কঠোর পেশাদারিত্বের যুগে খেলাধুলা এখন আর শুধু সময় কাটানোর মাধ্যম নেই, বরং খেলাধুলা আজকাল জাতিগত বিদ্বেষের পর্যায়েও চলে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু খুব বেশিদিন আগেও এমন ছিল না। অনেক খেলোয়াড়ই খেলতেন শখের বশে। অনেকে তো আবার একসাথে দুটি খেলাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও খেলে ফেলেছেন। অনেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে না খেললেও দুটি ভিন্ন ভিন্ন খেলার শীর্ষ পর্যায়ে বেশ সফলতার সাথেই খেলেছেন। মূলত ব্রিটিশ খেলোয়াড়রাই ক্রিকেট-ফুটবল একসাথে খেলতেন। ইংল্যান্ডে ক্রিকেট-ফুটবল দু’টি খেলাই জনপ্রিয়। তাদের শক্তিশালী প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট আছে, আছে ঈর্ষণীয় ফুটবল লীগ। ভিন্ন ভিন্ন খেলাতে সফল কিছু মানুষের কথাই বলবো আজ।
ডেনিস কম্পটন
ক্রিকেট ফুটবল উভয় খেলাতেই সফল এমন খেলোয়াড়দের কথা আসলে প্রথমেই ডেনিস কম্পটনের কথা আসবেই। মিডলসেক্সের হয়ে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৫১৫ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৫১.৮৫ গড়ে ৩৮,৯৪২ রান আর ১২৩ সেঞ্চুরি তার ক্রিকেটের সাফল্যের কথা বলার জন্য পর্যাপ্ত। এর সাথে যোগ করুন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ৭৮ টেস্টে ৫০.০৬ গড়ে ১৭ সেঞ্চুরিতে করা ৫,৮০৭ রান। ব্যাটিং এর সাথে বামহাতি চায়নাম্যান বোলার হিসেবে বোলিংটাও খারাপ করতেন না। ৩২ গড়ে ৬২২ উইকেট আর ১৯ বার ৫ উইকেট তার অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের প্রমাণ। টেস্ট ক্রিকেটেও রয়েছে তার ২৫ উইকেট আর একবার ৫ উইকেট পাবার কীর্তি। ২০০৯ সালে আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা করে নেন কম্পটন। এছাড়াও লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তার নামে আলাদা একটি স্ট্যান্ডই আছে।
এ তো গেল তার ক্রিকেট কীর্তির কথা, এর সাথে যোগ করুন তার আর্সেনাল ক্যারিয়ার। ১৯৩৬ সালে আর্সেনালে তার অভিষেক হয় উইঙ্গার হিসেবে। ১৯৪৮ সালে জেতেন লীগ আর ১৯৫০ সালে এফএ কাপ। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে কোনো অফিসিয়াল ম্যাচ না খেললেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইংল্যান্ড এর হয়ে ১২টি আনঅফিশিয়াল ম্যাচ খেলেছেন। চার্লটন এথলেটিক এর গোলকিপারের সাথে সংঘর্ষে হাঁটুর ইনজুরি তার ফুটবল ক্যারিয়ার বাড়তে না দিলেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫০ গড়ে রান করা এবং ইংলিশ লীগ আর এফএ কাপ জেতার রেকর্ড হিংসা করার মতোই বটে।
চার্লস বার্গাস ফ্রাই (সিবি ফ্রাই)
সিবি ফ্রাই একসাথে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি, অ্যাথলেটিক সবগুলোই খেলতেন, অনেকটা আমাদের দেশের স্কুল লেভেলের সেরা খেলোয়াড়দের মত। তবে মূলত ক্রিকেটের জন্যই তিনি বেশি বিখ্যাত। বেশ ধনী পরিবারে জন্মে নেয়া ফ্রাই-এর ক্রিকেটের শুরু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলা থেকেই। ১৮৯৪ থেকে ১৯০৮ সাল খেলেছেন সাসেক্সের হয়ে। এরপর ১৯২১ সাল পর্যন্ত হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। ৩৯৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে তার আছে ৫০ গড়ে ৩০,৮৮৬ রান, রয়েছে ৯৬টি সেঞ্চুরি। জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন ২৬টি টেস্ট; ৩২ গড়ে ১২২৩ রান, রয়েছে ২টি সেঞ্চুরি।
ক্রিকেটের মতো ফুটবলে সফল না হলেও সাউদাম্পটনের হয়ে ১৬টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এর মধ্যে আছে একটি এফএ কাপের ফাইনাল। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়েও একটি ম্যাচ খেলেছেন। ডিফেন্ডার হিসেবে খেলায় তার কোনো গোল নেই।
ফ্রাই ১৮৯২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিক্স দলেও খেলা শুরু করেন। সে বছরেই তিনি লং জাম্পে ব্রিটিশ রেকর্ড ভেঙ্গে দেন। ঠিক এক বছর পর তিনি লং জাম্পের বিশ্বরেকর্ডও করেন, যদিও সেটা ছিল যৌথভাবে। তার এই রেকর্ড অবশ্য এক বছরের বেশি টেকেনি। এছাড়াও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে রাগবি খেলেছেন তিনি বেশ কিছুদিন।
