সাকিবের হাতের আঙ্গুল থেকে প্রায় ৬০ মিলিগ্রামের মতো পুঁজ বের করেছে ডাক্তার। আর থাকতে না পেরে এশিয়া কাপের আসর থেকে বিদায় নিয়ে ফিরেছেন তিনি। ভারত যখন এশিয়া কাপের ট্রফি নিয়ে উল্লাস করছে, সাকিব তখন রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। এতটুকু নিশ্চিত, তিনি বাংলাদেশ বনাম ভারতের এই ফাইনাল ম্যাচ দেখা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। শিরোপাটা যদি মাশরাফির হাতে উঠতো, হাসপাতালের বিছানা থেকেও হয়তো উত্তেজনায় নেচে উঠতেন সাকিব। ঠিক একইভাবে, হাজার মাইল দূরে থেকেও বুঝতে পারছেন ড্রেসিংরুমের অবস্থা। হয়তো সতীর্থদের মতো তার চোখেও জল।
তামিম ইকবাল ভাঙা আঙ্গুল নিয়েই এক হাতে মাঠে নেমে গিয়েছিলেন। একটি বলে মুশফিককে সঙ্গ দিয়ে দিনশেষে জয়ের স্বাদ নিয়েছিলেন এই টুর্নামেন্টেই। সে রাতের পরদিনই ঢাকা ফেরেন দেশসেরা এই ওপেনার। ফাইনাল ম্যাচে শেষ বলের হার হয়তো তাকেও পোড়াচ্ছে। হয়তো সারারাত তিনিও সতীর্থদের মতোই কাতরাবেন, চোখ লাল করে সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেবেন। হয়তো হতচ্ছাড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করবেন, ইশ! হাতটা ঠিক থাকলে যদি তার ব্যাটে আরও ২০টা বেশি রান আসতো আজকের দিনে! তাহলে ম্যাচটা ঠিকই জিতে যেতো বাংলাদেশ।
ঠিক এই রাতেই হয়তো মাশরাফি-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের জন্য গলার জোর বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সালমা খাতুন-জাহানারা আলমরা। যে বাঘিনীরা মাসখানেক আগেই ভারত নারী দলকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছিলেন। যে বাঘিনীদের জয়ে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুম উল্লাসে কাঁপিয়েছিলো ছেলেদের দল। সেই ঝড়তোলা উদযাপনের প্রতিদান দিতে হয়তো মেয়েরাও আজ অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু নিয়তির লেখন, উদযাপনটা বাঁচিয়ে রাখতে হলো; অন্য কোন দিনের জন্য।
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম শনিবার দিবাগত রাতে হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ইডেন গার্ডেন, এক টুকরো চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম; এক টুকরো মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে হারিয়ে যে টুর্নামেন্টের শিরোপাজয়ী ম্যাচটি খেলতে নেমেছিলো বাংলাদেশ ও ভারত।
দিনশেষে হাসিটা হেসেছে রোহিত শর্মার ভারত। শেষ বলের জয়টা তাদেরকে এনে দিয়েছে এই টুর্নামেন্টের আরও একটি শিরোপা। অন্যদিকে, আরও একবার স্বপ্নকে মাটি দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বলা যায়, দুবাইয়ের তপ্ত মরুভূমির বুকে পুঁতে ফেলতে হয়েছে।
তৃতীয়বারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে গিয়ে ছিটকে গেল বাংলাদেশ। হারলো ৩ উইকেটে।
১.
