আমরা সবাই জানি ‘ডাক (Duck)’ শব্দটির সাধারণ অর্থ ‘হাঁস’। তবে ক্রিকেটের ভাষায় এই ‘ডাক’ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। টেস্ট ক্রিকেট জন্মের আগে এর নাম ছিল ‘ডাকস এগ (Duck’s Egg)’। ক্রিকেটে এর ব্যবহার কীভাবে এলো তা নিয়ে বেশ কিছু মজাদার গল্পও রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো- ১৮৬৬ সালের ১৭ জুলাই প্রিন্স অব ওয়েলস (ভবিষ্যৎ সপ্তম এডওয়ার্ড) একটি ম্যাচে শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছিলেন। তখন তৎকালীন সংবাদপত্র ডেইলি টাইমসের একজন সাংবাদিক পত্রিকায় লেখেন,
The prince was bowled cut on the instant and retired to the royel pavilion on a duck’s egg
মূলত হাসের ডিমের সাথে ‘0’ সংখ্যাটির বেশ সাদৃশ্য থাকাতেই সাংবাদিক এটার সাথে তুলনা করেছেন। তখন থেকেই ক্রিকেটে এর প্রচলন শুরু। সময়ের সাথে সাথে ‘ডাকস এগ’ রূপ নিলো সরাসরি ‘ডাক’-এ। অতএব ক্রিকেটের ভাষায় শূন্য রানে আউট হওয়াকেই ‘ডাক’ বলা হয়ে থাকে, যা একজন ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে নিম্নতর সংগ্রহ।
এই ডাকেরও আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন-
- টেস্ট ক্রিকেটে দুই ইনিংসেই শূন্য রানে সাজঘরে ফিরলে সেটা পেয়ায় এন্ড কিং পেয়ার ডাক
- প্রথম বলেই আউট হলে গোল্ডেন ডাক
- প্রথম বল মিস করে সেকেন্ড বলে আউট হলে সিলভার ডাক
- প্রথম দুটো বল মিস করে তৃতীয় বলে আউট হলে ব্রোঞ্জ ডাক
- কোনো বলের মুখোমুখি না হয়েই আউট হলে সেটাকে বলে ডায়মন্ড ডাক
- ইনিংসের শুরুতেই কোনো বল না খেলে আউট হলে সেটা হবে টাইটেনিয়াম ডাক
- যখন কোনো ব্যাটসম্যান ম্যাচ বা ইনিংসের প্রথম বলে আউট হন তখন সেটা হবে রয়েল ডাক
- যে ইনিংসের শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে শূন্য রান করে খেলা শেষ করবে সেটাকে বলে লাফিং ডাক এবং
- কোনো সিজনের শুরুর ম্যাচের প্রথম বলেই আউট হলে ওটাকে গোল্ডেন গুস ডাক।
হায়রে ডাক!
আন্তর্জাতিকভাবে ডাকের যাত্রা শুরু হয় ১৮৭৭ সালে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের একেবারে প্রথম টেস্ট ম্যাচ থেকেই। জেমস লিলিহোয়াইটের বলে নেড গ্রেগরির আউট হবার মধ্যে দিয়েই যাত্রা শুরু এই হংস ডিম্বের। এবং ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বপ্রথম শূন্যরানে আউট হওয়ার কীর্তি গড়েন অস্ট্রেলিয়ান উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান গ্রেম ওয়াটসন। এরপর থেকে ক্রিকেট ইতিহাসে সনাৎ জয়সুরিয়া, শহীদ আফ্রিদি, মাহেলা জয়াবর্ধনের মতো বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানরাও সর্বাধিক শূন্য রানে আউট হওয়ার রেকর্ড গড়েন। তবে তাদের মতো বিশ্বসেরা তারকা ব্যাটসম্যান না হয়েও পুরো ক্যারিয়ারে কখনোই শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাননি, তেমনি শীর্ষ সাত ব্যাটসম্যান সম্পর্কেই আজ আলোকপাত করা হবে।
৭. নাথান হরিজ (৩২ ইনিংস)
অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনে পদার্পন করেন নাথান হরিজ। তিনি সাধারণত ডানহাতি অফব্রেক বোলার হিসেবে দলের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যাট হাতে সেরকম কোনো স্কোর গড়তে পারেননি। তবে ৫৮ ম্যাচ খেলে ৩২ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে একজন বোলার হয়েও কখনোই শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাননি তিনি। এছাড়াও বল হাতে ৫৮ ম্যাচে ৪.৭৪ ইকোনমি রেটে ৬৩ উইকেট শিকার করেন নাথান হরিজ। ২০১৬ সালে সবধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
৬. ম্যাথিউ ক্রোস (৩৯ ইনিংস)
স্কটল্যান্ডের অন্যতম উইকেটরক্ষক ও ব্যাটসম্যান ম্যাথিউ ক্রোস। ২০১৪ সালে কানাডার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। অভিষেকের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৪৩টি ম্যাচ খেলে ৩৯ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে কোনো ম্যাচেই শূন্য রানে আউট হননি তিনি। আইসিসির সহকারী দলের একজন ক্রিকেটার হয়েও এই অসাধারণ একটি রেকর্ড তালিকায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দুটি শতকসহ সবমিলিয়ে ২২.৭৬ গড়ে ৮৬৫ রান সংগ্রহ করেছেন ক্রোস।
