দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিক আঙিনায় নিজেদের ততটা মেলে ধরতে পারেনি। বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেলে মাত্র চারটিতে জয়ের মুখ দেখেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এর মধ্যে হারের স্বাদ পেয়েছিল ১২টি ম্যাচে। যার মধ্যে আটটি পরাজয় ছিল ইনিংস ব্যবধানে এবং একটি ১০ উইকেটের ব্যবধানে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮ বছর কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে পারেনি। এ কারণে তাদের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন জর্জ হ্যাডলির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি সমৃদ্ধ হয়নি। জর্জ হ্যাডলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯ টেস্টে ২,১৩৫ রান করেছিলেন ৬৬.৭১ ব্যাটিং গড়ে। হাঁকিয়েছিলেন ১০টি শতক।
১৯৪৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে ফেরার সময় সাথে নিয়ে আসে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের। ১৯৪৮ সালে ২১শে জানুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে ক্রিকেটে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আবির্ভাব ঘটে। তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত হন এক ঝাঁক তরুণ ক্রিকেটার। এমনই তিন যুগশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের নামের আদ্যক্ষরের কারণে তারা পরিচিতি পান ‘থ্রি ডব্লিউজ‘ নামে। তারা হলেন ওয়ালকট, উইকস এবং ওরেল।
তিনজনের মধ্যে ক্লাইড ওয়ালকট উইকেটের পিছন সামাল দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করতেন। আর এভারটন উইকসের দায়িত্ব ছিলো প্রতিপক্ষের বোলারদের ছুঁড়ে মারা বলকে বেধড়ক পিটিয়ে মাঠ ছাড়া করা। ২১শে জানুয়ারির ম্যাচে অভিষেক ঘটেনি বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউজের’ আরেক ডব্লিউ ফ্রাঙ্ক ওরেলের। পরবর্তী টেস্ট ম্যাচে দলে জায়গা করে নেন ত্রিশূলের এক ফলা শূল ফ্রাঙ্ক ওরেল। ইতিহাসের সর্বকালের সেরা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের অগ্রযাত্রা শুরু হয় সেখান থেকেই। ঐ ম্যাচে উইকস, ওরেল এবং ওয়ালকট যথাক্রমে ৩, ৪ এবং ৫ নাম্বার পজিশনে ব্যাট করেন।
এই তিনজন যখন একসাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করেন, তখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দল নিজেদের পায়ের নিচে মাটি খুঁজছিল। সবচেয়ে ভালো দিক হলো, তাদের তিনজনের বয়সের পার্থক্য মাত্র ১৭ মাস, এতে করে একই সময়ে তিনজন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান দলে পেয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিনজনই কেনিংসটন ওভালের ১ মাইলের দূরত্বের মধ্যে বসবাস করতেন। ওয়ালকট তো এটাও বিশ্বাস করতেন যে, তারা একই ধাত্রীর হাতে জন্মেছেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ক্লাব দলের হয়ে অনুশীলন করার সময় উইকস এবং ওয়ালকটের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের বন্ধুত্ব, যোগ দেন ওরেলও। কোথাও খেলতে যাওয়ার সময় তারা একইসাথে থাকতেন এবং খেলা শেষে নেচে জয় উদযাপন করতেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ক্রিকেট মাঠে ফেরার পর নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই একসাথ হন এই তিন ক্রিকেটার। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার পর ইংরেজ পত্রিকার এক সাংবাদিক তাদেরকে ‘থ্রি ডব্লিউজ’ নামে নামাঙ্কিত করেন।
মিডল অর্ডারে তারা কতটা ভয়ংকর ছিলেন, সেটা তাদের পরিসংখ্যান দেখলেই উপলব্ধি করা যায়। তাদের অভিষেকের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় ছিলো ২৯.৩৮। কিন্তু তাদের অভিষেকের পরের ১০ বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় প্রায় ৪৮-এ, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডারদের ব্যাটিং গড় ছিলো ৪০ থেকেও কম। ঐ সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভ ছিলেন উইকস, ওয়ালকট এবং ওরেল। উদাহরণস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৫৫ সালে ঘরের মাটিতে অনুষ্ঠিত ৫ম টেস্টের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। ঐ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংসে ৩৫৭ রান সংগ্রহ করেছিল, যার মধ্যে ‘থ্রি ডব্লিউজ’ এর ব্যাট থেকে এসেছে ২৭২ রান। ওয়ালকট করেছিলেন ১৫৫, ওরেল ৬১ এবং উইকসের ব্যাট থেকে এসেছিল ৫৬ রান।
