প্রাচীন যুগের কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে আমরা উন্নীত হয়েছিলাম শিল্পভিত্তিক সমাজে। যেখানে কৃষির উপর নির্ভর করে অর্থনীতিসহ সম্পূর্ণ সমাজ পরিচালনা করা হতো, সেখান থেকে আমরা ধীরে ধীরে শিল্পের উপর নির্ভর করে সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হতে দেখেছি। যন্ত্রনির্ভর এই সমাজে পূর্বের সরাসরি প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারকে যন্ত্রের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করে ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু শিল্পভিত্তিক সমাজের কফিনে শেষ পেরেকটাও ঠোকা হয়ে গেছে বলা যায়। কারণ, ইতোমধ্যে নতুন সমাজব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে, যেখানে ডেটাই সব।
১ এবং ০ দিয়ে তৈরি তথ্যের ক্ষমতা এখন এত বিশাল যে পুরো বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তন করে দিয়েছে, এবং এখনও দিচ্ছে। এখন আমরা এনিগমার যুগে নেই, বা আমাদের তথ্যগুলো এখন আগের মতো সামান্য এবং বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি তথ্যই আরো সুনির্দিষ্ট এবং সুনিপুণ হচ্ছে। পরিমাণগত দিক দিয়েও ছাড়িয়ে যাচ্ছে একের পর এক সব রেকর্ড। আমরা মানুষ হিসেবে এখন শুধু আর রক্ত-মাংসের নই, বরং আমরা একেকজন একটা করে ডেটার বান্ডিল। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে— একজন মার্কিন নাগরিক গড়ে ৭৫,০০০ ডেটা পয়েন্টের বান্ডিল, যেগুলো এক কোম্পানি চাইলেই অন্য কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারে।[১] এত বিশাল পরিমাণ ডেটা থেকে এই ডেটা পয়েন্টগুলো অ্যানালাইসিস করা হয়েছে, যেগুলো বিক্রির যোগ্য। অর্থাৎ, যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণা করার পরও এই ডেটার পরিমাণ এত বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশাল পরিমাণ ডেটাকে একত্রে বলা হচ্ছে বিগ ডেটা।
কাগজের স্তূপ এবং বিশাল বিশাল ফাইল ভর্তি তথ্যের জায়গা দখল করেছে সিলিকন চিপ এবং ক্লাউড। মাত্র ২২ বছর আগেও যেখানে সমস্ত তথ্যের মাত্র ২৫ ভাগ ডিজিটাল স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হতো, সেই তথ্যের পরিমাণ এখন ৯০%। সারা দুনিয়ায় যে পরিমাণ তথ্য প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে, তার শতকরা নব্বই ভাগই ডিজিটাল স্টোরেজে সংরক্ষণ হচ্ছে।[২] ২০২১ সালেই সারা বিশ্বে মোট ৭৯ জেটাবাইট তথ্য তৈরি হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে, যেখানে ১ জেটাবাইট সমান ৭.৯^১০ টেরাবাইট। এই সুবিশাল ডেটার এক্সেসই নির্ধারণ করে দিতে পারে কোনো রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন সফল হবে কিনা, কোনো কোম্পানির প্রবৃদ্ধি বাড়বে না কমবে। বর্তমানে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর প্রভাবও সেই কথাই বলে।
এই বিশাল পরিমাণ ডেটার পুরো খেলাই আলো আর অন্ধকারের। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তথ্য থেকে যে আপনি শুধুমাত্র একক ব্যক্তি সম্বন্ধেই ধারণা পাবেন তা না, বরং একটা জনগোষ্ঠীর মনোভাব সম্বন্ধেও আপনি নিপুণ ধারণা পাবেন। শুধুমাত্র এই তথ্য যে আপনাকে বিস্তারিত ধারণা দেবে তা না, বরং সামগ্রিক একটা চিত্রও আপনার সামনে তুলে ধরবে। একইসাথে এই তথ্য যেমন নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত হবে, তেমনি নিরাপত্তা বিনষ্ট করতেও ব্যবহৃত হবে। একজন ব্যক্তির চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে যেমন তার জন্য একটা পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব, তেমনি পুরো দেশের সামগ্রিক চিত্র হাজির করা সম্ভব, যার ফলে কোনো দেশ সম্বন্ধে সহজেই জানা যাবে।
কীভাবে এই বিশাল পরিমাণ ডেটা আমাদের বিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে দিতে পারে চলুন জেনে নেয়া যাক সেই সম্পর্কেই।
ভাষা
পৃথিবীর কোনো দেশ এখন আর কোনো দ্বীপের মতো নিরবচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি দেশের সংস্কৃতি এখন অন্য দেশের সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলে। সোশ্যাল মিডিয়া, ব্যবসা, পর্যটন— সব কিছুর মাধ্যমেই এখন আমরা প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। আমরা এখন নিজ ভাষার পাশাপাশি ভিন্ন ভাষার সিনেমাও দেখি। শুধুমাত্র একটা ইংরেজি সাবটাইটেল পুরো একটা সিনেমাকে আন্তর্জাতিক বানিয়ে ফেলে। নির্দিষ্ট ভাষা না জেনেও পুরো বিশ্বের প্রায় সমস্ত ভাষার সিনেমা এখন দেখে ফেলা সম্ভব। সারা বিশ্বের সমস্ত ভাষায় এখন যোগাযোগ করা সম্ভব। যেকোনো ভাষার বই থেকে শুরু করে সমস্ত তথ্য জেনে নেয়া সম্ভব সেই নির্দিষ্ট ভাষা না জেনেই।
