১৯৯৬ সালে নাইরোবিতে আফ্রিদির ৩৭ বলে ১০০ রানের ইনিংস দ্রুততম সেঞ্চুরি হিসেবে টিকে ছিল দীর্ঘ ১৮ বছর। যেটির মালিক কোরি এন্ডারসনের হাত ঘুরে এখন ডি ভিলিয়ার্স। ডি ভিলিয়ার্স সেই শতকটি হাঁকিয়েছিলেন মাত্র ৩১ বলে। অর্থাৎ ওডিআই ক্রিকেটে ৪০ বলের কমে শতক দেখেছে তিনটি। কিন্তু ফরম্যাটটায় যখন বিশ্বকাপ লাগানো হয়, সেক্ষেত্রে ৪০ তো দূরে থাক, ৫০ বলের নিচেই নেই কারো শতক। না থাকাটাই স্বাভাবিক। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চ আর বড় প্রতিপক্ষের সাথে ব্যাট হাতে ছেলেখেলা করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরও বিশ্বকাপ দেখেছে বেশ কিছু দ্রুততম শতক। আজ আমরা দেখবো বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম দশটি শতক।
১০. ব্র্যাড হজ (৮২ বল)
প্রতিপক্ষ : নেদারল্যান্ড (২০০৭)
সেন্ট কিটসে গ্রুপপর্বে মুখোমুখি হয় এই দুই দল। ডেভিড আর গোলিয়াথের এই লড়াইয়ে সহজেই জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। প্রথমে ব্যাট হাতে ব্র্যাড হজের অতিমানবীয় ইনিংসে অজিরা দাঁড় করায় ৩৫৮ রানের সংগ্রহ। বিনিময়ে নেদারল্যান্ড গুটিয়ে যায় ১২৯ রানে। ব্যাট হাতে ব্র্যাড হজ হাঁকান ৭টি ছয় আর ৬টি চার। শতক তুলে নেন মাত্র ৮২ বলেই।
৯. ক্লাইভ লয়েড (৮২ বল)
প্রতিপক্ষ: অস্ট্রেলিয়া (১৯৭৫)
ক্লাইভ লয়েড ছাড়া এই তালিকাটিই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। শুধুমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া ক্রিকেটারই নন, ব্যাট হাতেও সব বিস্ফোরক ইনিংস উপহার দেওয়া ক্লাইভ লয়েড বোলারদের জন্য ছিলেন ত্রাস। প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালেই ‘অধিনায়কোচিত’ এক ইনিংস খেলেন লয়েড। তার ৮২ বলে ১০০ এর উপর ভর করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সংগ্রহ করে ২৯১ রান। অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত ২৭৪ রান করে হেরে যায় মাত্র ১৭ রানে। দুর্দান্ত শতকের জন্য ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতলেন লয়েড। আর ফাইনালে দ্রুততম শতকের এই রেকর্ডটি টিকে ছিল ৩২ বছর। ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে এসে তা ভাঙেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।
৮. বীরেন্দর শেবাগ (৮১ বল)
প্রতিপক্ষ : বারমুডা (২০০৭)
২০০৭ বিশ্বকাপের কথা ভুলেই যেতে চাইবে ভারত। তবে বীরেন্দর শেবাগ চাইলেও অবশ্য ভুলতে পারবেন না। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাথে হেরে গ্রুপপর্বে বাদ পড়ে গেলেও ভারত নিজেদের সেরা খেলা জমিয়ে রাখে বারমুডার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে শেবাগের ৮১ বলের শতকের উপর দাঁড়িয়ে ভারত সংগ্রহ করে ৪১৪ রান, যা কি না এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করার রেকর্ড। ৮১ বলে সেঞ্চুরি করা শেবাগ শেষ পর্যন্ত থামেন ১১৪ রানে। ভারতও ম্যাচটি জিতে নেয় ২৫৭ রানের বিশাল ব্যবধানে।
৭. অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৭২ বল)
প্রতিপক্ষ : শ্রীলঙ্কা (২০০৭)
বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্লাইভ লয়েডের করা ৮২ বলের শতকের রেকর্ড ৩২ বছর পরে এসে ভাঙেন অস্ট্রেলিয়ান হার্ডহিটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হওয়া শ্রীলঙ্কান বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে মাত্র ৭২ বলে শতক তুলে নেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১০১ বলে করেন ১৪৯ রান, যেটি কি না বিশ্বকাপ ফাইনালে করা সর্বোচ্চ ইনিংস। তার কাঁধে সওয়ার হয়েই অস্ট্রেলিয়া সংগ্রহ করে ৩৮ ওভারে ২৮১ রান।
গিলক্রিস্টের অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ে এমনিতেই আশা হারিয়ে ফেলা শ্রীলঙ্কা শেষমেশ ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে হারে ৫১ রানে। অস্ট্রেলিয়া ঘরে তোলে টানা তিন বিশ্বকাপ শিরোপা।
৬. কপিল দেব (৭২ বল)
প্রতিপক্ষ : জিম্বাবুয়ে (১৯৮৩)
এই একমাত্র বিখ্যাত ইনিংসটিরই কোনো ভিডিও সংগ্রহে নেই আইসিসির। সেদিন ক্যামেরাম্যান বলের আঘাত পাওয়ায় কপিল দেবের এই বিখ্যাত ইনিংসটি পরবর্তীতে আর কারো দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
সেমিফাইনালের টিকেট কাটতে হলে জিততেই হবে, এই সমীকরণে দাঁড়িয়ে কপিল খেলেন দুর্দান্ত ইনিংস। ৭২ বলে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েই ক্ষান্ত হননি, শেষ পর্যন্ত করেন ১৭৫ রান। অথচ শুরুতে ১৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল ভারত। সেখান থেকে দলকে উদ্ধার করেন ‘ক্যাপ্টেন’ কপিল। ভারতের ২৬৬ রানের মধ্যে ১৭৫ রানই ছিল তার। ৬টি ছয় ও ১৬টি চারের সাহায্যে এই রান সংগ্রহ করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জিম্বাবুয়েকে ৩১ রানে হারিয়ে শুধু সেমিফাইনালই নয়, পরবর্তীতে বিশ্বকাপই জিতে নেয় কপিল দেবের ভারত।
৫. জন ডেভিসন (৬৭ বল)
প্রতিপক্ষ : ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০৩)
এই তালিকায় সবচেয়ে চমকজাগানিয়া নাম হচ্ছে জন ডেভিসনের। এই কানাডিয়ান ব্যাটসম্যান তৎকালীন সময়ে বিশ্বকাপের সবচেয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ৬৭ বলে ১০০ রান করেন ডেভিসন। তার করা ১১১ রানের ইনিংসে ছিল ৬টি ছয় ও ৮ টি চার। তবে বাকি কোনো কানাডিয়ান ব্যাটসম্যানই দাঁড়াতে না পারায় দলীয় মোট সংগ্রহ দাঁড়ায় মাত্র ২০২, যা ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেরিয়ে যায় মাত্র ৩০ ওভারেই। ম্যাচ হারলেও এই ইনিংস দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান জন ডেভিসন।
৪. ম্যাথু হেইডেন (৬৬ বল)
প্রতিপক্ষ : দক্ষিণ আফ্রিকা (২০০৭)
গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। শুরুতেই আফ্রিকান বোলারদের উপর তান্ডব চালান গিলক্রিস্ট আর হেইডেন। তবে শন পোলকের উপর ঝড়টা একটু বেশিই ছিল, তার উপর চওড়া হয়েছিলেন হেইডেন। শুধু পোলকই নয়, বাকি সব বোলারদের পাড়ার বোলারের পর্যায়ে নামিয়ে এনে ৬৬ বলে শতক তুলে নেন হেইডেন। তৎকালীন সময়ের দ্রুততম বিশ্বকাপ শতক হাঁকান এই অজি ওপেনার। অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহেও দাঁড়ায় ৩৭৭ রানের বিশাল রান। তাড়া করতে নেমে ডি ভিলিয়ার্সের ৯২ রানের পরও ৮৩ রানের হার বরণ করে নিতে হয় প্রোটিয়াদের।
