ক্রিকেটের পথচলা শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রিকেট বিশ্ব যুগে যুগে বেশ কয়েকজন কিংবদন্তী এবং প্রতিভাবান ক্রিকেটারের দেখা পেয়েছে। তাদের মধ্যে সবদিক বিবেচনায় সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার একজনই। ক্রিকেটপ্রেমীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কে? এর উত্তরে সিংহভাগ ক্রিকেটপ্রেমী দ্বিতীয়বার না ভেবেই স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যানের নাম বলবেন। ১৯৪৮ সালে ডন ব্রাডম্যান যখন ক্রিকেটকে বিদায় জানান, সর্বকালের সেরা হওয়ার দৌড়ে তখন তার সমকক্ষ কেউ ছিলো না। ভারতের কিংবদন্তী ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার যখন বিশ্ব ক্রিকেটে সবধরনের পরিবেশে বোলারদের শাসন করছিলেন, তখন অনেকেই ডন ব্রাডম্যানের একক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভারতীয় জনগণের কাছে ক্রিকেটের ঈশ্বর শচীন রমেশ টেন্ডুলকারে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং ডন ব্রাডম্যানও। ডন ব্রাডম্যান বলেছিলেন, একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে এই ভারতীয় (শচীন টেন্ডুলকার) তাকে তার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি টিভিতে তার ব্যাটিং দেখেছি, তার ব্যাটিং কৌশল আমাকে অভিহিত করেছে।
নিবিড় মনঃসংযোগ, কৌশল, দুর্দান্ত সব ক্রিকেটীয় শট দুজনের মধ্যেই ছিলো। শচীন টেন্ডুলকার নিজেও চাইবেন না দ্য ডনের সাথে তার তুলনা করা হোক। কিন্তু কিছু কিছু ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে শচীন টেন্ডুলকার খুব বেশি পিছিয়ে নেই দ্য ডনের। ভারতের জনগণের কাছে তাদের ক্রিকেটের ঈশ্বরই সর্বকালের সেরা। ভিন্ন সময়ের দুই কিংবদন্তী ক্রিকেটার ডন ব্রাডম্যান এবং শচীন টেন্ডুলকারের মধ্যে তুলনা করতে গেলে যেসব ব্যাপার সামনে আসবে, সেগুলো নিয়েই এই লেখা।
কিংবদন্তীর ব্যাটিং গড়
নয়, নয়, দশমিক নয়, চার সংখ্যাগুলো স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যানের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং গড়। এই চারটি সংখ্যাই যথেষ্ট ব্রাডম্যানকে সবার থেকে এগিয়ে রাখার জন্য। খুব সম্ভবত ডনের অভাবনীয় ব্যাটিং গড় অন্যান্য ক্রিকেটারের কাছে অধরাই থেকে যাবে।
ডন ব্রাডম্যান আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ৮০ ইনিংসে ২৯টি শতক হাঁকিয়েছেন। প্রতি ২.৭৫ ইনিংসে একটি শতক হাঁকিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে শচীন টেন্ডুলকার ২০০ টেস্টে ৫৩.৭৮ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন। তিনি ৩২৯ ইনিংসে ৫১টি শতক হাঁকিয়েছেন। প্রতি ৬.৪৫ টেস্ট ইনিংসে একটি শতক হাঁকিয়েছেন।
অপরিচিত পরিবেশ
শচীন টেন্ডুলকারের অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো সবধরনের পরিবেশে, সবধরনের বোলার এবং সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দাপটের সাথে ব্যাটিং করার। উপমহাদেশের অনেক প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক উইকেটের বাইরে রান করতে হিমশিম খেতো। টেন্ডুলকার সবক’টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষেই সফল ছিলেন। নিজ দেশের মাটির চেয়েও অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে তার ব্যাটিং গড় বেশি! দেশের মাটিতে টেন্ডুলকারের ব্যাটিং গড় ৫২.৬৭। ইংল্যান্ডের মাটিতে ৫৪.৩১ এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৫৩.২০ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন তিনি। যেকোনো দেশের মাটিতে শচীনের সবচেয়ে কম ব্যাটিং গড় হলো জিম্বাবুয়েতে। জিম্বাবুয়েতে চারটি টেস্ট খেলে ৪০.০০ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন। যেকোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে তার সবচেয়ে কম ব্যাটিং গড়ও চল্লিশের উপর। পাকিস্তানের বিপক্ষে সবচেয়ে কম ৪২.২৮ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন শচীন।
