১.
‘হেই ক্যারোলি, তুমি এখানে যে? কী মনে করে? শ্যুটিং দেখতে এসেছ বুঝি?’
শুনে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালেন ক্যারোলি নামের মানুষটা। বিস্ময় ফুটে আছে লোকটার মুখে, যেন এখানে ক্যারোলি’র উপস্থিতি মেনে নিতে পারছে না। লোকটার বিস্ময় কমানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না তিনি। সহজ গলায় বললেন,
‘না, ঠিক দেখতে নয়। শ্যুটিংয়ে অংশ নিতেই এসেছি।’
প্রশ্নকর্তার চোয়াল ঝুলে পড়লো, ছানাবড়া হয়ে গেল চোখ। বলে কী ক্যারোলি? ওর মাথা ঠিক আছে তো?
প্রশ্নকর্তার বিস্ময় যৌক্তিকই ছিল। কারণ, ক্যারোলি নামের মানুষটা আপাদমস্তক ডানহাতি, পিস্তল শ্যুটার হিসেবে অতুলনীয় ছিলেন একসময়। হ্যাঁ, ছিলেন বলতেই হচ্ছে; বেশ কয়েক মাস আগে এক গ্রেনেড বিস্ফোরণে উড়ে গেছে তার ডান হাত। সেই লোক বলছে, শ্যুটিংয়ে অংশ নেবে? কীভাবে? বাঁ হাত দিয়ে?
বিস্ময়ের আরও অনেকটা বাকি ছিল। যাকে দেখে সমবেদনা জানিয়েছিলেন অনেকে, যাকে পাত্তাই দেননি কেউ কেউ, সেই একহাতি লোকটাই শ্যুটিংয়ে প্রথম হয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত!
ঘটনাটা হাঙ্গেরিয়ান ন্যাশনাল পিস্তল শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপের। সময়কাল: ১৯৩৯ সাল।
২.
১৯১০ সাল, জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখ। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে জন্ম নিলেন ক্যারোলি। তার পুরো নাম রাখা হলো ক্যারোলি টাকাক্স।
ক্যারোলির শৈশবকাল সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, তেমন বৈচিত্র্যময় ছিল না বলেই হয়তো। আসলে তার জীবন ছিল এক রোলার কোস্টার রাইডের মতো, যার শুরুটা হয়েছিলো সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরে।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ক্যারোলি, এখানেই পিস্তল শ্যুটার হিসেবে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকের আসর বসেছিলো জার্মানির বার্লিনে, কিন্তু বার্লিনগামী হাঙ্গেরির দলে জায়গা হলো না তার। সার্জেন্ট ছিলেন ক্যারোলি, শুধুমাত্র কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরই এ সুবিধা ছিল তখন। তবে অলিম্পিকের পরই বন্ধ করে দেয়া হয় এই বাজে নিয়মটা।
চার বছর পরের অলিম্পিককে পাখির চোখ করলেন ক্যারোলি, সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও শুরু করলেন জোরেসোরে। এর মাঝেই সেই দুর্ঘটনাটা ঘটলো, প্রশিক্ষণের সময় একটা ত্রুটিপূর্ণ গ্রেনেড বিস্ফোরণে উড়ে গেলো তার ডান হাত।
এই অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষই হয়তো নিজের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে হাল ছেড়ে দিতো। ক্যারোলিরও যে সেরকম ইচ্ছে হয়নি, তা হয়তো জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু আপাদমস্তক লড়াকু একজন মানুষ ছিলেন তিনি। হাল ছেড়ে দেয়া কী জিনিস, তা জানা ছিল না তার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলেন, ডান হাত দিয়ে যদি শ্যুট করা যায়, তবে বাঁ হাত দিয়ে কেন নয়?
