ইংল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার সুবাদে স্কটল্যান্ডে ক্রিকেটের আনাগোনা বহু বছর আগে থেকেই। স্কটল্যান্ডের মাটিতে সর্বপ্রথম ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৭৮৫ সালে। দল হিসেবে স্কটল্যান্ড সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ ম্যাচ খেলে ১৮৬৫ সালে। এরপর থেকে নিয়মিত ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল এবং বিভিন্ন সফরকারী দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলে তারা। কিন্তু কখনোই দল হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। ১৯৯৪ সালে আইসিসির সহযোগী দেশের মর্যাদা লাভ করে তারা।
স্কটল্যান্ড তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের ঐ আসরে বাংলাদেশও প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে এবং বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম জয় পায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। স্কটল্যান্ড ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ খেলার পর পরবর্তী আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলো ২০০৬ সালে। এরপর থেকে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বিপক্ষে খুব বেশি ওয়ানডে খেলার সুযোগ না পেলেও সহযোগী দেশের বিপক্ষে নিয়মিত ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে তারা। এখন পর্যন্ত ১০৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে ৩৮ ম্যাচে জয়লাভ করেছে দেশটি।
স্কটল্যান্ড নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় জয় পেয়েছে তাদের খেলা শেষ ওয়ানডে ম্যাচে। এডিনবরোতে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছিলো স্কটিশরা। এরপর আর কোনো ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি তারা। দল হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেটে প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও তাদের দলে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের আবির্ভাব ঘটেছিল। এমন দুই প্রতিভাবান স্কটিশ ক্রিকেটারকে নিয়ে সাজানো আজকের এই লেখা।
কাইল কোয়েৎজার
স্কটল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করেছেন তাদের অধিনায়ক কাইল কোয়েৎজার। তিনি স্কটল্যান্ডের হয়ে ৫০টি ওয়ানডে খেলে চারটি শতক এবং ১২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪২.৮০ ব্যাটিং গড়ে ১,৯৬৯ রান করেছেন। এছাড়া ৪৫টি টি-টোয়েন্টিতে ২৫.২৪ ব্যাটিং গড়ে ১,০৩৫ রান সংগ্রহ করেছেন। স্কটল্যান্ডের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে সহস্রাধিক রান সংগ্রহ করেছেন তিনি।
কাইল কোয়েৎজার, নাম শুনে মনে হয় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার। কিন্তু তার জন্ম হয়েছিলো স্কটল্যান্ডের এবারডিনে। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করে। ক্রিকেটে তার পথচলা শুরু হয় বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। তিনি অনুর্ধ্ব-১৫, অনুর্ধ্ব-১৭ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া ২০০৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও স্কটল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালেই ডারহামের হয়ে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে কোয়েৎজারের। অভিষেক ম্যাচে তিনি ৬৭ রানের ইনিংস খেলেন।
তার লিস্ট-এ ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিলো ২০০৩ সালে। ঐ বছরেই স্কটল্যান্ডের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলেন তিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে অস্বীকৃত একটি ওয়ানডে ম্যাচের মধ্য দিয়ে তার স্কটল্যান্ডের হয়ে যাত্রা শুরু হয়। এরপর আইসিসি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের সেমিফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ১৩৩ রানের ইনিংস খেলে আলোচনায় আসেন কোয়েৎজার। কিন্তু ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে ছন্দে না থাকার কারণে স্কটল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হতে দেরি হয়েছিলো।