২১শে জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল থেকে ২৬শে মার্চ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ৬ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ৪ জনই ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এবং তাদের মধ্যে ‘থ্রি ডব্লিউজের’ নামও ছিলো অবধারিত ভাবে। এই সময়ে গ্যারি সোবার্স ৬১.৯৪ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১,১১৫ রান। ক্লাইড ওয়ালকট ৬১.৬৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৩,৬৩৯ রান। এভারটন উইকস করেছেন ৫৮.০১ ব্যাটিং গড়ে ৪,২৩৫ রান এবং ফ্রাঙ্ক ওরেল ৫৪.৮০ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ২,৩০২ রান।
এভারটন উইকস তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন ৪ নম্বর ব্যাটিং পজিশনে। ব্যাটিং গড় বিবেচনায় ঐ পজিশনে ব্যাট করে এখন পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় জ্যাক ক্যালিসের পরের স্থানেই অবস্থান করছেন উইকস। জ্যাক ক্যালিস তার ক্যারিয়ারে ৪ নম্বর পজিশনে ৬৫.২৪ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন ৭,৮৯৫। এরপরের স্থানে থাকা এভারটন উইকস ৬৩.৬২ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৩,৩৭২ রান। এই তিনজন একসাথে যত ম্যাচ খেলেছেন সব ম্যাচেই দলের সিংহভাগ রান করেছেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং লাইনআপ বলতে তখন ‘থ্রি ডব্লিউজ’ই ছিলেন। তারা একসাথে ২৯ ম্যাচ খেলেছেন, এই ২৯ ম্যাচে ফ্রাঙ্ক ওরেল ৫১.৯৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ২,৪৪৩ রান। ক্লাইড ওয়ালকট ৪৯.৭৮ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ২,২৯০ রান এবং এভারটন উইকস ৪৭.২২ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ২,৩১৪ রান। পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে তারা তিনজনই ছিলেন অসাধারণ, ব্যক্তিগত ক্রিকেট ক্যারিয়ারেও তাদের অর্জনসমূহ উল্লেখযোগ্য। তাদের ক্যারিয়ারের শুরুটা একসাথে হলেও শেষটা হয়েছে একজনের একেক মৌসুমে এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকট
১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বার্বাডোসের ব্রিজটাউন এলাকার নিউ অর্লিয়েন্সে জন্মগ্রহণ করেন ওয়ালকট। তার ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয় কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়। ১৪ বছর বয়সে বার্বাডোজের হ্যারিসন কলেজে ভর্তি হন ওয়ালকট, সেখানেই তিনি কলেজ দলের হয়ে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বার্বাডোজের পক্ষে অভিষেক ঘটে ক্লাইড ওয়ালকটের। সবার নজরে পড়েছেন ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো এক তারিখে বিদ্যালয়ের বন্ধু এবং ‘থ্রি ডব্লিউজ’-এর একজন ফ্রাঙ্ক ওরেলের সাথে ত্রিনিদাদের বিপক্ষে চতুর্থ উইকেট জুটিতে অপরাজিত ৫৭৪ রান যোগ করার পর। ঐ জুটিতে ক্লাইড ওয়ালকটের সংগ্রহ ছিল অপরাজিত ৩১৪ রান এবং ফ্রাঙ্ক ওরেল করেন অপরাজিত ২১৪ রান।
১৯৪৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে ফিরে আসলে প্রথম টেস্টেই দলে জায়গা করে নেন ক্লাইড ওয়ালকট। ক্যারিয়ারের শুরুতে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসাবে দলে থাকলেও পরে পিঠের ব্যথার জন্য গ্লাভসজোড়া তুলে রেখে ব্যাটিংয়ে মনযোগী হন। প্রথম টেস্টে ইনিংসের গোড়াপত্তন করলেও ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন ৫ নম্বর এবং ৩ নম্বর ব্যাটিং পজিশনে। ওয়ালকট পিছনের পায়ে ভর করে এতো জোরে ব্যাট হাঁকাতেন যে সেটা অনেক ক্রিকেটার সামনের পায়ে ভর করেও হাঁকাতে পারতেন না। পিছনের পায়ে ভর করে কাভার ড্রাইভ, কাট, পুল মারাতে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
ওয়ালকট ৪৪ টেস্টে ৫৬.৬৮ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৩,৭৯৮ রান। যার মধ্যে শতক হাঁকিয়েছেন ১৫টি এবং অর্ধশতক ১৪টি। ৪৪ টেস্টের মধ্যে ২২টি টেস্টে ব্যাট করেছেন ৫ নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে, সেখানে ৫৯.২২ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১,৫৯৯ রান। উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর টুকটাক বোলিং করেন ওয়ালকট। মিডিয়াম পেস বল করে উইকেট শিকার করেছেন ১১টি।
পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে এগারো সংখ্যাটির সাথে তার সখ্যতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ১১টি ছয়, গ্লাভস হাতে ১১টি স্ট্যাম্পিং কিংবা বল হাতে ১১টি উইকেট যার নিদর্শন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৪৬ ম্যাচের ২৩৮ ইনিংসে ৫৬.৫৫ ব্যাটিং গড়ে করেন ১১,৮২০ রান। ৪০টি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ৫৪টি অর্ধশতক।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকটের বিদায়টা অবশ্য সুখকর বলা যায় না। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান। গুঞ্জন উঠেছিল, অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিয়ে বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বের জেরে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। তবে তার মুখে শোনা যায় ভিন্ন কথা, বেতন নিয়ে কলহের জেরেই অবসর নিয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালের ২৬শে আগস্ট ৮০ বছর বয়সে জন্মভূমি বার্বাডোজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্লাইড ওয়ালকট।
স্যার এভারটন উইকস
১৯২৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বার্বাডোসের সেন্ট মাইকেল এলাকার ওয়েস্টবারিতে জন্মগ্রহণ করেন এভারটন উইকস। ইংরেজ ফুটবল দল এভারটনের সাথে মিল রেখে তার নামকরণ করেছিলেন বাবা। উইকসের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সচ্ছল ছিল না। সেজন্য তার বাবা ত্রিনিদাদের তৈলকূপে কাজের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়েন। তখন উইকসের বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। বাবার অবর্তমানে এক চাচীর সান্নিধ্যে শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। এত কিছুর মধ্য দিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যান উইকস, ভর্তি হন সেন্ট লিওনার্ড বয়েজ স্কুলে। খেলাধুলায় অধিক মনযোগী হওয়ার কারণে স্কুলে কোনো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। শুধুমাত্র ক্রিকেট নন, ফুটবলেও তার দক্ষতা ছিল। বার্বাডোসের ফুটবলার হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।
১৩ বছর বয়সে বার্বাডোস ক্রিকেট লীগে ওয়েস্টশায়ারের হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন উইকস। যদিও তার ইচ্ছা ছিল স্থানীয় পিকউইক ক্রিকেট ক্লাবে খেলার। সেখানে শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার খেলতে পারবে বলে তার আর সেই সুযোগ হয়নি। ফুটবল এবং ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ১৪ বছর বয়সে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন উইকস। ২১শে জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে ক্লাইড ওয়ালকটের সাথে একত্রে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে উইকসের। তিন নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৫ ও ২৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ালকট এবং উইকসের অভিষিক্ত ম্যাচটি অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয়েছিল।
সিরিজের ২য় এবং ৩য় ম্যাচে তার ব্যাটে রান ছিল না, চতুর্থ টেস্টে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও ছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলেই জর্জ হ্যাডলির ইনজুরির কারণে দলে জায়গা করে নেন এবং শূন্য রানের মাথায় জীবন পেয়ে খেলেন ১৪১ রানের অসাধারণ ইনিংস।
প্রথম শতকের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি উইকসকে। দিল্লীতে ভারতের বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় শতকের দেখা পেয়ে যান। ১৯৪৮ সালের শেষদিকে ভারত সফরে টানা তিন টেস্টে ১৯৪, ১৬২ ও ১০১ রান সংগ্রহ করেন। চতুর্থ টেস্টেও শতক পেয়ে যেতেন, যদি না ৯০ রানের মাথায় বিতর্কিতভাবে রান আউটের শিকার হতেন।
স্যার এভারটন উইকস ১৯৫৮ সালে উরুর আঘাতের কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন। অবসরের আগে ৪৮ টেস্টে ৫৮.৬১ ব্যাটিং গড়ে করেন ৪,৪৫৫ রান। বন্ধু ওয়ালকটের সমান ১৫টি টেস্ট শতক এবং ১৯টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটে একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে একাধারে ৫ ইনিংসে শতক হাঁকিয়েছেন এভারটন উইকস।
