‘নিউজিল্যান্ডে পেসাররা প্রচুর বোলিং করার সুযোগ পাবে। ওখানে পেসাররাই বেশি বোলিং করবে, স্পিনাররা না।’
বক্তার নাম সাকিব আল হাসান। গত ডিসেম্বরে (২০১৮ সাল) দেশের মাটিতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাই নিশ্চিত করার দিন সংবাদ সম্মেলনে কথাগুলো বলেছিলেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে দুই টেস্টেই চার স্পিনার খেলিয়েছিলো বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে একজন পেসার হিসেবে মুস্তাফিজুর রহমান একাদশে ছিলেন। ঢাকা টেস্টে ‘পেসার’ নামটিই একাদশ থেকে পুরোই ছাঁটাই করে ফেলা হয়েছিলো। সিরিজশেষে দেশের মাটিতে পেসারদের সুযোগ না পাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরেই উপরের কথাটি বলেছিলেন সাকিব।
নিউজিল্যান্ড সফর আপাতত শেষ বাংলাদেশ দলের। প্রথম দুই টেস্টেই স্বাগতিকদের কাছে ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে সাকিবহীন বাংলাদেশ। ব্যাটিং, বোলিং দুই বিভাগেই নিউজিল্যান্ডের কাছে পাত্তা পায়নি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল। নিল ওয়াগনার, টিম সাউদিদের উপর্যুপরি বাউন্সার, শর্ট বলে নাকাল হয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ২২ গজে তামিম-মুমিনুলদের জীবন বিষিয়ে তুলেছিলেন কিউই পেসাররা।
আবার একই উইকেটে নিষ্ক্রিয়, বিবর্ণ, অকার্যকর হিসেবে মূর্ত হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের পেসাররা। সবুজ ঘাসের গালিচায় মুস্তাফিজুর রহমান, এবাদত হোসেন, খালেদ আহমেদ, আবু জায়েদ রাহীদের নির্বিষ বোলিং আলোচনার খোরাক হয়েছে সর্বত্র। হ্যামিল্টন, ওয়েলিংটন টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে তিনজন করে পেসার ছিল। দুই ম্যাচে পেসারদের অবদান মাত্র পাঁচ উইকেট, যা সত্যিই দৃষ্টিকটু।
দলের চাহিদা মেটাতে পারছেন না পেস বোলাররা। বল হাতে ভরসা হতে পারছেন না। পেস-বাউন্সি কন্ডিশনেও তাদের নখদন্তহীন বোলিং হতাশা বাড়াচ্ছে সবার মাঝে। হ্যামিল্টনে তিন পেসার (রাহী-এবাদত-খালেদ) মিলে বোলিং করেছিলেন ৮৭ ওভার, শুধু এবাদত হোসেন একটি উইকেট নিয়েছেন। ওয়েলিংটনে তিন পেসার বোলিং করেছেন ৪৮.৫ ওভার, উইকেট পেয়েছেন চারটি, যার মধ্যে রাহী তিনটি ও মুস্তাফিজ একটি উইকেট পান।
নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের পেসারদের এমন ক্লান্তিকর বোলিং, উইকেট নিতে না পারার ইতিহাস নতুন নয়। ২০১৭ সালেও নিউজিল্যান্ড সফরে দু’টি টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। সেবার তাসকিন আহমেদ, শুভাশীষ রায়, রুবেল হোসেন, কামরুল ইসলাম রাব্বি ছিলেন পেস আক্রমণে। ওয়েলিংটন টেস্টে এই পেসারত্রয়ী (তাসকিন, শুভাশীষ, রাব্বি) ৮১.২ ওভার বোলিং করেছিলেন প্রথম ইনিংসে, উইকেট পেয়েছিলেন ৬টি। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮ ওভারে তারা পান এক উইকেট। এরপর ক্রাইস্টচার্চে খেলেছিলেন তাসকিন, রুবেল, রাব্বি। প্রথম ইনিংসে ৫৮ ওভার বোলিং করে তারা নিতে পেরেছিলেন ৩ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং করেছেন তাসকিন ও রাব্বি, তারা ৮ ওভারে ১ উইকেট পান।
সবুজ ঘাসের উইকেটেও কেন ব্যর্থ পেসাররা?
