যেকোনো স্পোর্টসেই ধারাভাষ্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ক্রিকেটও তার ব্যতিক্রম নন। ধারাভাষ্য ছাড়া যেন একটা ক্রিকেট ম্যাচ একেবারেই প্রাণহীন। উইলো আর চর্মগোলকের ক্রিকেটে ধারাভাষ্য বাড়তি উন্মাদনা যোগ করে। ধারাভাষ্য ছাড়া এখন একটা ক্রিকেট ম্যাচ যেন কল্পনাই করা যায় না। তবে এর শুরুর গল্পটা কেমন ছিল? আসুন, সেটা জেনে নেওয়া যাক।
সালটা ১৯২২, টেস্ট ইতিহাসের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান অজি কিংবদন্তি চার্লস ব্যানারম্যানের স্মরণে এমসিজিতে একটা প্রীতি ম্যাচ চলছে। নিউ সাউথ ওয়েলসের ক্রিকেটাররা নিজেদের মধ্যে একাদশ বানিয়ে একে অপরের মুখোমুখি। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক, নাম লেন ওয়াট, মাইক্রোফোন হাতে ভরাট গলায় বলে উঠলেন,
“গো অন টেকিং!”
শুরুটা এখানেই, এই একটা বাক্যের মধ্য দিয়েই ক্রিকেটে ধারাভাষ্যের চল শুরু হয়েছিল। কমেন্ট্রি বক্সে মাইক্রোফোন হাতে কেউ কেউ এই কাজটাকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আজকের আয়োজন এমনই তিনজন ধারাভাষ্যের শিল্পীদের নিয়ে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক, তারা কারা।
রিচি বেনো (১৯৩০-২০১৫)
“ধারাভাষ্যের ব্রাডম্যান” কিংবা “ভয়েস অফ ক্রিকেট” বলা হয় তাকে। নিশ্চয়ই ঠাহর করা যাচ্ছে, কাকে নিয়ে কথা হচ্ছে? হ্যাঁ, তিনি রিচার্ড ‘রিচি’ বেনো।
এই নামটুকু বললেই তাকে নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে যায়। সাবেক এই অজি অধিনায়ক সাদা পোশাকে ম্যাচ খেলেছেন ৬৩টি। টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়েছিলেন ২০০০ রান এবং ২০০ উইকেটের ডাবলের ল্যান্ডমার্ক। ক্রিকেট মাঠে দারুণ সফল ছিলেন রিচি। ক্রিকেটকে দিয়েছেন দু’হাত ভরে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের একজন মহীরুহের নাম রিচি বেনো, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
তবে তার সব পরিচয় ছাপিয়ে গেছে ‘ধারাভাষ্যকার রিচি বেনো’ এই পরিচয়ের কাছে। রিচির বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন, বিশ্লেষণ আর দরাজ কণ্ঠের সংমিশ্রণে একটা ভাবলেশহীন ম্যাচেও প্রাণের সঞ্চার পেত। দর্শকদের মাঠমুখী করতে তার অবদান ছিল অসামান্য।
১৯৬০ সালে বিবিসি রেডিও দিয়ে শুরু এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৬৩ সালে টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার হিসেবে যাত্রা শুরু। এরপর একে একে বিবিসি, চ্যানেল ফোর, চ্যানেল নাইন – কোথায় ছিলেন না রিচি বেনো! একসময় তো এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তিনি না থাকলে যেন সম্প্রচারই হবে না। রিচি বেনোকে তাই ধারাভাষ্যের ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বললেও খুব বেশি বাড়াবাড়ি হবে না। লেখক এবং কলামিস্ট হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল রিচির।
তাকে নিয়ে শেষ করবো তারই একটি কথা দিয়ে। ফিলিপ হিউজের মৃত্যুতে যখন পুরো ক্রিকেট বিশ্ব নিস্তব্ধ, তখন সেই নিস্তব্ধতা খুব ভালোভাবেই স্পর্শ করেছিলো রিচিকে৷ তাই তো ফিলকে স্মরণ করে বলেছিলেন,
“A boy, just beginning, 25 years of age, baggy green number 408. His father’s best mate, son, brother, fighter, friend, inspiration… Phillip Hughes, forever rest in peace, son.”
এর ঠিক বছরখানেক পর ২০১৫ সালে ৮৪ বয়সী রিচিও ‘গুড বাই’ জানিয়ে দেন পৃথিবীকে। সশরীরে তিনি না থাকলেও মাইক্রোফোন হাতে তার নিবেদন ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়পটে অমলিন থাকবে আজীবন।
টনি গ্রেগ (১৯৪৬- ২০১২)
১৯৯৮ সালের ২৪ এপ্রিল, শারজায় ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারত-অস্ট্রেলিয়া। উইকেটে শচীন টেন্ডুলকার অজি বোলারদের কচুকাটা করছেন। ডেমিয়েন ফ্লেমিংকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে তুলে মারলেন শচীন। কমেন্ট্রিবক্স থেকে তখন ভেসে আসছে,
“Oh! He has hit this one miles… Oh It’s a biggie, straight over the top… What a player! What a wonderful Player!
কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার টনি গ্রেগ। ক্রিকেট ধারাভাষ্যকে যারা রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তাদেরই একজন এই ইংলিশম্যান। দেশের হয়ে ২২ ওয়ানডে এবং ৫৮ টেস্ট খেলেছেন, এর মধ্যে ১৪টিতে অধিনায়কত্ব করেছেন। ১৯৭৫ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটারও নির্বাচিত হয়েছিলেন টনি গ্রেগ।
ক্রিকেট ছেড়ে দেবার পর তিনি অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নাম লেখান ধারাভাষ্যকার হিসেবে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ক্যারি প্যাকারের প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল নাইন’ দিয়ে তার ধারাভাষ্য ক্যারিয়ার শুরু করেন। আশির দশক থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন। তবে বিভিন্ন সময় চ্যানেল নাইন ছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রচার দলের হয়ে ধারাভাষ্য দিয়েছেন।
ক্রিকেটের বড় ইভেন্টগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল টনি গ্রেগের কণ্ঠ। ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দিতে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন। ক্রিকেটার হিসেবে টনি গ্রেগ সফল না হলেও কমেন্ট্রিবক্সে মাইক্রোফোন হাতে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৬ বছরে পরপারে পাড়ি জমান এই কিংবদন্তিতুল্য ধারাভাষ্যকার।
নাসের হোসাইন
২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যডিলেড ওভালে বাংলাদেশ – ইংল্যান্ড মুখোমুখি। ম্যাচ হারলে বিশ্বকাপ ছিটকে যাবে এক দল, জিততে পারলেই কোয়ার্টার ফাইনাল। শেষদিকে ম্যাচের ভাগ্য যেন পেন্ডুলামের মতো দুলছিল। একবার বাংলাদেশের দিকে, তো পরক্ষণেই ইংল্যান্ডের দিকে। ৪৯তম ওভারের প্রথম বলেই ব্রডের স্টাম্প ছত্রখান করে ম্যাচ জমিয়ে তুলেছেন রুবেল হোসেন। তখন ম্যাচ জিততে ইংলিশদের দরকার আরো ১৬ রান। ওভারের তৃতীয় বলে আরেকবার স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন রুবেল, এবার শিকার ইংল্যান্ডের শেষ ব্যাটসম্যান জেমস অ্যান্ডারসন। কমেন্ট্রিবক্সে মাইক্রোফোন হাতে নাসের হোসাইন গর্জে উঠলেন,
“Goes for hero. Bowled him! Full & straight. The Bangladesh Tigers have knocked the England Lions out of the world cup! One of the greatest days in Bangladesh cricket history, one of the lowest points in English history”.
একবার ভাবুন তো, যেই ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক এই নাসের হোসাইন, সেই তিনিই কি না অবলীলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন! পেশাদারিত্বের জায়গায় চুল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নন নাসের হোসাইন। ইংলিশরা এখানেই বোধহয় অন্যদের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে থাকেন। তাদের কাছে সবার আগে পেশাদারিত্ব। মাইক্রোফোন হাতে নিলে তারা ভুলে যান, মাঠে কারা খেলছে। ম্যাচের পরিস্থিতি আমলে নিয়ে যেটা বলা উচিত, ঠিক সেটাই বলে যান নির্দ্বিধায়। সবকিছু ছাপিয়ে তখন জয়টা হয় ক্রিকেটের।
কমেন্ট্রিবক্সে যেমন সুনাম কুড়িয়েছেন, ক্রিকেটের ২২ গজেও কম যাননি সাবেক এই ইংলিশ অধিনায়ক। ৯৬ টেস্টে ৫,৭৬৪ রানের পাশাপাশি ওয়ানডেতে ৮৮ ম্যাচে করেছেন ২,৩৩২ রান। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর স্কাই স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
উপরের তিনটি নাম ছাড়া আরও কিছু নাম ‘ধারাভাষ্য’ শব্দটার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিং থেকে শুরু করে ইয়ান বিশপ, হার্শা ভোগলে, রবি শাস্ত্রী, রমিজ রাজা, ড্যানি মরিসন, ইয়ান স্মিথ, মার্ক টেলর, মাইক হেসম্যান, মাইক আথারটন, জিওফ বয়কট, বিল লরি কিংবা হালের আতাহার আলী খান, কেভিন পিটারসেন, কুমার সাঙ্গাকারা, কেউই কম যান না মাইক্রোফোন হাতে।
দরাজ কণ্ঠের সাথে দারুন ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ আর নিখুঁত শব্দচয়নের সংমিশ্রণ ঘটিয়েই এই কাজটা করতে হয়। আর সেই কাজটাই নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন একদল মানুষ। ময়দানি লড়াইয়ের উত্তেজনায় ঘি ঢেলে সেটাকে তারা করে তুলছেন আরো চমকপ্রদ, রোমাঞ্চকর। খালি চোখে টিভি স্ক্রিনে কিংবা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখা কোটি ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে তারাও একেকজন মহীরূহ।