সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যাপ্তি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরো সহজ করে দেয়ার জন্য প্রতি বছরেই আসছে বেশ কিছু প্রযুক্তিপণ্য এবং সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০১৭ সালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এ বছর স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, গেমিং কনসোল, সাউন্ড সিস্টেমসহ নানারকম গ্যাজেট উন্মুক্ত করেছে বিভিন্ন কোম্পানি। এছাড়া পুরাতন সংস্করণের গ্যাজেটের সাথেই যোগ হয়েছে অনেক আকর্ষণীয় ফিচার।
আইফোন এক্স
অ্যাপলের সর্বশেষ আইফোন সংস্করণটি আগের আইফোনগুলোর তুলনায় পরিবর্তিত হয়েছে অনেক বেশি। নতুন এ সংস্করণটিতে নেই কোনো হোম বাটন এবং টাচ-আইডির বদলে যুক্ত হয়েছে অ্যাপলের নিজস্ব ফেস-আইডি প্রযুক্তি। এটি একধরনের বায়োমেট্রিক সিস্টেম, যার মাধ্যমে আইফোন এক্স মুখমন্ডল বিশ্লেষণের সাহায্যে প্রকৃত ব্যবহারকারী চিনতে সক্ষম। অ্যাপল ফেস-আইডি এবং এয়ারপড প্রযুক্তির পিছনে প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই দুটি প্রযুক্তি অ্যাপলের জন্য আরো অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। অনেকেই নতুন আইফোনের গতি এবং ক্যামেরার কর্মক্ষমতা নিয়ে সংশয়ে ভুগছিলেন, তাদের জন্যও রয়েছে সুসংবাদ।
আইফোন এক্সকে বলা হচ্ছে আইফোনের ভবিষ্যৎ। একদমই নতুন এই আইফোন সংস্করণটি পরবর্তী আইফোনগুলোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
গ্যালাক্সি এস৮/এস৮ প্লাস
এই বছরটিকে স্মার্টফোনপ্রেমীদের জন্য বেশ পয়মন্ত বলা যায়। তবে এবারের সুসংবাদটি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য।
গ্যালাক্সি এস৮ এবং এস৮ প্লাস এর মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্যামসাং। অনেকেই মনে করেন, এস৮ এবং এস৮ প্লাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অত্যাধুনিক হার্ডওয়্যারের সন্নিবেশ ঘটিয়েছে এই কোম্পানিটি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ১২ মেগাপিক্সেলের শক্তিশালী ক্যামেরা এবং আকর্ষণীয় ইনফিনিটি ডিসপ্লে। চারদিকের ফ্রেমের একেবারে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত এই ডিসপ্লে, বোঝাই যাবে না কোনো ফ্রেম আছে। অবশ্য ডিসপ্লের দিক থেকে স্যামসাং এর প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বললেই চলে, এমনকি অ্যাপল পর্যন্ত স্যামসাংয়ের সাহায্য নিয়েছিলো তাদের নতুন আইফোনের ডিসপ্লে তৈরির জন্য।
তবে স্যামসাং সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাবে তাদের বিক্সবি প্রজেক্টের কারণে। এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে ভয়েস, টেক্সট কিংবা টাচের সাহায্যে স্মার্টফোন নিয়ন্ত্রণ। মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে থাকা সত্ত্বেও বিক্সবি নিয়ে স্যামসাং বেশ বড় একটি ঝুঁকি নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, ২০১৭ সালে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য স্যামসাং এর গ্যালাক্সি এস৮/এস৮ প্লাস ছিল অদ্বিতীয়।
সারফেস ল্যাপটপ