স্পিনিং উইকেটের কারণে দেশের মাটিতে একাদশেই ঠাঁই হচ্ছে না পেসারদের। ঘরোয়া ক্রিকেটেও (জাতীয় লিগ, বিসিএল) চারদিনের ম্যাচে তাদের কদর কম। তাদের প্রতি ভরসা করা হয় বিদেশের মাটিতে। কিন্তু দেখা গেলো, নিউজিল্যান্ডের পেস-বাউন্সি কন্ডিশনেও বাংলাদেশের পেসাররা নিষ্প্রভ।
সবুজ ঘাসের উইকেটেও বোলিংয়ে প্রাণ ফেরাতে পারছেন না মুস্তাফিজ-এবাদতরা। কিন্তু তা কেন? এমন সব জিজ্ঞাসার জবাব মিলেছে বাংলাদেশের পেস বোলিং বিশেষজ্ঞ সরোয়ার ইমরানের কাছে। বর্ষীয়ান এই বোলিং কোচ বাংলাদেশের বেশিরভাগ পেস বোলারের কাছেই পিতৃতুল্য। জাতীয় দলের হেড কোচ ছিলেন, অভিষেক টেস্টের কোচ ছিলেন, পেসার হান্টের বিচারকসহ দেশের স্বীকৃত সব পেসারদের বেড়ে উঠার শুরুটা তার হাতের উপর দিয়েই।
মুস্তাফিজদের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের এসব কন্ডিশনে বোলিংয়ের অভ্যাস না থাকার কথাই বলেছেন সারোয়ার ইমরান। তিনি বলেছেন,
‘এগুলো প্র্যাকটিস করতে হবে, অভ্যাস করতে হবে। এখানে তো ওই ধরনের উইকেট নাই। সবুজ উইকেট বলেই উল্টাপাল্টা বাউন্স, এমন কিছু নয়। ভালো উইকেট ছিল। কিন্তু এই উইকেটে যেভাবে বল করতে হয়, উইকেট নিতে হয়, সেগুলো আমাদের জানা নাই। আর বোলারগুলোও সবই নতুন বোলার। মুস্তাফিজের সঙ্গে যে তিনজন খেলছে, সবাই নতুন।’
এবাদত-খালেদদের অনভিজ্ঞতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সত্যিই পেস আক্রমণ ছিল অনভিজ্ঞ। সরোয়ার ইমরানের মতে, দেশের মাটিতে এমন উইকেটে অনুশীলনের সুযোগ দেয়া উচিত তরুণদের। ঘরোয়া ক্রিকেটে অন্তত এমন আচরণের একটি উইকেট থাকা উচিত। তিনি বলেছেন,
‘আমাদের এখানেও আমরা যখন চারদিনের ম্যাচগুলো খেলবো, এ ধরনের উইকেটে আমাদের খেলা উচিত। সবুজ ঘাসের উইকেটে খেলা উচিত। আমাদের এনসিএল, বিসিএলে এমন উইকেট দেয়া উচিত। আমরা হয়তো বিদেশি দল আসলে আমাদের এখানে স্পিনিং উইকেটেই খেলবো, আমাদের হোম কন্ডিশনের সুবিধার জন্য। তবে বিদেশির মাটিতে আমরা যাতে মোটামুটি লড়াইটা অন্তত করতে পারি, সেজন্য আমাদের এসব উইকেটে ম্যাচ খেলা উচিত।’
বোলিংয়ে ওয়াগনার ক্রমাগত শরীর তাক করে বাউন্সার মেরে গেছেন। একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন সাউদিও। মূলত সুইং বোলার হলেও অনেক সময় বল সুইং না করাতে পেরে ট্রেন্ট বোল্টও বাউন্সারের অবলম্বন নিয়েছেন। একইভাবে বাউন্সার র্ফমুলায় হেঁটেছিলেন বাংলাদেশের পেসাররাও। কিন্তু তাদের বাউন্সার পরীক্ষায় ফেলতে পারেনি উইলিয়ামসন-রস টেইলরদের।