সীমাবদ্ধতার কারণে ডন ব্রাডম্যান তার ক্যারিয়ারের ৫২ ম্যাচের সবক’টি ম্যাচ খেলেছেন ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। যার মধ্যে ৩৭টি ম্যাচ খেলেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছেন পাঁচটি করে ম্যাচ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালোছায়া ডন ব্রাডম্যানের উপর না পড়লে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারতো। রান সংখ্যা, শতক সবকিছুই দ্বিগুণ হতে পারতো। ৩০ বছর থেকে ৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত ডন ব্রাডম্যান সহ সেসময়কার অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাননি। যে বয়সে ক্রিকেটাররা তাদের সেরা সময় কাটান, সেই সময়েই ব্রাডম্যান ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। ডন ব্রাডম্যান গড়ে প্রতিবছর ৪.৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। প্রতিবছরে ২.৪টি শতক হাঁকিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার ক্যারিয়ার থেকে সাতটি বছর কেড়ে না নিলে হয়তো ব্রাডম্যানের শতকের সংখ্যা পঞ্চাশের আশেপাশেই থাকতো। গড় হিসাব অনুযায়ী, ৮৭টি টেস্টে ৪৮টি শতক।
শচীন টেন্ডুলকারের ওডিআই রেকর্ড
টেস্ট ক্রিকেটের পাশাপাশি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও টেন্ডুলকার সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। শচীন টেন্ডুলকারের ভক্তরা তাকে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বলার জন্য তার ওডিআই রেকর্ডও তুলে ধরতে পারেন।
লিটল মাস্টার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৬৩ ম্যাচে ৪৯টি শতক এবং ৯৬টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। ওডিআই ফরম্যাটে তার রান সংখ্যা ১৮,৪২৬! একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেন্ডুলকার এমন সব কীর্তি গড়েছেন, যা অনেক বছর পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। ডন ব্রাডম্যান কখনও লিমিটেড ওভারের ম্যাচ খেলেননি। কে জানে! হয়তো দেখা যেত ব্রাডম্যান ওডিআইতেও অকল্পনীয় কোনো কীর্তি গড়তেন।
ভিন্ন যুগ
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আধুনিক যুগের ব্যাটসম্যানরা অনেক সুবিধা পেয়েছেন ব্রাডম্যানের যুগের তুলনায়। মানসম্পন্ন মাঠ এবং পছন্দমত ব্যাটের কারণে আধুনিক যুগে রান করাটা সেসময়ের তুলনায় অনেক সহজ। ডন ব্রাডম্যানের সময় ব্যাটিং পিচের পরিচর্যা বর্তমানের মতো হতো না। স্যাঁতস্যাঁতে পিচেও ব্যাট করতে হতো সেসময়।
আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের সুরক্ষার জন্য উন্নতমানের গার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্রাডম্যানের যুগে হেলমেটও ছিলো না। কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজে হেলমেটের অভাব ঠিকই টের পেয়েছিলেন ব্রাডম্যান। হেলমেট ছাড়া হুক এবং পুল শট খেলা বিপদজনক ছিলো।
আধুনিক যুগে হেলমেট ব্যবহারের কারণে ব্যাটসম্যানররা নির্ভয়ে হুক এবং পুল শট খেলছে। আধুনিক যুগে ডন ব্রাডম্যানের ব্যাটিং গড় কততে গিয়ে থামতো কিংবা হেলমেট ছাড়া আনকাভারড পিচে টেন্ডুলকার কত রান করতেন, ক্যারিয়ার শেষে দুটোর একটিও জানার সুযোগ নেই।
ম্যাচ সংখ্যা এবং জাহাজ ও উড়োজাহাজের পার্থক্য
ভারতের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার ম্যাচ সংখ্যা এবং রান সংখ্যার দিক দিয়ে স্যার ডন ব্রাডম্যানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছেন। শচীন তার ক্যারিয়ারে ৯৫৭টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলে ৫০,১৯২ রান করেছেন, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছেন ৬৩৪ ম্যাচ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০টি শতকের সাহায্যে ৩৪,৩৫৭ রান করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সাত বছর হারানো ডন ব্রাডম্যান ২৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন। টেন্ডুলকারের ম্যাচ সংখ্যার তুলনায় ২৪.৪৫ শতাংশ ম্যাচ খেলেছেন। ২৩৪ ম্যাচে ২৮,০৬৭ রান করেছেন ব্রাডম্যান। টেন্ডুলকারের রান সংখ্যার তুলনায় যা ৫৫.৯২ শতাংশ। ডন ব্রাডম্যানের যুগে ক্রিকেটাররা একদেশ থেকে অন্যদেশে সমুদ্রে জাহাজের মাধ্যমে যাতায়াত করতেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজ খেলার জন্য ছয় সপ্তাহ সমুদ্রে কাটাতে হতো ব্রাডম্যানের। ফলে বছরে খুব বেশি প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাননি তিনি। বর্তমানে উড়োজাহাজে চড়ে ক্রিকেটাররা একদেশ থেকে অন্যদেশে পাড়ি জমান কয়েক ঘন্টা কিংবা কয়েকদিনের মধ্যেই।