ম্যাচের আগের দিন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ট্রফি নিয়ে। অধিনায়ক হিসেবে এশিয়া কাপের ট্রফিটা কতটা তার জন্য জরুরী? মাশরাফি জানিয়েছিলেন, তিনি নিজেকে এতোটা সস্তা কখনোই ভাবেন না যে একটা ট্রফি দিয়ে নিজের বিচার করবেন।
তবে ট্রফি তিনি চেয়েছেন। চেয়েছেন দলের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। মাশরাফি বলেছেন,
“দলের জন্য একটা ট্রফি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। আজ হোক বা কাল, কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে বাংলাদেশ একটা ট্রফি জিতবে ইনশাআল্লাহ। ট্রফির প্রয়োজন এইজন্য যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যারা ক্রিকেটে আসবে বা দলেও যারা তরুণ ক্রিকেটার আছে, যারা বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলছে তাদের অনুপ্রাণিত করতে। সেদিক থেকে একটা ট্রফি দরকার। সেটা এখনই বা আজকালের মধ্যেই লাগবে এমনটা একেবারেই নয়। তবে ব্যক্তি মাশরাফিকে আপনি ট্রফি দিয়ে বিচার করবেন সেটা হবে না। আমি কখনই নিজেকে এতোটা সস্তা ভাবিনি।”
২০১২ সাল থেকে এশিয়া কাপে ভালো করে যাচ্ছে বাংলাদেশ দল। ২০১৮ পর্যন্ত তিনবার ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনবারই হার।
তবে দলের অবস্থা এবার একেবারেই অন্যরকম ছিলো। সাকিব-তামিমের ইনজুরির কারণে দেশে ফিরে যাওয়ার পাশাপাশি পাঁজরের তীব্র ব্যথা নিয়ে খেলে গেছেন মুশফিক। অন্যদিকে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮ ফুট লাফ দিয়ে ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙ্গুলে ব্যথা নিয়েও খেলেছেন মাশরাফি। এমনকি দুশ্চিন্তা যেন না বাড়ে, তাই এখন পর্যন্ত আঙ্গুলের স্ক্যানও করেননি তিনি।
মাশরাফি নিজে ও দলের বাকি জ্যেষ্ঠরা, সবাই ছোটদের সমর্থন দিয়ে গেছেন সমানে। স্রেফ একটি শিরোপা, আর কতগুলো আহত বাঘ। কিন্তু হলো না, হার এলো বুক জুড়ে।
২.
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফাইনালের আগেই মাশরাফি বলে দিয়েছিলেন, ফাইনালে বাংলাদেশ ‘আউট অব দ্য বক্স’ কিছু করবে। তারই ধারাবাহিকতায় টস হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিংয়ে লিটন কুমার দাসের সঙ্গে ব্যাট করতে দেখা গেল লোয়ার অর্ডারের মেহেদী হাসান মিরাজকে!
কিন্তু কৌশলটা খারাপ হয়নি একেবারে। ২০.৫ ওভারে দুজনে মিলে গড়েছেন ১২০ রানের জুটি। মিরাজ ৩২ রানে আউট হলেও, লিটন কুমার দাস পেয়েছেন নিজের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন। ১২১ রানের ইনিংস খেলার পথে কুলদ্বীপ যাদবের বলে মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হলেন লিটন, যার স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক তুমুলে। তবে আর কিছু না হোক, ম্যাচসেরার পুরস্কারটা ঠিকই বগলদাবা করেছেন লিটন।
বাংলাদেশের ওপেনিং জুটির ঝড়ো ব্যাটিং দেখে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলো প্রতিপক্ষ ভারতও। সেই কথা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছেন দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তিনি বলেছেন,
“বাংলাদেশ শুরুতে অসাধারণ ব্যাট করেছে। কিন্তু আমরা জানতাম, বল যত পুরনো হবে আমরা এগিয়ে যাবো। আমাদের দারুণ সব স্পিনাররা সেটা করেও দেখিয়েছে। বাংলাদেশ পুরো টুর্নামেন্টেই ভালো খেলেছে, আজও খেলেছে।”
নির্ধারিত ৫০ ওভারে শেষ পর্যন্ত ২২২ রানে থেমেছে বাংলাদেশ। ২১ ওভারে ১২০ রান, সেখান থেকে ৫০ ওভারে ২২২ রানে অলআউট। পুরো দায়ভারই যাবে মিডল অর্ডারের ব্যর্থতার দিকে। ম্যাচের স্কোরবোর্ডের দিকে ভালো করে তাকালে মনে হয়, হয়তো অন্তত ২০-২৫ রান কম করেছে বাংলাদেশ।
শুধু মিডল অর্ডার নয়, ওপেনিং জুটির বিদায়ের পর টপ অর্ডারের বাকিরাও দাঁড়াতে পারেননি। বাকি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কেবল সৌম্য সরকার ৩৩ রানে আউট হয়েছেন। আর কেউ দুই অঙ্কের রানও ছুঁতে পারেনি। ভারতের কুলদ্বীপ যাদব তিনটি ও কেদার যাদব দুটি উইকেট নিয়েছেন।
৩.