উইকস প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৫২ ম্যাচে ২৪১ ইনিংস ব্যাট করে ৫৫.৩৪ ব্যাটিং গড়ে করেন ১২,০১০ রান। প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে ৩৬টি শতক এবং ক্লাইড ওয়ালকটের সমান ৫৪টি অর্ধশতক করেছেন। ‘থ্রি ডব্লিউ’দের মধ্যে একমাত্র জীবিত ক্রিকেটার স্যার এভারটন উইকস তার অবসর পরবর্তী জীবনে অনেক ধরনের পেশার সাথে যুক্ত থাকেন। ১৯৬০ সালে বার্বাডোজ ডেইলি নিউজে কাজ করতেন। এরপর ১৯৭৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে কানাডা দলের কোচের পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯৯৪ সালে আইসিসির ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পান তিনি। অসামান্য ক্রিকেটীয় অর্জনের কারণে ২০০৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে জায়গা করে নেন উইকস।
স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল
পহেলা আগস্ট ১৯২৪ সালে বার্বাডোজের সেন্ট মাইকেল এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন ফ্রাঙ্ক ওরেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে অভিষেক ঘটে ওরেলের। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দুইবার ৫০০ রানের জুটি গড়েছিলেন তার ক্যারিয়ারে। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে এই রেকর্ডটি রয়েছে তার দখলে। এতে করে জাতীয় দলে জায়গা নেওয়ার ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে ছিলেন ওরেল।
‘থ্রি ডব্লিউজদের’ মধ্যে একমাত্র স্বীকৃত অলরাউন্ডার ছিলেন ওরেল। ডানহাতি ব্যাটসম্যান হলেও বাঁহাতে মিডিয়াম পেস এবং স্লো লেফট আর্ম অর্থোডক্স বোলিংও করতেন তিনি। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রেন্ট ব্রিজে ৪ নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ার সেরা ২৬১ রান সংগ্রহ করেন। ক্যারিয়ারে খুব বেশি ইনিংস ৪ নম্বরে ব্যাট করা হয়নি তার, ঐ পজিশনে এভারটন উইকস সফল ছিলেন। ফ্রাঙ্ক ওরেল প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৬০-৬৩ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
তার নেতৃত্বে ১৯৬০-৬১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়। অধিনায়ক হিসাবে ওরেলের ওটাই প্রথম সফর ছিল। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ছিলেন রিচি বেনো। দুই অধিনায়কই তাদের দলকে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সিরিজের প্রথম টেস্টটি ছিল অমীমাংসিত, তবে সেটা টেস্ট ক্রিকেটের চিরাচরিতভাবে ড্র হয়নি। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম টাই ম্যাচ হিসাবে এটি রেকর্ডবুকে জায়গা করে নেয়। শেষ পর্যন্ত ওরেলের অজি সফর খুব বেশি আনন্দদায়ক ছিল না, সিরিজ ২-১ এ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। তবে এটা ভেবে ওরেলে গর্ববোধ করতে পারেন যে ট্রফির নাম ছিল তার নামানুসারে।
ফ্রাঙ্ক ওরেলের মহানুভবতা সবার হৃদয় কেড়ে নিয়েছিলো। পশ্চিম বাংলার মানুষ কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম ওরেল। তার নামে সেখানে আলাদা দিবসও পালন করা হয়। ১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায় ভারত। সফরকারী ভারতের অধিনায়ক নরি কনট্রাকটর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে গুরুতর আঘাত পান। যার ফলে তার ক্যারিয়ার ঐখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তার জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ওরেল। প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে সে দিন ওরেল কনট্রাকটরকে রক্তদান করেন। তার এই অবদানের কথা স্বীকার পশ্চিমবঙ্গে ‘ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল’ প্রতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ঐ দিনে সেখানে ‘স্যার ওরেল দিবস’ পালন করা হয়।
ফ্রাঙ্ক ওরেল পেশাদার ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ড সফর শেষে। ঐ সফরে ৫টি টেস্ট খেলে ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতিয়ে ইংল্যান্ডের জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে যান তিনি। ওরেল আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ৫১ ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ৪৯.৪৮ ব্যাটিং গড়ে ৩,৮৬০ রান করেছেন ৯টি শতক এবং ২০টি অর্ধশতকের সাহায্যে। এছাড়া বল হাতে শিকার করেছেন ৬৯টি উইকেট।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ওরেল খেলেন ২০৮টি ম্যাচ। এগুলোতে ৫৪.২৪ ব্যাটিং গড়ে ১৫,০২৫ রান করেছেন ৩৯টি শতক এবং ৮০টি অর্ধশতকের সাহায্যে। বল হাতে শিকার করেছেন ৩৪৯টি উইকেট। ১৯৬৬-৬৭ সালে দলের সাথে ভারত সফরে যাওয়ার পর জানতে পারেন শরীরে লিউকেমিয়ার অস্তিত্ব আছে। জ্যামাইকায় ফিরে আসার এক মাস পর ১৩ মার্চ, ১৯৬৭ সালে কিংস্টনে তার দেহাবসান ঘটে।