ভাবা বা বলা যতটা সহজ ছিল, করা ছিল ততটাই কঠিন। ডানহাতি একজন মানুষ হুট করেই বাঁহাতি মানুষে পরিণত হতে পারেন না, তার জন্য সময় লাগে। সেই সময়টা দিলেন ক্যারোলি। হাসপাতাল থেকে ফিরে সবার অলক্ষ্যে অনুশীলন শুরু করলেন তিনি। কেউ জানতেও পারলো না, কি দুঃসাহসী পরিকল্পনা তিনি আঁটছেন। টানা চার মাসের কঠোর পরিশ্রম, অখণ্ড মনঃসংযোগ, আর অদম্য অধ্যবসায়ের ফলে বাঁ হাতেও শ্যুটিংয়ে দক্ষ হয়ে উঠলেন, অংশগ্রহণ করলেন জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায়। সেখানে কী করেছিলেন, তা বলা হয়েছে আগেই।
৩.
স্বপ্নপূরণের জন্য নিজের দিক থেকে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেননি ক্যারোলি। কিন্তু এমন অনেক সময় আসে, যখন পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে থেমে যেতে হয়। ক্যারোলির ক্ষেত্রেও তাই হলো। জাতীয় পর্যায়ের সাফল্যের পর তিনি যখন পরের বছরের অলিম্পিকের স্বপ্নে বিভোর, তখনই তার জন্য আঘাত হয়ে এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মানুষ যেখানে প্রাণ বাঁচিয়ে কূল পাচ্ছে না, সেখানে বিনোদন নেয়ার সময় কোথায়? ১৯৪০ সালে অলিম্পিক হলো না, হলো না তার চার বছর পরও। তবে দমে গেলেন না ক্যারোলি, অনুশীলন করে গেলেন নিয়মিত। তার অপেক্ষার পালা ফুরালো ১৯৪৮ সালে, লন্ডন অলিম্পিকে। সেবার হাঙ্গেরির লন্ডনগামী অলিম্পিক দলে জায়গা হলো তার। ১৯৩৬ সাল থেকে তিনি যে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, তা পূর্ণ হলো ১৯৪৮ সালে এসে, লন্ডন অলিম্পিকে। ২৬ বছরের তরুণ ততদিনে পরিণত হয়েছেন ৩৮ বছরের যুবকে।
লন্ডন অলিম্পিকের সময়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন আর্জেন্টিনার কার্লোস এনরিকে ভ্যালিয়েন্তে। শ্যুটিং স্পটে ক্যারোলিকে দেখে চমকে গেলেন তিনি। ৯ বছর আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হলো আবার। ক্যারোলির দুর্ঘটনা সম্পর্কে শুনেছিলেন তিনি। এখানে কী করছেন, তা জানতে চাইলেন ভ্যালিয়েন্তে। ক্যারোলি বললেন,
‘শিখতে এলাম আরকি।’
ক্যারোলি জানতেন, মুখে বলে কিছু হবে না, কাজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। মঞ্চ সাজানোই ছিল, সেই মঞ্চে জ্বলে উঠলেন তিনি। এমন শেখাই শিখলেন যে, ভ্যালিয়েন্তেকে পিছনে ফেললেন, বিশ্ব রেকর্ড নতুন করে লিখলেন, ২৫ মিটার র্যাপিড ফায়ার পিস্তল শ্যুটিংয়ে অলিম্পিকের সোনা জিতে নিলেন ক্যারোলি টাকাক্স!
ডানহাতি হয়েও বাঁ হাতে স্বর্ণ জয়? তাও আবার অলিম্পিকে? মানুষের ক্ষমতার আসলেই কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
আর ভ্যালিয়েন্তে কী বললেন ক্যারোলির কাছে হারের পর?
‘আপনি যথেষ্ট শিখে ফেলেছেন।’
৪.
পাঠক কি ভাবছেন, কাহিনী এখানেই শেষ? না, গল্প এখনও বাকি। হিন্দি সিনেমার ভাষায়, ‘পিকচার আভি ভি বাকি হ্যাঁয়!’