ম্যাকবুকের আধিপত্য অস্বীকার করা না গেলেও মাইক্রোসফটের সারফেস প্রো জানান দিয়েছে ল্যাপটপ ডিজাইনের দিক থেকে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য যা দরকার সবই আছে এই সারফেস প্রো ল্যাপটপে। ল্যাপটপটির উল্লেখযোগ্য কনফিগারেশন হলো সপ্তম জেনারেশনের ইনটেল কোর আই-৫ কিংবা কোর আই-৭ প্রসেসর, দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারী এবং ১৩.৫ ইঞ্চি ডিসপ্লে। এটি আগের সংস্করণগুলো থেকে আরো দ্রুত কাজ করে। এছাড়া সারফেস প্রোর অপারেটিং সিস্টেম খুব সহজেই আপডেট করা যাবে উইন্ডোজ ১০ প্রোতে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা হার্ডওয়্যারের পূর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন।
কোনো সন্দেহ নেই, মাইক্রোসফটের ল্যাপটপ সারফেস লাইন ধীরে ধীরে আরো উন্নত হবে। এখনও অনেক ক্ষেত্র আছে যেগুলো আরও আপডেট করলে এই সংস্করণটি হবে একটি পরিপূর্ণ হাইব্রিড নোটবুক। তবুও এরই মধ্যে সারফেস প্রো সবার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। স্মার্টফোনে এখন পর্যন্ত খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি মাইক্রোসফট, কিন্তুু ডিভাইসের প্রতিযোগিতায় সারফেসের মাধ্যমে একটু হলেও জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
এক্সবক্স ওয়ান এক্স
এ বছরই মাইক্রোসফট তাদের গেমারদের জন্য আরও উন্নত সংস্করণে এক্সবক্স ওয়ান এক্স গেমিং কনসোল উন্মুক্ত করে এবং পূর্ববর্তী সংস্করণ এক্সবক্স ওয়ান এর উৎপাদন বন্ধের আগাম ঘোষণাও দিয়ে রাখে তারা। এক্সবক্সের প্রধান ফিল স্পেন্সার বলছিলেন, আকৃতিতে বাকি এক্সবক্সগুলোর থেকে ছোট হলেও এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী গেমিং কনসোল। ফোর-কে আল্ট্রা এইচডি রেজুলেশনের ডিসপ্লে বিশিষ্ট এই কনসোলে মিনিটে চলতে পারে ৬০টি ফ্রেম।
২০১৬ এর নভেম্বরে ফোর-কে সমর্থন করে এমন কনসোল উন্মোচন করেছিলো সনি। কিন্তু সনি পিএস৪ প্রো এর মেমোরি এবং প্রসেসরের গতিসহ অন্যান্য স্পেসিফিকেশনে এক্সবক্স ওয়ান এক্স-এর চেয়ে কম। এক্সবক্স ওয়ান এক্স-এর র্যাম যেখানে ১২ জিবি সেখানে পিএস৪ প্রো-এর র্যাম ৮ জিবি। আর ৬ টেরাফ্লপ পর্যন্ত গ্রাফিক্স প্রসেস করতে পারে এক্সবক্স ওয়ান এক্স, কিন্তু পিএস৪ প্রো-এর গ্রাফিক্স প্রসেসিং ক্ষমতা ৪.১২ টেরাফ্লপ। সনির চেয়ে আরও বেশি সংখ্যক ফোর-কে গেম খেলা যাবে এক্সবক্স এই নতুন সংস্করণের মাধ্যমে।
নিনটেন্ডো সুইচ
গেমাররা সাধারনত গেমিং কনসোল ব্যবহার করে বড় আকারের টিভিতেই গেম খেলেন। বড় আকারের মনিটরের এই ধারণা বদলে দিতে বাজারে এসেছিল নিনটেন্ডো সুইচ। এতে আছে ৬.২ ইঞ্চি ডিসপ্লের একটি ট্যাব, যার দু’পাশে জয়-কন কন্ট্রোলার যুক্ত করে খেম খেলা যাবে। হঠাৎ কোথাও বেড়াতে গেলে কিংবা বাসার বাইরে থাকলে নিনটেন্ডো সুইচ ভালো সঙ্গী হতে পারে। আবার বাসায় থাকলে ডিভাইসটি টিভির সাথে যুক্ত করে বড় পর্দায় খেলা যাবে অনেক গেম। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে ইতোমধ্যে ১০ মিলিয়নের বেশি নিনটেন্ডো সুইচ বিক্রি হয়েছে।
সোনোস ওয়ান
গুগোলের হোম এবং আমাজনের একোস এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে সোনোস ওয়ান এর। একোস কিংবা হোম যে কাজগুলো করে, তার সবকিছুই করতে পারে সোনোস ওয়ান। কিন্তু এরই সাথে এই সাউন্ড সিস্টেম নিশ্চিত করে আরও বেশি নিখুঁত শব্দ, যা শোনা যায় অনেক দূর থেকেও। অনেকের কাছে অবশ্য কোনো স্পিকারের জন্য এই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু কেউ যদি শব্দ-নিয়ন্ত্রিত একটি স্পিকার তার ঘরে রাখতেই চায়, তাহলে সে অপেক্ষাকৃত শ্রুতিমধুর স্পিকারটি কেন রাখবে না? ধারণা করা হচ্ছে, গুগল এসিস্ট্যান্টের সাথে যুক্ত হয়ে আগামী বছরের কোনো একসময় বাজারে আসবে সোনোস ওয়ানের নতুন সংস্করণ।
মাইটি
অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই আইপড শাফলের মতো দেখতে এই ডিভাইসটি চলে এসেছে অনেকের পছন্দের তালিকায়। আকারে বেশ ছোট হওয়ায় এটিকে যেকোনো জায়গাতেই নিয়ে যাওয়া যাবে। ব্যায়াম করতে করতে কিংবা হাঁটতে হাঁটতে গান শুনতে এই ডিভাইসটির জুড়ি নেই। কিন্তু কিছু কিছু অ্যাপ চালানোয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তারপরও সবজায়গায় বহন করা যায় এরকম একটি ডিভাইসের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে থাকবেই।
সনি WH-1000XM2
সবাই মনে করছেন, যতগুলো হেডফোন এখন পর্যন্ত বাজারে এসেছে, তাদের মধ্যে সনির এই হেডফোনটিই বছরের সেরা। এর শব্দের মান পুরাতন সংস্করণের মতোই। তবুও অনেকগুলো ভালো হেডসেটের ভিড়ে এটিকে শীর্ষে রাখার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে এটি অসম্ভব পারদর্শী। আপনি কোনো কোলাহলপূর্ণ জায়গায় থাকলে এই হেডফোনটি অনেক সুবিধা দেবে।
দ্বিতীয়ত, হেডফোনটির সবচেয়ে উল্লেখয়োগ্য দিক হলো ৩০ ঘন্টারও বেশি ব্যাটারি লাইফ এবং সেইসাথে ব্লু-টুথ প্রযুক্তি। বাজারে শব্দের মানের দিক থেকে হয়তো আরো ভালো হেডসেট পাওয়া যাবে, কিন্তু সবকিছু বিবেচনা করলে সনি WH-1000XM2-কে সবার উপরেই রাখতে হবে।
ডিজেআই স্পার্ক
এমন একটা সময় ছিল, যখন মোটামুটি ভালোমানের একটি ড্রোন কিনতে গেলে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হতো। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে অবস্থা পাল্টে গেছে। কারণ চীনের ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডিজেআই এর ডিজেআই স্পার্ক নামের এই ড্রোনটির মূল্য সর্বসাধারণের হাতের নাগালে।
ড্রোনটি আকারে খুব ছোট হওয়ায় হাতের তালুতে রাখা যাবে। এটিকে চালানো যায় খুব সহজে, কোনো ধরনের মোবাইল কিংবা কন্ট্রোলারেরও প্রয়োজন হবে না। শুধুমাত্র হাতের ইশারাতেই এই ড্রোনটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, উপরে উঠানো কিংবা নিচে নামানো যাবে। কিছু নির্ধারিত ইঙ্গিত দিয়ে তোলা যাবে চমৎকার সব সেলফি। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী ব্যাটারির কারণে একটু ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। এছাড়া অল্প সীমার মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এই ড্রোনটি। এ ধরনের কিছু অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য ড্রোনটি বেশ উপযুক্ত।
ক্যাডিলাক সুপার ক্রুজ
ক্যাডিলাক সুপার ক্রুজকে গ্যাজেট না বলে একটি ফিচার হিসেবে ধরে নেয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত। এই ফিচারটির মাধ্যমে আপনি চাইলে স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত একেবারেই সরিয়ে নিতে পারবেন। মূলত এটিই হলো সুপার ক্রুজের সাথে অন্যান্য সেমি-অটোনোমাস ড্রাইভিং সিস্টেমের মূল পার্থক্য। শুধু চোখ রাস্তার উপর নিবদ্ধ রেখে যেকোনো কাজ যেমন- ফোনে কথা বলা কিংবা অন্যান্য যাত্রীদের সাথে কথোপকথন চালিয়ে নেয়া যাওয়া যাবে। গাড়িতে অনেকগুলো ক্যামেরা আপনার গতিবিধি নজরে রাখবে এবং সঠিক পথে গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যাবে।
এই ফিচারটি এখন পর্যন্ত কেবল ক্যাডিলাক সিটি৬ গাড়িতেই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা দেখে ধারণা করা হচ্ছে অন্যান্য জিএম গাড়িতেও এটি ব্যবহারযোগ্য করা হবে। ভবিষ্যতের চালকবিহীন গাড়ির শুরু বলা যায় এরকম প্রযুক্তিগুলোকে।
ফিচার ইমেজ: linkedin.com