১
ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দেওয়ার জন্য পেসাররা হঠাৎ করেই বাউন্সার দিয়ে বসেন। বাউন্সার থেকে নিজের শরীরকে বাঁচানোর জন্য ব্যাটসম্যানরা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। কেউ বল থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে এলোমেলো শট খেলে বসেন। দেখে-শুনে বল ছেড়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন অনেক ব্যাটসম্যান।
রিকি পন্টিং এদিক থেকে অন্যান্য ব্যাটসম্যান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শর্ট বলে তার দুর্বলতা নেই বললেই চলে। বরঞ্চ তার বিপক্ষে শর্ট বল করার সময় পেসাররা দ্বিতীয়বার ভাবতেন। তার ট্রেডমার্ক শট ছিলো পুল। যখনি তার দিকে শর্ট বল ধেয়ে আসতো, তিনি তার দুর্দান্ত পুল শটে বল সীমানা ছাড়া করতেন সফলতার সাথে। বিশ্ব ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো পুল শট খেলা ব্যাটসম্যান তিনিই।
২
১৯৭৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর, তাসমানিয়ার লন্সেসটোনে গ্রেইম ও লোরেইন পন্টিং দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় রিকি থমাস পন্টিং জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গ্রেইম পন্টিং ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন। কাকা গ্রেগ ক্যাম্পবেল ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেট খেলেছিলেন। তার মা লোরেইনও খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে মাওব্রে ক্রিকেট ক্লাবে অনুশীলন করতেন রিকি। ১১ বছর বয়সে মাওব্রে অনুর্ধ্ব-১২ ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেন। জুনিয়র ক্রিকেটে নজরকাড়া নৈপুণ্য দেখানোর ফলে ১৯৯১ সালে অ্যাডিলেডের অস্ট্রেলিয়ান ইন্সটিটিউট অব স্পোর্টস ক্রিকেট একাডেমিতে ডাক পান তিনি। সেখানকার কোচ রোড মার্শ তার সম্পর্কে বলেন, ১৭ বছর বয়সী রিকি পন্টিংয়ের মতো ব্যাটসম্যান তিনি আর দেখেননি। ১৯৯১ সালে একাডেমিতে শেন ওয়ার্নের সাথে দেখা হয় রিকি পন্টিংয়ের। তার বিখ্যাত ডাকনাম ‘পান্টার’ শেন ওয়ার্নেরই দেওয়া। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে মাত্র ১৭ বছর ৩৩৭ দিন বয়সে শেফিল্ড শিল্ডে তাসমানিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে রিকি পন্টিংয়ের। তাসমানিয়ার সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। আগের রেকর্ডটি ছিলো ডেভিড বুনের। তিনি ১৭ বছর ৩৫১ দিন বয়সে তাসমানিয়ার হয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেছিলেন। এই ডেভিড বুনের সাথেই জুটি বেধে ৫৬ রানের ইনিংস খেলেন পন্টিং।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজের প্রথম শতকের দেখা পান ১৮ বছর ৪০ দিন বয়সে। তাসমানিয়ার সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে শতক হাঁকানোর রেকর্ড গড়েন তিনি। এখানেও তিনি ডেভিড বুনের রেকর্ড ভাঙেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে রান করে ১৯৯৩ সালেই অস্ট্রেলিয়ার দলের ভাবনায় চলে আসেন পন্টিং। সেবার ড্যামিয়েন মার্টিন সুযোগ পান।
৩
১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের শেফিল্ড শিল্ডের প্রথম ম্যাচে কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে শতক হাঁকিয়ে মৌসুম শুরু করেন রিকি পন্টিং। কুইন্সল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারের ক্রিকেট ক্যারিয়ার তখন শেষলগ্নে। ব্যাটসম্যান বোর্ডারের বিকল্প তখনও খুঁজে পায়নি অস্ট্রেলিয়া। তিনি নিজেই পরামর্শ দেন আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রিকি পন্টিংকে দলের সাথে রাখার জন্য।
১৯৯৪ সালের ৪ঠা নভেম্বর ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২১১ রানের ইনিংস খেলে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আগেই ডন ব্রাডম্যানের রেকর্ডে ভাগ বসান পন্টিং। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রিকি পন্টিং একাধারে ৫ম শতক হাঁকিয়েছিলেন। শেফিল্ড শিল্ডে নির্দিষ্ট একটি রাজ্যের বিপক্ষে একাধারে ডন ব্রাডম্যানও সর্বোচ্চ পাঁচটি শতক হাঁকিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রিয় বন্ধু জাস্টিন ল্যাঙ্গারের সাথে রিকি পন্টিংও অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে দলে ছিলেন। একই ড্রেসিংরুমে থেকে দলের অন্যান্য ক্রিকেটারদের চলাফেরা লক্ষ্য করতেন রিকি পন্টিং।
