Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টেনেরিফের কাছে রিয়াল মাদ্রিদের টানা দুইবার শেষ দিনে লিগ হারার দুঃখগাঁথা

টেনেরিফে স্পেনের ছোট্ট সাজানো এক শহর। মন ভরিয়ে দেয়া এই শহর সবার মন ভরায়নি। এর মাঝে ক্রীড়াজগতে সবচেয়ে বেশি রিক্ততার স্বাদ দিয়েছে বোধ হয় রিয়াল মাদ্রিদকে। পাঠক, একটা লিগ মানে ৮ মাসব্যাপী ৩৮ ম্যাচের এক লড়াই। তুষারপাত, বৃষ্টিপাত কিংবা প্রখর রৌদ্রের তেজ মাথায় নিয়ে ৩৮ ম্যাচের লড়াই শেষে যে বিজয়গাঁথা রচিত হয়, সমর্থকদের কাছে তার মূল্য অপরিসীম। কিন্তু যদি শেষ দিনে এসে আপনার সারা মৌসুমের লড়াইয়ের ফলপ্রাপ্তির হাতছোঁয়া দূরত্বে থাকা অবস্থায় গিয়ে ব্যর্থ হতে হয়? তেমনটিই ঘটেছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের সাথে, একবার নয়, টানা দুইবার। এর চেয়েও নির্মম ব্যাপার হলো, যার হাতে এই স্বপ্নভঙ্গ তিনি ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদেরই কিংবদন্তী! চলুন, আজ সেই গল্প শোনা যাক।

এই সেই টেনেরিফে স্টেডিয়াম; Image Source: Flickr

মৌসুম ১৯৯১-৯২

সেই মৌসুমটা ছিল লা লিগার ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক মৌসুম। ২০১৪ সালের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের লিগ জেতার মৌসুমের কথা মনে আছে? সেবার ত্রিমুখী লড়াই হয়েছিল তিন স্প্যানিশ জায়ান্টের মধ্যে। ১৯৯১-৯২ মৌসুমটাও তেমনই ছিল। শুরুর পরাক্রমটা দেখায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। প্রথম আট ম্যাচের মাঝে সাত ম্যাচ জিতে নেয় তারা। সেই তুলনায় বার্সা আর রিয়ালের সূচনাটা ছিল বাজে। এর পরের খেলটা দেখায় রিয়াল। ১৩ ম্যাচের মধ্যে ১২টি জিতে তারা উড়তে থাকে। রিয়াল যখন ফর্মে ওঠে, ঠিক তখনই ফর্ম হারায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ফলাফল, রিয়াল মাদ্রিদ এককভাবে শীর্ষে। সবচেয়ে বাজে সূচনা ছিল বার্সেলোনার। বার্সার কোচ তখন স্বয়ং ইয়োহান ক্রুয়েফ। আগেরবার লিগ জিতলেও সে মৌসুমে নতুন ধাঁচের সাথে অনেক বার্সা খেলোয়াড়েরই সময় লাগছিল মানিয়ে নিতে। প্রথম ৭ ম্যাচে তাদের যাচ্ছেতাই অবস্থা। কিন্তু দেরিতে হলেও সময়মতো ছন্দ পেয়ে যায় বার্সা।

বার্সার ডাগ আউটে তখন ইয়োহান ক্রুয়েফ; Image Source: The National

লিগের মধ্যভাগে ছন্দপতন হয় রিয়ালের। টানা ৬ ম্যাচে কোনো জয় নেই রিয়ালের। সেই সময় অ্যাটলেটিকো আর বার্সা হয়ে উঠল ধারাবাহিক। এতে করে বার্সা রিয়ালের সাথে ব্যবধান কমিয়ে ফেলে আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ চলে আসে রিয়ালের হাতছোঁয়া দূরত্বে। কিন্তু তাদের স্বপ্নে পেরেক ঠুকে দেয় রিয়াল মাদ্রিদই। লিগে ৫ ম্যাচ বাকি থাকার সময় অ্যাটলেটিকোর মাঠে ডার্বি ম্যাচে ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকেও নাটকীয়ভাবে ৩-২ গোলে জিতে অ্যাটলেটিকোর স্বপ্ন শেষ করে দেয় রিয়াল। পরবর্তী ৪ ম্যাচে তেমন কোনো বড় দলের বাঁধা ছিল না রিয়ালের। বার্সাও ছিল রিয়ালের চেয়ে পাঁচ পয়েন্ট পেছনে। ধরেও নেয়া হচ্ছিল রিয়াল লিগ জিতবে।