তিনি স্কটল্যান্ডের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন ২০০৮ সালের ২রা আগস্টে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মধ্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। এরপর একই মাসের ১৮ তারিখে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন কোয়েৎজার। অভিষেক ওয়ানডেতে শূন্য রানে ফিরে গেলেও পরবর্তী সাতটি ওয়ানডেতে দুবার ৮৯ রানের ইনিংস সহ মোট চারটি অর্ধশতক হাঁকান তিনি। আইসিসির সহযোগী দেশ হওয়ার কারণে স্কটল্যান্ড খুব বেশি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেতো না। এজন্য কোয়েৎজারকে তার ক্যারিয়ারের প্রথম শতকের দেখা পেতে প্রায় পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়ে তিনি মাত্র ১১টি ওয়ানডে খেলেছিলেন। নিজের ১২তম ওয়ানডে ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে শতক হাঁকান তিনি। আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৩৩ রানের ইনিংস খেলার পরেও দলকে জয় এনে দিতে পারেননি তিনি।
কাইল কোয়েৎজার ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে নেলসনে ১৫৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তিনি ১৩৪ বলে ১৭টি চার এবং ৪টি ছয়ের মারে ১৫৬ রান করেছিলেন, যা বিশ্বকাপে সহযোগী দেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। যদিও শেষপর্যন্ত তার ইনিংসটি সফলতার মুখ দেখেনি। ৩১৮ রান সংগ্রহ করার পরেও বাংলাদেশের কাছে ৬ উইকেটে পরাজিত হয়েছিলো স্কটল্যান্ড।
তিনি পূর্ণ মেয়াদে স্কটল্যান্ডের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ২০১৭ সাল থেকে। তার নেতৃত্বে প্রথম ম্যাচেই জিম্বাবুয়েকে হারায় স্কটল্যান্ড। অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তার ১০১ বলে খেলা ১০৯ রানের ইনিংসের উপর ভর করে জিম্বাবুয়েকে ২৬ রানে পরাজিত করেছিলো স্কটল্যান্ড, যা টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বিপক্ষে তাদের প্রথম ওয়ানডে জয়ের রেকর্ড ছিলো। নিজেদের সর্বশেষ ওয়ানডে ম্যাচে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছিলো স্কটল্যান্ড। ঐ ম্যাচেও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কোয়েৎজার। ব্যাট হাতেও শুভসূচনা এনে দিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ৪৯ বলে ৫৮ রানের ইনিংস খেলে শুরু থেকেই দলকে এগিয়ে রেখেছিলেন অধিনায়ক।
তার খেলা ৫০টি ওয়ানডে ম্যাচের মধ্যে স্কটল্যান্ড ১৯টি ম্যাচে জয় পেয়েছে। এই ১৯ ম্যাচে তিনি দুটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৭.৫২ ব্যাটিং গড়ে ৯৭৮ রান সংগ্রহ করেছেন। শুরুতে তার ব্যাট হাসলে হাসে স্কটল্যান্ড। তার ভালো সূচনার উপরই ভর করে স্কটল্যান্ডের দৌড় কতদূর।
নিয়মিত ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেলে তার ক্যারিয়ার আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারতো। তখন পরিসংখ্যানগুলো আরও তরতাজা দেখাতো। সহযোগী দেশের ক্রিকেটার হওয়ার কারণে খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান না। তবে যখনি সুযোগ পান, দুই হাতেই কাজে লাগান স্কটল্যান্ডের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক কাইল কোয়েৎজার।
ক্যালাম ম্যাকলিওড
স্কটল্যান্ডের টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান ক্যালাম ম্যাকলিওড এখন পর্যন্ত ৫৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। এই ৫৭ ম্যাচে তিনি সাতটি শতক হাঁকিয়েছেন। এর মধ্যে ১৭৫, ১৫৭*, ১৫৪ এবং ১৪০* রানের ইনিংস খেলেছেন। সহযোগী দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি শতক এবং দেড় শতকের ইনিংসের মালিক।