ঘরোয়া ক্রিকেট রানের ফোয়ারা ছোটানোর পর ১৯৯৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ খেলেন। নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চার দেশীয় ওডিআই সিরিজ দিয়ে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় তার পথচলা শুরু হয়। অভিষেক ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ছয় নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ছয় বলে এক রান করেন। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচে ছয়ে ব্যাট করেন রিকি পন্টিং। তৃতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে নিজের পছন্দের ব্যাটিং পজিশন তিনে ব্যাট করতে নেমে ৬২ রানের ইনিংস খেলেন। উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের দলে ছিলেন রিকি পন্টিং। গ্রুপ পর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ংকর বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে হেলমেট না পরে ক্যাপ পরেই ব্যাট করতে নামেন পান্টার। হয়তো জানান দিচ্ছিলেন, তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসারদের মোকাবেলা করতে ভীত নন। অথবা পেসাররা রেগে তাকে শর্ট বল করবে আর তিনি তার ট্রেডমার্ক পুল শট খেলবেন। সবকিছু তার ইচ্ছামতো চলছিলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১১২ বলে ১০২ রানের ইনিংস খেলে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে শতক হাঁকানোর রেকর্ডও গড়েন তিনি।
৪
মাথায় ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরতেও খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি রিকি পন্টিংকে। ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পাওয়ার স্বপ্ন অস্ট্রেলিয়ার সব ক্রিকেটারেরই থাকে। পন্টিংও ব্যতিক্রম নন। তাই হাতে পেয়ে প্রাণভরে গন্ধ শুঁকলেন ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটির। ১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পার্থের পেস বান্ধব উইকেটে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে রিকি পন্টিংয়ের।
অভিষেক ইনিংসে ৯৬ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরেন। মাত্র চার রানের জন্য শতক হাতছাড়ার আক্ষেপ নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছিলো। তিনি এখনও মনে করেন, সেদিন আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে আউট হন। মেলবোর্নে নিজের দ্বিতীয় টেস্ট ইনিংসে খেলেন ৭১ রানের ইনিংস। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট শতক হাঁকানোর জন্য বেছে নেন মর্যাদাপূর্ণ অ্যাশেজ টেস্ট। লিডসে ১৯৯৭ সালের অ্যাশেজে নিজের প্রথম ইনিংসে ২০২ বলে ১২৭ রান করেন।
৫
জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল রিকি পন্টিংয়ের। সতীর্থদের সাথে ড্রেসিংরুমে আড্ডা, সবার সাথে নাইট-আউট। বিয়ার পান করা। এসবের সাথে রিকি পন্টিংও মানিয়ে নেয়। ১৯৯৯ সালের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওডিআই ম্যাচ শেষে সিডনির কিংস ক্রস বারে পান করতে গিয়েছিলেন পন্টিং। সেই রাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পান করে একজনের সাথে বাগবিতণ্ডতায় জড়িয়ে পরেন। শাস্তিস্বরূপ তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
২০০০ সালে রিকি পন্টিংয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয় রিয়ান্নার। এরপর থেকে পন্টিংয়ের জীবনে পরিবর্তন আসা শুরু করে। তার পোশাকআশাক, চলাফেরা সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। ২০০২ সালে রিয়ান্নার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন পন্টিং। তার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসা শুরু করে, যার পুরো কৃতিত্ব তিনি রিয়ান্নাকে দিয়েছেন তিনি।
৬
স্টিভ ওয়াহ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালে নতুন অধিনায়ক খোঁজা শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। বিকল্প পছন্দও ছিলো তাদের হাতে। স্টিভ ওয়াহ অধিনায়ক থাকাকালীন সহ-অধিনায়ক অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং শেন ওয়ার্ন অধিনায়ক হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন। তবে এগারো জন তারকা মাঠে ঠিকঠাকভাবে সামলানোর দায়িত্ব পড়ে রিকি পন্টিংয়ের কাঁধে।