কিন্তু রিয়াল অভাবনীয় কাজটি করে বসে। খর্বশক্তির ওসাসুনা আর ওভেইদোর সাথে ড্র করে তারা। লিগ শেষ দিনে গড়ালো। শেষ দিনের সমীকরণ ছিল এমন যে, রিয়াল বার্সার চেয়ে এক পয়েন্টে এগিয়ে। বার্সার নিজের মাঠে জারাগোজার সাথে খেলা আর রিয়ালের ম্যাচ টেনেরিফের সাথে। দেরিতে ফর্ম ফিরে পাওয়া বার্সা ক্রুয়েফের দর্শনের সুফল পেতে শুরু করেছে তখন, শেষ রাউন্ডের আগে ২৫ ম্যাচ অপরাজিত তারা।

রিয়ালের প্রতিপক্ষ টেনেরিফে লিগ টেবিলের শেষ অর্ধেরও প্রায় শেষভাগে, কোনো বড় দলের সাথেই তাদের সেবার আহামরি কোনো পারফর্মেন্স নেই, জয় দূরে থাক! ডাগআউটেও কোচ একজন মাদ্রিদিস্তা, জর্জে ভালদানো। স্ট্রাইকার হিসেবে রিয়ালকে জিতিয়েছেন দুটো উয়েফা কাপ, ছিলেন রিয়াল যুব দলেরও কোচ। টালমাটাল টেনেরিফের দায়িত্ব নেন মাঝ মৌসুমে, দায়িত্ব ছিল অবনমন এড়ানো। এবার বুঝুন কেমন ছিল টেনেরিফের হাল! ফেভারিট হিসেবেই ম্যাচ শুরু করে রিয়াল। ২-০ গোলে এগিয়েও যায় ম্যাচে। অতি-আত্মবিশ্বাসই হবে হয়তো, গা-ছাড়া রিয়ালকে যখন এক গোল দিয়ে দেয় টেনেরিফে, আত্মবিশ্বাস পরিণত হয় শঙ্কায়। কারণ একই সময়ে হওয়া অন্য ম্যাচে বার্সা তখন এগিয়ে। ড্র করলেও লিগ বার্সার- সেই আশঙ্কাই পেয়ে বসে রিয়ালকে। আশঙ্কাই সত্য হলো। পুঁচকে টেনেরিফের কাছে ২-০ তে এগিয়ে থাকা রিয়াল মাদ্রিদ গুনে গুনে হজম করে তিন গোল। মিশেল, হিয়েরোদের কাঁদিয়ে এক মাদ্রিদিস্তা কোচের দল টেনেরিফে বার্সাকে উপহার দেয় তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত লিগ, যারা ৩৮তম ম্যাচ অর্থাৎ শেষ ম্যাচের আগে একবারের জন্যেও লিগ টেবিলের শীর্ষে থাকেনি! কোচ ক্রুয়েফের টিকিটাকা দর্শনের টানা দ্বিতীয় লিগ জয় সেই দর্শনের মাহাত্ম্য সকলের কাছে পৌঁছে দেয়।

খেয়াল করে দেখুন, সেই মৌসুমে রিয়াল প্রথম ভাগের পর শেষ ম্যাচ বাদে আর শীর্ষচ্যুত হয়নি; Image Source: amcharts.com

মৌসুম ১৯৯২-৯৩

আগের মৌসুমের হতাশাগ্রস্থ রিয়াল নিয়ে আসে নতুন কোচ। নতুন কোচ দলকে সাজাতে একটু সময় নিচ্ছিলেন। আবার ওদিকে ক্রুয়েফের বার্সা টানা দুই লিগ জেতার ধারাবাহিকতা ও ক্রুয়েফ টনিকে থামার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছিল না। লিগের শুরুর দিকে একপর্যায়ে রিয়াল মাদ্রিদ চারেও নেমে যায়। সেবার কোনো অ্যাটলেটিকো রূপকথা হয়নি। মৌসুমের মাঝপথ থেকেই টেবিল চিরাচরিত রূপ ধারণ করে, সেই অকৃত্রিম রিয়াল-বার্সার লড়াই। এবারও যে ফিকশ্চার ছিল তাতে সেই টেনেরিফের মাঠেই ছিল রিয়ালের শেষ ম্যাচ! সেবারের লিগের অবস্থা ছিল আগেরবারের চেয়ে আলাদা। বার্সা শুরু থেকেই শীর্ষে আর রিয়াল মাদ্রিদ দ্বিতীয়তে। ঘরের মাঠে টেনেরিফেকে ৩-০ গোলেও হারালো রিয়াল, কিন্তু তা কোনো প্রতিশোধমূলক কিছুতে অভিধায়িত করা যাচ্ছিল না, আরো নাটক তখনো বাকি। এবার পাঁচ ম্যাচ বাকি থাকতে লিগের শীর্ষ দল বার্সা তাদের খেই হারায়। এল ক্লাসিকো ও দুই ম্যাচের বাজে ফলাফল ৩৭তম রাউন্ডে রিয়ালকে পৌঁছে দেয় লিগের শীর্ষ স্থানে। ৩৮তম ম্যাচে রিয়াল খেলতে যায় লিগ লিডার হিসেবে। বার্সার চেয়ে এক পয়েন্ট এগিয়ে। সেবারও বার্সার ম্যাচ হোমে আর রিয়ালের ম্যাচ সেই টেনেরিফের মাঠে। ডাগ আউটেও সেই ভালদানো, যিনি টেনেরিফেকে ততদিনে আরো শাণিত করেছেন, নিয়ে গেছেন ইউরোপা লিগ খেলার অবস্থানে। পুনরাবৃত্তি না প্রতিশোধ- এমন সমীকরণে মাঠে নামে রিয়াল।