ম্যাকলিওড ৫৭ ম্যাচে সাতটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৭.৮১ ব্যাটিং গড়ে ১,৮৫৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। মাত্র ৫৭ ইনিংসে সাতবার শতক হাঁকালেও তার ব্যাটিং গড় চল্লিশের কম হওয়ার কারণ তিনি আটবার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরেছেন। তবে যেসব ম্যাচে বড় ইনিংস খেলেছেন সব ম্যাচেই স্কটল্যান্ড জয় পেয়েছে। তার খেলা সাতটি শতকের একটিও বিফলে যায়নি। তার সাতটি শতকের মধ্যে সবকটিতে জয় পেয়েছে স্কটল্যান্ড এবং ছয়টি অর্ধশত রানের ইনিংসের মধ্যে তিনটিতে জয় পেয়েছে স্কটল্যান্ড। কাকতালীয়ভাবে তিনি যে তিন ম্যাচে অর্ধশত রানের ইনিংস খেলেছেন এবং স্কটল্যান্ড পরাজিত হয়েছে, সব ম্যাচেই তিনি ৫৮ রান করে সাজঘরে ফিরেছেন।
তার খেলা ৫৭ ম্যাচের মধ্যে স্কটল্যান্ড ২৩টি ম্যাচে জয় পেয়েছে। সর্বশেষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পাওয়া ম্যাচেও তিনি জয়ের নায়ক ছিলেন। তার মাত্র ৯৪ বলে খেলা অপরাজিত ১৪০ রানের ইনিংসের উপর ভর করেই স্কটল্যান্ড বড় সংগ্রহ দাঁড় করিয়েছিল। ওয়ানডেতে স্কটল্যান্ডের জয় পাওয়া ম্যাচগুলোতে তিনি ৭৫.২২ ব্যাটিং গড়ে ১,৩৫৪ রান সংগ্রহ করেছেন। পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যায়, তিনি যখন বড় ইনিংস খেলেন তখন স্কটল্যান্ড জয়। গতবছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১৪০ রানের ইনিংস খেলার আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১৫৭ রানের ইনিংস খেলে স্কটল্যান্ড দলে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন।
ক্যালাম ম্যাকলিওড ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জন্মগ্রহণ করেন। ক্রিকেটে তার পথচলা শুরু হয় বয়সভিত্তিক ক্রিকেট দিয়ে। তিনি অনূর্ধ্ব-১২ ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। এরপর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সব ধাপ পেরিয়ে ২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলার পর স্কটল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পেতে তার বেশি সময় লাগেনি। ২০০৭ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের মধ্য দিয়ে তিনি স্কটল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পান। এর আগে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলেছিলেন তিনি।
স্কটল্যান্ডের হয়ে তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ খেলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ওয়ানডে ম্যাচে, যা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট। এই একই ম্যাচে অভিষেক ঘটেছিল কাইল কোয়েৎজারেরও। নিজের অভিষেক ম্যাচে ম্যাকলিওড নয় নাম্বারে ব্যাটিং করেছিলেন। নয় নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে তিনি ১১ বলে অপরাজিত ১০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপর পরবর্তী দুই ম্যাচেও তিনি টেল-এন্ডারে ব্যাটিং করেছিলেন। তিনি যে টেল-এন্ডার ব্যাটসম্যান নন, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি স্কটল্যান্ডের পর। ঐ তিন ইনিংসের পর তাকে টপ-অর্ডারে ব্যাট করতে পাঠানো হয় এবং তিনি এখন পর্যন্ত সফলতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
ক্যালাম ম্যাকলিওড এবং কাইল কোয়েৎজার স্কটল্যান্ডের ক্রিকেটার হলেও তাদের ব্যাটিং প্রতিভা অতুলনীয়। আত্মপ্রকাশের পর থেকেই তারা জানান দিচ্ছেন, কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের ব্যাটসম্যানদের চেয়ে তাদের সামর্থ্য কম নয়। যেখানে বিশ্বের নামীদামী ব্যাটসম্যানদেরকে নিয়মিত নাস্তানাবুদ করছেন আফগান স্পিনাররা, সেখানে গতবছরেই ক্যালাম ম্যাকলিওড দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে স্কটল্যান্ডকে জয় এনে দিয়েছিলেন। সুযোগ পেলে যে তারা বিশ্ব ক্রিকেটকে আরও দুর্দান্ত সব ইনিংস উপহার দিবেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।