বড় শতক হাঁকানোর ক্ষমতা
বড় ইনিংস খেলার ক্ষেত্রে ডন ব্রাডম্যান অতুলনীয়। টেস্ট ক্রিকেটে তার ২৯টি সেঞ্চুরির মধ্যে ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি এবং দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও তিনি ৩৭টি ডাবল সেঞ্চুরি এবং ৪টি ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। ১৯৩০ সালে কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে তার অপরাজিত ৪৫২* রানের ইনিংসটি এখনও কোনো অজি ব্যাটসম্যানের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস।
অন্যদিকে শচীন টেন্ডুলকার তার ৫১টি টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে মাত্র ছয়টিকে ডাবল সেঞ্চুরিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। এছাড়া একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অনবদ্য ২০০* রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
শক্তিশালী প্রতিপক্ষ
ডন ব্রাডম্যান তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ম্যাচ খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ৫২ ম্যাচের মধ্যে ৩৭টি খেলেছেন শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেসময়ে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডই বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলত। দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেও তখনও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের গোছাতে পারেনি। শচীন টেন্ডুলকার তুলনামূলক দুর্বল দল বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আটটি শতক হাঁকিয়েছেন মাত্র ১৬ ম্যাচে, যা ডন ব্রাডম্যানের ভক্তদের প্রথমেই চোখে পড়বে। টেন্ডুলকার তার যুগে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং শ্রীলঙ্কান দলের দুর্দান্ত সব বোলারদের বিপক্ষেও রান করেছেন।
ফার্স্টক্লাস রেকর্ড
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের বাইরে শচীন টেন্ডুলকার বেশিরভাগ সময় ওডিআই এবং টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট খেলতেন। আর ডন ব্রাডম্যান অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য দল এবং ইংলিশ কাউন্টির বোলারদের তুলোধোনা করতেন। ব্রাডম্যান ২৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৯৫.৯৪ ব্যাটিং গড়ে ২৮,০৬৭ রান করেছেন, শতক হাঁকিয়েছেন ১১৭টি। অন্যদিকে শচীন টেন্ডুলকার ৩১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৮১টি শতক হাঁকিয়েছেন। ৫৭.৮৪ ব্যাটিং গড়ে ২৫,৩৯৬ রান করেছেন। টেন্ডুলকার তার ৩১০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের মধ্যে ২০০টি খেলেছেন আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে। অন্যদিকে ডন ব্রাডম্যান ২৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৫২ ম্যাচ খেলেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দুজনের তুলনা করাটা বেশ কঠিন।
ভিন্ন যুগের দুই কিংবদন্তী ক্রিকেটার
ভারতীয় জনগণের কাছে শচীন টেন্ডুলকার তাদের ক্রিকেটের ঈশ্বর। অস্ট্রেলিয়ায়ও ডন ব্রাডম্যানের সম্মান কোনো অংশে কম নয়। ক্রিকেটপাগল জাতি ভারতীয়দের কাছে শচীন রমেশ টেন্ডুলকারই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের ৩৪ হাজার রানও তার পক্ষে কথা বলবে। তবে শচীন নিজেই ইতস্তত বোধ করবেন ডন ব্রাডম্যানের সাথে নিজের তুলনা দেখে। ডন ব্রাডম্যান এমন সব কীর্তি গড়ে গেছেন, যার জন্য তিনি সব ব্যাটসম্যানেরই আদর্শ হয়ে থাকবেন ক্রিকেটের শেষলগ্ন পর্যন্ত।
ফিচার ইমেজ – Getty Images, The CEO Magazine