সেই জর্জে ভালদানো যার হাতে রিয়ালের টানা দুই লিগ হার; Image Source: Conmebol

এবার আর রিয়াল আগেই এগোয়নি। শুরুতেই গোল হজম করে বসে তারা। যেহেতু লিগের শেষ ম্যাচ সব একই সময়ে হয়, ক্যাম্প ন্যু তে বার্সার ম্যাচ চলাকালীন রিয়ালের গোল হজমের খবর পৌঁছালে উল্লাসে ফেটে পড়ে বার্সা। এর মিনিট খানেকের মধ্যেই বার্সাকে গোল এনে দেন স্ট্রাইকার স্তোইচকোভ। ক্যাম্প ন্যুর উপর দিয়ে বিমান গেলেও তখন শব্দ শোনা যায় না। এদিকে রিয়াল মাদ্রিদ ধীরে ধীরে নিজেদের খেলা মেলে ধরতে থাকে। একের পর এক সুযোগ তৈরি করতে থাকে। গোল পাওয়া মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। তুখোড় রিয়াল স্ট্রাইকার জামোরা একের পর এক গোল মিস করতে থাকেন। প্রায় সাতটি গোলের সুযোগ নষ্ট করার পর বোঝা যাচ্ছিল, দিনটি আর রিয়ালের না। উল্টো গোল খেয়ে বসে আবার। নিশ্চিত হয়ে যায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো একই পরিণতি হতে যাচ্ছে।

আনন্দে উদ্বেল বার্সা খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা; Image Source: FC Barcelona

বার্সার ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিত্ব ক্রুয়েফ বার্সাকে দিয়েছেন লিগে একাধিপত্য, টানা চারটি লিগ জিতেছিল সেই বার্সা। ইতিহাস এতটুকু মনে রাখে, মনে রাখে না টেনেরিফের ‘জায়ান্ট কিলার’ হয়ে উঠে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে তোলার কথা। কিন্তু রিয়াল ঠিকই মনে রাখে, কারণ এটা তাদের বেদনার ইতিহাস। টেনেরিফের মাঠে ১৮০ মিনিটের ভালো খেলা রিয়ালের বর্তমান লিগ সংখ্যা ৩৩-কে উন্নীত করতে পারতো ৩৫ এ, বার্সার সাথে লিগ ব্যবধান ৮-কে করতে পারতো ১২! আবার এটাও ঠিক, ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয়েছিল এমন এক বার্সার দিকে, যে বার্সা ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবল খেলছিল। তবে কি ভালদানো ছিলেন ঘরের শত্রু বিভীষণ? আপাতভাবে তা-ই। ১৯৯৪ সালে সেই ম্যাচের পর ভালদানোর কোচ হিসেবে পরবর্তী ম্যাচ ছিল রিয়ালের হয়ে, পরের মৌসুমে! ভালদানো বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছিলেন। ক্রুয়েফের সাম্রাজ্য তিনিই ভাঙেন। ক্রুয়েফের বার্সা রিয়ালকে ৫-০ গোলের যে লজ্জা দিয়েছিল, ভালদানো রিয়ালের কোচ হিসেবে তা-ও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পরে বার্নাব্যুতে ফিরিয়ে এনেছিলেন লিগ ট্রফি। কিন্তু সে সময়ের নিয়মিত দর্শক মাদ্রিদিস্তাদের মনে সেই টানা দুইবারের ভগ্ন স্বপ্নগুলো কি আর ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন?     

ফিচার ইমেজ: AS English – Diario AS

Related Articles