সারোয়ার ইমরান বলেছেন, লেন্থ ঠিক ছিল না বাংলাদেশের বোলারদের। বেশি শর্ট থেকে বাউন্সার মারার চেষ্টা করেছেন এবাদত-খালেদরা। তিনি বলেছেন,
‘ওখানে জোরে বল করতে হয়। সুইং করাতে হয়। রাহী কিছুটা সুইং করিয়ে সফলতা পেয়েছে। বাকিরা ১৩০-৩৫ কিমি’তে বল করে গেছে। তারপর বাউন্সারের যে নিশানা, এগুলোর অনেক ব্যাপার আছে। আমরা অনেক শর্ট থেকে বাউন্সার মারি। ওরা কিন্তু মোটামুটি শর্ট অব লেন্থ থেকে বাউন্সার করছে।’
দেশের উইকেটে যেই লেন্থ ব্যবহার করে বাউন্সার মারেন, নিউজিল্যান্ডেও একই লেন্থ থেকে বাউন্সার মেরেছেন মুস্তাফিজ-রাহীরা। সারোয়ার ইমরান বলেছেন,
‘আসলে ওই লেন্থ থেকে আসা বাউন্সারটা ওখানে কাজ হবে না। আমাদের এখানে উইকেটগুলোতে বাউন্সার অনেকগুলো উঠে, আবার অনেকগুলো উঠে না। কিন্তু ওখানে ট্রু উইকেট একদম, শর্ট-বাউন্সার মারলে উঠবেই বল। এমন জায়গা থেকে শর্ট মারতে হবে, যাতে ব্যাটসম্যানের অসুবিধা হয়। কিন্তু আমরা ওই জিনিসটা করতে পারিনি। আমরা বেশি অনেক শর্ট থেকে বাউন্সার মারছি, যেভাবে আমরা এখানে মারি। এগুলো আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হবে। এসব উইকেটে বোলিং করার বিষয়টা আমাদের শিখতে হবে। ওইটা শিখতে হলে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে এসবের অনুশীলন করতে হবে।’
টেস্টে বরাবরই অনুজ্জল বাংলাদেশের পেস আক্রমণ
ক্রিকেটের অভিজাত আঙিনায় বাংলাদেশের বিচরণ ১৮ বছরের। টগবগে যুবক হলেও টেস্টের অন্যতম সৌন্দর্য ফাস্ট বোলিংয়ে বাংলাদেশ এখনও নবীশ পর্যায়ে রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন ৩৯ পেসার। অবাক করা হলেও সত্য, ১১৪ টেস্টের (নিউজিল্যান্ড সফরের তৃতীয় টেস্ট বাদে) ইতিহাসে বাংলাদেশের পেসাররা ইনিংসে ৫ উইকেট নিতে পেরেছেন মাত্র আটবার! যার মধ্যে শাহাদাত হোসেন রাজীবই নিয়েছেন চারবার। নিজের স্বর্ণ সময় পেরিয়ে এসেছেন এই ডানহাতি পেসার। সম্প্রতি ক্রিকেটকে বিদায় বলা রবিউল ইসলাম নিয়েছেন দুইবার। মঞ্জুরুল ইসলাম ও রুবেল হোসেন একবার করে নিয়েছেন ইনিংসে পাঁচ উইকেট। সাদা পোশাকে বাংলাদেশের কোনো পেসার পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ছয় বছর আগে!