৫. জ্যাক রুডলফ (৩৯ ইনিংস)
দক্ষিণ আফ্রিকা দলের হয়ে ২০০৩ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় জ্যাক রুডলফের। ঐ বছরেই টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ডাবল সেঞ্চুরি করেন। টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স বজায় রাখলেও ওয়ানডেতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তাই ২০০৬ সালের পর ওয়ানডে স্কোয়াডে আর কখনোই দেখা মেলেনি তার।
তিন বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মোট ৪৫টি ম্যাচ খেলে ৩৯টি ইংনিসে ব্যাট হাতে ৩৫.৫৭ গড়ে মোট ১,১৭৪ রান সংগ্রহ করেন জ্যাক রুডলফ, যার মধ্যে কোনো ম্যাচেই শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে হয়নি তাকে, যা তাকে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে শূন্য রানে আউট না হওয়া ব্যাটসম্যানদের তালিকায় শীর্ষ পাঁচ নম্বরে জায়গা করে দিয়েছে। এরপর ২০১২ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
৪. পিটার কার্স্টেন (৪০ ইনিংস)
দক্ষিণ আফ্রিকার আরেক ব্যাটসম্যান পিটার কার্স্টেনও এই কীর্তি গড়েন। ১৯৯১ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মোট ৪০টি ইংনিংসে ব্যাট করতে নেমে কখনোই শূন্য রানে আউট হননি কার্স্টেন। ক্যারিয়ারে ৪০ ম্যাচে ৩৮.০২ গড়ে ১২৯৩ রান সংগ্রহ করেন তিনি। তিন বছরের সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দলে নেতৃত্বও দেন। অবশেষে ১৯৯৪ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহন করেন কার্স্টেন।
৩. যশপাল শর্মা (৪০ ইনিংস)
ভারতীয় ক্রিকেটের ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন যশপাল শর্মা। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক হওয়া এই ভারতীয় ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারে মোট ৪২টি ম্যাচ খেলেন। ৪০টি ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ২৮.৪৮ গড়ে ৮৮৩ রান সংগ্রহ করেন তিনি। এর মধ্যে কোনো বোলারই তাকে শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফেরাতে পারেনি। ফলে এই তালিকায় শীর্ষ তিন নম্বরে রয়েছেন যশপাল শর্মা। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সাত বছর কাটানোর পরে ১৯৯৫ সালের পর ভারতের জার্সিতে তাকে আর দেখা যায়নি।
২. সামিউল্লাহ শেনওয়ারি (৬৯ ইনিংস)
আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন সামিউল্লাহ শানওয়ারি। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও দলকে বেশ কিছু সফলতা এনে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় তার। অভিষেক ম্যাচেই হাফ সেঞ্চুরি করে শুভসূচনা করেন তিনি। ক্যারিয়ারে মোট ৭৯টি ম্যাচ খেলে ৬৯ ইনিংসে ব্যাট করে ২৯.৩৭ গড়ে ১,৭৩৩ রান সংগ্রহ করেন। এতগুলো ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে কখনোই শূন্য রানে ঘরে ফিরে যাননি এই আফগান অলরাউন্ডার।
১. কেপলার ওয়েসেলস (১০৫ ইনিংস)
ক্রিকেট ইতিহাসে দুই দেশের হয়ে ব্যাট হাতে টেস্ট সেঞ্চুরি ও হাজার রান করা একমাত্র খেলোয়াড় কেপলার ওয়েসেলস। দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কেপলারের অভিষেক হয় অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে। ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক হওয়া কেপলার ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে খেলেন।
এরপর ১৯৯১ সালে নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে অভিষেক হয় তার। এমনকি ১৯৯২ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে কেপলার মোট ১০৯ ম্যাচ খেলে ১০৫ ইংনিসে ব্যাট করে ৩৪.৩৫ গড়ে ৩,৩৬৭ রান সংগ্রহ করেন। শতাধিক ম্যাচে ব্যাট করেও শূন্য রান সাজঘরে না ফেরা একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি। ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। পরবর্তীতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে নাম লেখান ওয়েসেলস।