বল হাতে শুরু থেকেই ভারতকে চাপে রাখার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। মাশরাফির অসাধারণ নেতৃত্বগুণে ২২২ রান করতে ভারতকে খেলতে হয়েছে পুরো ৫০ ওভার। যে কারণে আরও একটি বেঙ্গালুরুর স্বাদ পেতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে, হারতে হয়েছে শেষ বলে।
পুরো ইনিংসজুড়ে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত। কিন্তু শেষ ৩ ওভারে যে খেলাটা হয়েছে তা বোধহয় আরও অনেকদিন মনে রাখবে ক্রিকেটপ্রেমীরা। যেখানে ভারত জেতেনি, বাংলাদেশ জেতেনি। জিতেছে কেবলই ক্রিকেট।
শেষ ৩ ওভারে জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন ছিল ১৩ রান। তখনও হাতে ৫ উইকেট। এমন সময় রবীন্দ্র জাদেজা ও মুস্তাফিজুর রহমান ভুবনেশ্বর কুমারকে ফিরিয়ে ম্যাচের ভোল পাল্টে দিলেন রুবেল হোসেন।
৫০তম ওভারে যখন মাহমুদউল্লাহ বল হাতে নিলেন, তখন ভারতের জিততে প্রয়োজন ৬ রান। ঠিক শেষ বলে ম্যাচটা বের করে নিয়ে গেলেন কেদার যাদব, যিনি কিনা আগেই চোট পেয়ে সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন।
ফলাফল, সপ্তমবারের মতো এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে নিলো ভারত। অন্যদিকে, তৃতীয়বারের মতো রানার্সআপ হয়ে চোখের জল মুছলো ‘মাশরাফি অ্যান্ড কোং’।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মাশরাফি কেবল বললেন,
“আমরা হৃদয় দিয়ে ম্যাচটা খেলেছিলাম। শেষ বল পর্যন্ত খেলেছিলাম। তবে হ্যাঁ, বোলিং ও ব্যাটিং দুই জায়গাতেই আমাদের আজ ভুল ছিলো। আপনি যদি আমাদের আগের ম্যাচগুলো দেখেন, আমরা ২৪০ এর উপর করা রানের ম্যাচগুলো জিতেছি। আজ আমাদের ব্যাটসম্যানদের কাছে সেটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু হয়নি। তবে শেষদিকে আমাদের বোলাররা অনেক ভালো করেছে। মুস্তাফিজকে শেষ ওভারে আনতাম। কিন্তু ভারত যেভাবে রান করছিলো, মুস্তাফিজকে ৪৯তম ওভারে নিয়ে আসি রান চেক দেওয়ার জন্য। এই অবস্থায় স্পিনার আনতে চাইনি।”
আরও একবার জয়ের খুব কাছ থেকে ফেরার কষ্ট হয়তো পোড়াবে বাংলাদেশকে। তবে ইনজুরি আর অন্যতম সেরা দুই ক্রিকেটারকে ছাড়া এমন লড়াই করার ম্যাচে হয়তো নিন্দুকরাও ভালোবাসবে মাশরাফিদের, গর্ব করবে তাদের নিয়ে। যেখানে পরতে পরতে লুকিয়ে থাকবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর আশীর্বাদের আকুতি।
Featured Image Credit : ISHARA S. KODIKARA/AFP/Getty Images