অলিম্পিকের পরের আসর বসলো ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে। নতুন করে ক্যারোলির আর প্রমাণ করার কিছু ছিল না, আগেই আসরেই যা করার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হেলসিংকিতে আরেকবার জ্বলে উঠলেন তিনি।
সবাইকে বিস্ময়ের সপ্তম আসমানে তুলে সেবারও স্বর্ণ জিতলেন ক্যারোলি! আর এবার ভ্যালিয়েন্তে বলেই ফেললেন,
‘যথেষ্টর চেয়েও বেশি শিখে ফেলেছেন। এবার আমাকেও একটু শেখান।’
বাংলাদেশের প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার আতাহার আলি খান একটা ইংরেজি বাক্য প্রায়ই ব্যবহার করেন ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ্’র ক্ষেত্রে, ‘ব্যাক টু ব্যাক হান্ড্রেড ইন ওয়ার্ল্ড কাপ’। ক্যারোলির ক্ষেত্রে তিনি কী বলতেন? ‘ব্যাক টু ব্যাক গোল্ড ইন অলিম্পিক’?
৫.
১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকেও অংশ নিয়েছিলেন ক্যারোলি। তবে এবার আর শরীর সায় দেয়নি। আগের দুইবারের স্বর্ণজয়ী এবার শেষ করেন অষ্টম স্থানে থেকে।
তাতে ক্যারোলির নিশ্চয়ই কিছু এসে যায়নি। যে মানুষটার শ্যুটিংই ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল, অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন পূরণ হওয়াই ছিল অসম্ভব এক ব্যাপার, সেই মানুষটিই ক্যারিয়ার শেষ করলেন টানা দুই অলিম্পিকের সোনাজয়ী হিসেবে। ক্যারোলির এই কৃতিত্বে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ‘অলিম্পিক হিরোজ’-এর তালিকায় লিপিবদ্ধ করেন তার নাম।
ক্যারোলির টানা দুইবারের সোনা জয়ের রেকর্ড টিকে ছিল প্রায় ২০ বছর। ১৯৬৮ আর ১৯৭২ অলিম্পিকে পরপর দুইবার সোনা জিতে এই রেকর্ডে ভাগ বসান পোল্যান্ডের জোযেফ জ্যাপেযকি। আর ২০০৪ অলিম্পিকে হ্যাটট্রিক সোনা জেতেন জার্মানির র্যালফ শ্যুমান, জিতে ক্যারোলি আর জোযেফকে পিছনে ফেলে দেন তিনি। তবে একটা জায়গায় সন্দেহাতীতভাবেই ক্যারোলি এগিয়ে। তার মতো হাত বদল বাকি দুজনকে করতে হয়নি।
৬.
সেনাবাহিনী থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসর নেন ক্যারোলি। কোচিংও করিয়েছেন কিছুদিন, কোচিংয়ে খুব একটা সফল হননি অবশ্য। কিন্তু এসবে কিছু এসে যায় না। শ্যুটিংয়ে তার কৃতিত্বই তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট।
১৯৭৬ সালে, ৬৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। থেমে যায় তার বর্ণাঢ্য জীবন।
ক্যারোলির জীবন থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আমরা অনেকেই অতি সহজে হাল ছেড়ে দিই, পিছিয়ে যাই ভয় পেয়ে। সেখানে ক্যারোলি নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটা হারানোর পরেও হাল ছাড়েননি, বরং পিছিয়ে গিয়েও ফিরে এসেছেন, পৌঁছে গেছেন নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে।
দুই হাত যারা সমানভাবে চালাতে পারে, তাদেরকে বলা হয় সব্যসাচী। মহাভারতের তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের আরেক নাম ছিল এটি। ক্যারোলি নিজেও ছিলেন সব্যসাচী। পার্থক্য শুধু এক জায়গাতে। অর্জুন ছিলেন পৌরাণিক এক বীর, আর ক্যারোলি রক্তমাংসে গড়া দুর্ঘটনায় হাত হারানো এক সাধারণ শ্যুটার!