৩. এবি ডি ভিলিয়ার্স (৫৫ বল)
প্রতিপক্ষ : ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০১৫)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলাররা তো বটেই, সিডনির দর্শকরাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন ডি ভিলিয়ার্সের ক্যামিওতে। মাত্র ৫৫ বলে শতক হাকানোর পরও থামেননি এবি, শেষ পর্যন্ত ২৪৫ স্ট্রাইকরেটে করেন ৬৬ বলে ১৬২ রান। ১৭টি চার ও ৮টি ছয় মারার পথে মাত্র সাতটি ডট বল খেলেন ‘৩৬০ ডিগ্রি’খ্যাত এই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান। এবি’র দানবীয় ইনিংসের উপর ভর করেই ৪০৮ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
২. গ্লেন ম্যাক্সওয়েল (৫১ বল)
প্রতিপক্ষ : শ্রীলঙ্কা (২০১৫)
এর আগে পাঁচবার নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে আউট হওয়া ম্যাক্সওয়েলের তখনও কোনো আন্তর্জাতিক শতক ছিল না। প্রথম শতকের জন্য তিনি বেছে নেন বিশ্বকাপের মঞ্চকেই। তবে শুধু শতকই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম ইনিংসের মালিকও বনে যান এই অজি ব্যাটসম্যান। ১০টি চার ও ৪ ছয়ের সাহায্যে ৫১ বলে শতক তুলে নেন তিনি।
একটা সময় মনে হচ্ছিল, দ্রুততম বিশ্বকাপ শতকের রেকর্ডটি নিজেরই করে নেবেন ম্যাক্সওয়েল। তবে লেগ বাইয়ের কারণে একটি বল মিস করায় শেষ পর্যন্ত ৫১ বলে শতক হাঁকিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে।
১. কেভিন ও’ব্রায়েন (৫০ বল)
প্রতিপক্ষ : ইংল্যান্ড (২০১১)
বিশ্বকাপের নখ কামড়ানো উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের মধ্যে ইংল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ডের এই ম্যাচটি অন্যতম। প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড দাঁড় করায় বড় একটা সংগ্রহ, ৩২৭ রান। যেকোনো দলের জন্যই এটা বড় লক্ষ্য। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ড তো এমনিই শক্তিমত্তার দিক থেকে আরো পিছিয়ে। তবে দিনটি নিজের করে নেওয়ার কথাই ভাবলেন কেভিন ও’ব্রায়েন।
যখন এই আইরিশ ব্যাটসম্যান ক্রিজে এলেন, তখন ২৪ ওভার শেষে ১১১ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে আয়ারল্যান্ড। পরবর্তী ১০ ওভারেই খেলার মোড় একাই ঘুরিয়ে দেন কেভিন, মাত্র ৫০ বলে ১০০ রান করেন তিনি। ১৩টি চার ও ৬টি ছয়ের মারে শেষ পর্যন্ত ১১৩ রানে রানআউট হন তিনি। তার আগে দলকে প্রায় জয়ের বন্দরে ফিরিয়েই তবে ড্রেসিংরুমে ফেরত যান কেভিন। আর পাশাপাশি বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম শতকের মালিকও বনে যান কেভিন ও’ব্রায়েন।
বর্তমানে টি-টোয়েন্টির যুগে যেকোনো কিছুই সম্ভব। তাই বলা যায়, খুব শীঘ্রই দ্রুততম শতকের রেকর্ডটি হয়তো আরেকবার হাতবদল হবে। কে জানে, এই বিশ্বকাপেই হয়তো রেকর্ডটি নিজের করে নেবেন কোনো মারকুটে ব্যাটসম্যান। সেইজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র এক মাস!