অ্যান্ড্রু ডাকেট
লন্ডনে জন্ম নেয়া ডাকেট ক্রিকেট খেলেছেন সারে কাউন্টির হয়ে, আর ফুটবল খেলেছেন আর্সেনাল, ফুলহাম ও অ্যাস্টন ভিলার হয়ে। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ক্রিকেট-ফুটবল দুটোই।
১৯০৬ সালে ওভালে গ্রাউন্ড স্টাফ হিসেবে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরেই খেলা শুরু করেন ক্রিকেট। সে সময়ের কিংবদন্তী টম হেওয়ার্ড, জ্যাক হবসদের সাথে একইসাথে খেলতেন তিনি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলেছেন ৪২৯ ম্যাচ। ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩৮ গড়ে রান করেছেন ২৩,৩৭৩ আর সেঞ্চুরি রয়েছে ৫২টি। একমাত্র খেলা টেস্ট যদিও তার মোটেও ভালো যায় নি, দুই ইনিংসে মাত্র ৫ রান করেন।
ক্রিকেটের মতোই ফুটবল ক্যারিয়ারটাও বেশ সমৃদ্ধ ডাকেটের। আর্সেনালের হয়ে ১৭৫ ম্যাচে তার রয়েছে ১৯ গোল, অ্যাস্টন ভিলার হয়ে ৭৪ ম্যাচে ৪ গোল। তবে ফুলহামের হয়ে ৬৪ ম্যাচে কোনো গোল পাননি। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ৬ ম্যাচে পেয়েছেন ১ গোল। ফুলহামের কোচ হিসেবেও কাটিয়েছেন দু’বছর, যদিও কোনো সাফল্য পাননি, বরং লিগে ১২তম আর ১৯তম হতে হয় তার দলকে। আর্সেনালের ওয়েবসাইটে তাদের সেরা ৫০ জন খেলোয়াড়ের তালিকায় ৪৩ নম্বর রয়েছেন ডাকেট।
ক্রিস ব্যাল্ডারস্টোন
ব্যাল্ডারস্টোন দীর্ঘদিন মিডফিল্ডার হিসেবে খেলছেন ফুটবল, ক্রিকেট খেলেছেন প্রথম শ্রেণীর, এমনকি ‘৯০ এর দশকে ওয়ানডেতে আম্পায়ারিংও করেছেন।
তিনি ফুটবল খেলেছেন বেশিরভাগ সময়ই দ্বিতীয় বিভাগে; হাডারসফিল্ড টাউনের হয়ে ১১৭ ম্যাচে ২৪ গোল, চারলিস ইউনাটেড এর হয়ে ৩৭৬ ম্যাচে ৬৮ গোল, ডনচ্যাস্টার রোভারসের হয়ে ৩৯ ম্যাচে এক গোল রয়েছে তার। ক্রিকেটে ৩৯০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে করেছেন ১৯,০৩৪ রান যাতে রয়েছে ৩২টি সেঞ্চুরি। বোলিংটাও খারাপ করতেন না, ২৬ গড়ে রয়েছে ৩১০টি উইকেট। ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্টও খেলছেন, তবে মাত্র দুই ম্যাচে ৩৯ রানেই থেমে যায় তার টেস্ট ক্যারিয়ার।
বাল্ডারস্টোনকে নিয়ে একটি বেশ মজার কাহিনী আছে। ১৯৭৫ সালে লেইচেস্টারশায়ার বনাম ডার্বিশায়ারের ম্যাচে লেইচেস্টারশায়ারের হয়ে দিন শেষ করেন ৫১ রানে নট আউট থেকে। সেদিনই ডনচ্যাস্টার রোভারসের হয়ে ম্যাচ খেলতে যান যে ম্যাচ ১-১ এ ড্র হয়। ঠিক পরের দিন তিনি আবার ব্যাটিংয়ে নামেন, সেঞ্চুরি করেন এবং বোলিংয়ে তিন উইকেট পেয়ে সেবার লেইচেস্টারশায়ারের কাউন্টি চ্যাম্পিয়ানশিপ নিশ্চিত করেন।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান
ডন ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। মাত্র ৪ রানের জন্য তার গড় ১০০ না হওয়ার আক্ষেপ থাকলেও তার ক্যারিয়ার গড়ের কাছাকাছি যাওয়াই অসম্ভব ব্যাপার। তিনি সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কিনা এটি নিয়েও বিতর্ক আছে, হয়ত সবসময়ই থেকে যাবে। কিন্তু ক্রিকেট মাঠের ‘ডনের’ আরেকটি কীর্তি আমরা বেশিরভাগই জানি না। ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়ানশিপের বিজয়ী ছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান। ক্রিকেট মাঠে বোলারদের ত্রাস একসময় প্রতিযোগিতামূলক টেনিসও খেলতেন।
শেষ করি একটি ঘটনা দিয়ে। ১৯৯২ সালে বোল্টন লীগের হ্যাম্যার কাপ ফাইনালে গ্রিনমাউন্টের হয়ে ওপেন করতে নামেন দুজন। দুজনই অপরাজিত শতক করেন সেই ম্যাচে। সেসময় কেউই বিখ্যাত ছিলেন না, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দুজন দুই খেলায় বিখ্যাত হয়ে যান। এই দু’জন হচ্ছেন ম্যাথু হেইডেন আর গ্যারি নেভিল। একজন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা ওপেনার, আরেকজন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ফুটবলার যিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছিলেন একসময়। গ্যারি নেভিল এখনো ক্রিকেটের ফ্যান, অ্যাশের কমেন্ট্রি বক্সে তার সহাস্য উপস্থিতি সে কথারই জানান দেয়।