২০১৩ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭১ রানে ছয় উইকেট নিয়েছিলেন রবিউল ইসলাম শিবলু। আটবার পাঁচ উইকেট নেয়ার মধ্যে পাঁচবারই এই কীর্তি হয়েছিলো বিদেশের মাটিতে। এমন হাড্ডিসার পরিসংখ্যানই বাংলাদেশের পেসারদের দৈন্যচিত্র তুলে ধরতে যথেষ্ট।
২০১৬ সালের পর থেকে গত তিন বছরে টেস্টে বাংলাদেশের ১৭ জন ক্রিকেটারের অভিষেক হয়েছে, যার মধ্যে পেসার ছিলেন ৬ জন। ২০১৬তে চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক হয়েছিল কামরুল ইসলাম রাব্বির, যিনি এখন জাতীয় দলের ধারেকাছেও নেই। সাত টেস্টে ৮ উইকেট নিয়েছেন তিনি। ২০১৭তে ওয়েলিংটনে অভিষেক হয় তাসকিন ও শুভাশীষের। তাসকিন ৫ টেস্টে ৭ উইকেট ও শুভাশীষ ৪ টেস্টে ৯ উইকেট নিয়েছেন। তাসকিন আলোচনায় থাকলেও শুভাশীষ এখন জাতীয় দলকেন্দ্রিক সব ধরনের চিন্তাভাবনার বাইরে।
বারবার অনভিজ্ঞদের দেশের বাইরে পাঠানো, সম্ভাবনা নিয়ে তরুণ পেসারদের আসা এবং কয়েক টেস্ট পর হারিয়ে যাওয়া, তাদের ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতিও সত্যিকারের টেস্ট পেসার না পাওয়ার বড় কারণ। সারোয়ার ইমরান এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার এবং টেস্টের জন্য পেসারদের গড়ে তোলার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলেছেন। টেস্টে পেসারদের এই অকার্যকর বোলিংয়ের ইতিহাস ঠেকাতে অভিজ্ঞ এই কোচের পরামর্শ, ন্যাশনাল ফাস্ট বোলিং একাডেমি করতে হবে।
পেসারদের উন্নতিতে বিসিবির করণীয় বলতে গিয়ে সারোয়ার ইমরান বলেছেন,
‘শুরুতে দরকার একটা ন্যাশনাল ফাস্ট বোলিং একাডেমি। ওখানে আপনার ১৫-২০টা ফাস্ট বোলার থাকবে, যারা জাতীয় দল, ‘এ’ দল, এইচপি, অনূর্ধ্ব-১৯ খেলবে। জাতীয় দলে যদি কখনো ঘাটতি হয়, এখান থেকে ফাস্ট বোলার নিবে।’
ফাস্ট বোলিং একাডেমির রূপরেখা নিয়েও ধারণা দিয়েছেন এই পেস বোলিং বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেছেন,
‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য তেমন পরিচর্যা করতে হবে। কার উচ্চতা আছে, কে সুইং করাতে পারে, কে জোরে বোলিং করতে পারে, এসব কিছু বিবেচনা হবে। ন্যাশনাল একাডেমিতে সারা বছর কোচ, ট্রেনার, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট থাকতে হবে। একাডেমি থেকেই রিপোর্ট যাবে, এই বোলার এমন অবস্থায় আছে। ধরেন একজন জাতীয় দলে খেলবে, তখন পাশাপাশি ঠিক করা হবে, এই বোলার ইনজুরিতে পড়লে কে যাবে, তাকেও প্রস্তুত রাখতে হবে। প্ল্যান এ, বি, সি, ডি ঠিক রাখতে হবে।’
বিসিবির কোচিং স্টাফে বর্তমান দুজন পেস বোলিং কোচ আছেন। জাতীয় দলে কোর্টনি ওয়ালশের মতো কিংবদন্তি, এর বাইরে শ্রীলঙ্কান চম্পকা রমানায়েকে। ওয়ালশ অবশ্য বারবারই বলছেন, পেসারদের সুযোগ দিতে। প্রতি সিরিজে নতুন বোলার আনলে লাভ হবে না। রমানায়েকে একদম নবীনদের নিয়ে কাজ করছেন।
কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের লেজ-গোবরে ধারহীন পেস বোলিংয়ের র্দুনামটা ঘুচছে না। সারোয়ার ইমরান, ওয়ালশ, রমানায়েকে, যার পরামর্শই বিসিবি গ্রহণ করুক না কেন, এখন এটা স্পষ্ট, পেসারদের নিয়ে বিসিবির দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করতেই হবে। নাহলে সাদা পোশাকে দ্রুতগতির বোলারদের নিয়ে হতাশা, হাহাকার থামবে না।