২০০২ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার প্রথম বড় পরীক্ষা ছিলো ২০০৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আগেরবার স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বে শিরোপা জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ঐ আসরে ব্যাট হাতে ৩৯.৩৩ ব্যাটিং গড়ে ৩৫৪ রান করে শিরোপা জয়ে দলকে সাহায্য করেছিলেন। ২০০৩ সালে তার দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অধিনায়কত্ব। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে খবর আসে দলের সেরা বোলার শেন ওয়ার্ন ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ হয়েছেন। এই খবরে স্বাভাবিকভাবে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লেও ভেঙে পড়েননি রিকি পন্টিং। অজেয় দল গড়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে একের পর জয় ছিনিয়ে আনছিল। টানা এগারো ম্যাচ জিতে তার দল অস্ট্রেলিয়া অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো ২০০৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। অধিনায়কত্বের পাশাপাশি ব্যাটসম্যানের দায়িত্বও বেশ ভালোভাবে পালন করেছিলেন। তিনে ব্যাট করে শুরুতে দলের হাল ধরার পর সময়ের সাথে সাথে ঝড়ো ব্যাটিং করে দলকে বড় সংগ্রহ এনে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন।
২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে তার অসাধারণ ব্যাটিংয়ের কাছেই ভারতের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। ফাইনালে জোহানসবার্গে রিকি পন্টিং ১২১ বলে চারটি চার এবং আটটি ছয়ের সাহায্যে ১৪০* রানের ইনিংস খেলেন। প্রথম ৫০ রান করতে তিনি ৭৪ বল খেলেন। বাউন্ডারি ছিলো মাত্র একটি! শেষদিকে ভারতীয় বোলারদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে দলকে ৩৫৯ রানে পুঁজি এনে দেন। ভারত ২৩৪ রানে গুটিয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়া ১২৫ রানের সহজ জয় পায়।
৭
প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে নিজ দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলার। টেস্ট ক্রিকেটই আদি ও আসল ক্রিকেট। কেউ কেউ শতাধিক টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখে থাকেন। এখন পর্যন্ত ৬৬ জন ক্রিকেটার শতাধিক টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে আটজন ব্যাটসম্যান নিজেদের শততম টেস্টে শতক হাঁকিয়ে স্মরণীয় করে রেখেছেন। আটজনের মধ্যে একজন রিকি পন্টিং। তিনি একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে নিজের শততম টেস্টের দুই ইনিংসেই শতক হাঁকিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ২ই জানুয়ারি সিডনিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই ইনিংসেই শতক হাঁকিয়েছেন পন্টিং। প্রথম ইনিংসে ১২০ রানের ইনিংস খেলার পর ম্যাচের শেষ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ২৮৮ রানের জবাবে রিকি ১৫৯ বলে ১৪৩* রানের ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে অকল্পনীয় জয় এনে দেন।
একই বছর বাংলাদেশের বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টে বাংলাদেশের দেওয়া ৩০৭ রানের জবাবে পন্টিংয়ের ২৫৩ বলে ১১৮* রানের ইনিংসের সুবাদে বড় ধরনের লজ্জার হাত থেকে বাঁচে অস্ট্রেলিয়া। রিকি পন্টিং ২০০৫ সালের আগস্ট থেকে ২০০৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চতুর্থ ইনিংসে সাত ইনিংস ব্যাট করে তিনটি শতক হাঁকিয়েছিলেন। চতুর্থ ইনিংসে মোট চারটি শতক হাঁকিয়ে সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তিনি দ্বিতীয় স্থানে আছেন। সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতক হাঁকিয়েছেন ইউনুস খান।
৮
অধিনায়ক হিসাবে রিকি পন্টিং ছিলেন কঠোর। হারার আগে হেরে যাওয়ার মন মানসিকতা নিয়ে তিনি মাঠে নামতেন না। ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত তার চেহারায় গম্ভীর একটা চাপ থাকতো। নিশ্চিত পরাজয়ের ম্যাচের শেষ বল আগপর্যন্তও সতীর্থদের জয়ের জন্য খেলতেই উৎসাহ যোগাতেন তিনি। পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে তিনি সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে। তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ঘরে তোলে অস্ট্রেলিয়া। আগেরবার অ্যাশেজ জয়ী দলকে তার নেতৃত্বে হোয়াইট ওয়াশ করেছিলো অস্ট্রেলিয়া। ২৬শে ডিসেম্বর ২০০৫ সাল থেকে ২রা জানুয়ারি ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া টানা ১৬টি টেস্ট জিতেছে। স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়াও একটানা ১৬টি টেস্ট জিতেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৭৭টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়েছেন রিকি পন্টিং। এর মধ্যে ৪৮টি টেস্টে জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়ক হিসেবে নিজের দেশকে পন্টিংয়ের চেয়ে বেশি টেস্ট জেতানো অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। তিনি ১০৯টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়ে ৫৩টি টেস্টে জয় এনে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বাধীন ২৩০টি ওডিআই ম্যাচে ১৬৫টি জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তার চেয়ে বেশি ওডিআই জেতেনি আর কোনো অধিনায়ক। