The Independent