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও ছিলো রিকি পন্টিংয়ের। তার নেতৃত্বে ২০০৫ সালে ১৭ বছর পর এবং আটটি অ্যাশেজ সিরিজ জয়ের পর অ্যাশেজ সিরিজ হাতছাড়া করেছিলো অস্ট্রেলিয়া। পরপর দুবার ইংল্যান্ডের মাটিতে পরাজিত হয়েছিলো অ্যাশেজে। অস্ট্রেলিয়া ২৪ বছর পর ঘরের মাটিতে অ্যাশেজ হাতছাড়া করেছিলো পন্টিংয়ের নেতৃত্বে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর অধিনায়কের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
৯
ডন ব্রাডম্যানের পর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের এখন পর্যন্ত সেরা ব্যাটসম্যান রিকি পন্টিং। টেস্ট এবং ওডিআই দুই ফরম্যাটেই অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক রিকি। বিশ্ব ক্রিকেটে তার সময়কার সেরা ব্যাটসম্যান কে! এমন প্রশ্নের উত্তরে একেকজন একেক নাম বলবে। কারো চোখে শচীন টেন্ডুলকার, কেউ বলবে ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস তার সময়কার সেরা ব্যাটসম্যান। সেরা ব্যাটসম্যান নির্বাচনে মতানৈক্য থাকলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল ক্রিকেটারের নাম নিঃসন্দেহে রিকি পন্টিং। খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ, দুটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন। তিনি তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৫৬০ ম্যাচের মধ্যে ৩৭৭টি ম্যাচে জয় পেয়েছেন। তার পেছনে আছেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। তিনি ৬৫২ ম্যাচ খেলে ৩৩৬টি তে জয়ের মুখ দেখেছেন। রিকি পন্টিং একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে শতাধিক জয় পেয়েছেন। তিনি ১৬৮টি টেস্ট খেলে ১০৮টিতে জয় পেয়েছেন। ওডিআইতে সবার চেয়ে বেশি ২৬২টি ম্যাচে জয় পেয়েছেন রিকি।
সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার এবং অধিনায়কের তালিকায় তিনি সবার উপরেই থাকবেন। ব্যাটসম্যান হিসেবেও তার সেরা সময়ে টেন্ডুলকার, লারাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৮৭টি টেস্টে ৬৫.৪৩ ব্যাটিং গড়ে ৩১টি শতক এবং ২৯টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৮,১১৪ রান করেছেন। একই সময়ে শচীন টেন্ডুলকার ৭১ ম্যাচে ৫,৮৩৭ রান ও ব্রায়ান লারা ৭৪ ম্যাচে ৭,২১২ রান করেছিলেন।
১০
অধিনায়ক হিসেবে একটানা দুটি অ্যাশেজ পরাজয় এবং ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার প্রভাব তার ব্যাটিংয়েও পড়েছিলো। চারদিকে কানাঘুষো চলছিলো পন্টিংয়ের গড়পড়তা পারফরমেন্স নিয়ে। সারাজীবন বীরের মতো থাকা পন্টিং অবসরের ঘোষণা দিতে বেশি সময় নষ্ট করেননি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ ওডিআই ম্যাচ খেলার পর একই বছরের ডিসেম্বরে নিজের শেষ টেস্টের মধ্য দিয়ে সবধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান রিকি পন্টিং।
তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার দেখে ঈর্ষান্বিত হবে যে কেউ। ১৬৮টি টেস্টে ৫১.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ১৩,৩৭৮ রান। ৪১টি টেস্ট শতক এবং ৬২টি অর্ধশতক। ফিল্ডার হিসেবেও তিনি অনন্য ছিলেন। ব্যাটসম্যানদের আশেপাশে থেকে ১৯৬টি ক্যাচ লুফে নিয়েছেন। ওডিআইতে ৩৭৫ ম্যাচ খেলে ৪২.০৩ ব্যাটিং গড়ে ৩০টি শতক এবং ৮২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ১৩,৭০৪ রান করেছেন। বর্তমানে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের অভিষেক আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৯৮* রানের ইনিংস খেলেছিলেন রিকি পন্টিং, যা এখন পর্যন্ত কোনো অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ব্যক্তিগত অ্যাওয়ার্ডের ঝুলিটাও পরিপূর্ণ রিকি পন্টিংয়ের। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতেছিলেন। ২০০৩, ২০০৪, ২০০৬ সালে বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার। ২০০২ সালে বর্ষসেরা ওডিআই ক্রিকেটার। ২০০৪, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৯ সালে অ্যালান বোর্ডার মেডেল। ২০০৬ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ডও জেতেন রিকি পন্টিং।
ফিচার ইমেজ- Pinterest