আজ আমরা যে এত সহজে ট্রান্সলেশন প্রোগ্রাম ব্যবহার করছি, তা প্রস্তুত করতে সারা পৃথিবীর ২০০ মিলিয়নের বেশি মানুষের তথ্যকে অ্যানালাইসিস করা হয়েছে।[৩] যদিও এখনও অনেক ভুলভ্রান্তি হচ্ছে, তবে ডেটার পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রায় শতভাগ নির্ভুল ট্রান্সলেটর পাওয়া সম্ভব হবে। যত বেশি ডেটা, তত উন্নত ট্রান্সলেশন। যেমন পূর্বের তুলনায় বাংলা ভাষায় লেখা অনলাইনে যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে গুগলের ট্রান্সলেটর প্রোগ্রাম এখন আগের তুলনায় উন্নত মানের ট্রান্সলেশন দেখাতে পারে।
তবে বিগ ডেটার কারণে শুধুমাত্র ট্রান্সলেশনগুলোই যে উন্নত হবে তা কিন্তু না। বরং, বর্তমানে আমাদের ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্টগুলোর রবোটিক, অস্বাভাবিক রকম ভয়েসেরও উন্নতি ঘটবে। এত এত ডেটা থেকে মানুষের কথা বলার শব্দের কম্পাঙ্ক, গভীরতা, পর্যায়কাল অর্থাৎ সামগ্রিক ভয়েস অ্যানালাইসিস করে আমাদের ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্টগুলোর রবোটিক ভয়েসকে একদম মানুষের ভয়েসের মতো রূপ দেয়া সম্ভব। তাছাড়া সেই ভয়েসগুলো যে একই হবে তা কিন্তু না। ব্যক্তি এবং তার প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে এই ভয়েসের স্টাইলও পরিবর্তিত হতে পারবে।
এর ফলে বিভিন্ন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাসিস্টেন্ট প্রোগ্রামের দক্ষতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। পাশাপাশি, ভাষার যে বাধা ছিল সেটাও আর থাকবে না। এই সামগ্রিক উন্নতির ফলে কোনো একটা ভাষার আধিপত্য যেমন কমবে, তেমনি আন্তর্জাতিক ভাষার প্রয়োজনীয়তাও ফুরোবে। নিজেদের ভাষার মাধ্যমেই সবাই সব ধরনের যোগাযোগ করতে পারবে। ভাষা বা যোগাযোগের বাহকের উপর থেকে আমাদের মনোযোগ সরে মূল কাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধি করবে।
খাদ্য
ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (FAO) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, আমরা ২০৩০ সালের পূর্বেই যে বিশ্বের ক্ষুধা সমস্যা নিবারণের লক্ষ্য নিয়েছিলাম, সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।[৪] বিশ্বজুড়ে অপুষ্টির হার যেখানে ২০১৯ সালে ছিল ৮.৪%, সেটা ২০২০ সালে উল্টো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৯%-এ। অর্থাৎ সারা বিশ্বে ৮০ কোটি মানুষ ২০২০ সালে ক্ষুধার্ত দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার বেশিরভাগ এশিয়া এবং আফ্রিকার।[৫] সময় আমাদের অনুকূলে নেই। বর্তমানের ক্রমবর্ধমান দূষিত পরিবেশ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যা খুব সহজেই FAO-এর ২০৩০ এর লক্ষ্য অর্জনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনের সামনে এগুলোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের দরকার বিগ ডেটা এবং কৃষিকাজের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি করা। সঠিক কৃষিব্যবস্থায় আমরা আবহাওয়া, জলবায়ু, বাতাসের সামগ্রিক অবস্থা, পানি, নাইট্রোজেন ইত্যাদি বিষয়কে আমলে নিয়ে প্রতি বর্গ ইঞ্চি জমির সঠিক ব্যবহার করতে পারব। কৃষিজমিগুলো বিভিন্ন সেন্সরের মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, মাটির অবস্থা, জিপিএসের মাধ্যমে অবস্থান ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত করা অ্যালগরিদম দিয়ে সহজেই কোন জমিতে কোন ফসল কীভাবে উৎপাদন করলে তা সবচেয়ে ভালো ফলন দেবে- সেটা বের করতে পারব।
তাছাড়া, বর্তমানে কৃষিকাজ আর প্রাচীন আমলে বসে নেই। মেশিনের মাধ্যমে ফসল লাগানো থেকে শুরু করে ঘরে তোলা অব্দি সম্ভব হচ্ছে। এখন সেই যন্ত্রগুলোর সাথেই সেন্সর দিয়ে সফটওয়ারের মাধ্যমে মনিটর করে পুরো কাজ কৃষকের মাধ্যমে সম্পন্ন না করে ভার্চুয়ালি তথ্যের মাধ্যমে করা সম্ভব। যন্ত্রগুলোর কাছে যখন ঐ জমি সম্পর্কে সমস্ত তথ্য থাকবে, তখন সে সিদ্ধান্ত যেমন ভালোভাবে নিতে পারবে, তেমনই নিজের কাজেও ভালো ফল দেখাবে। যেমন- কোন মাটিতে কোন ফসল ভালো হবে, বা কখন, কী পরিমাণ সার দেয়া দরকার ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিতে এই বিশাল পরিমাণ তথ্য বেশ সাহায্য করবে।
ইতোমধ্যেই বিশ্বের বড় বড় কৃষি কোম্পানিগুলো ফার্ম অ্যানালাইসিস থেকে শুরু করে বিগ ডেটা রিসার্চে বড় অংকের অর্থের বিনিয়োগ শুরু করে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, FieldScripts নামের একটি অ্যালগরিদম।[৬] এই অ্যালগরিদম ইনপুট হিসেবে নির্দিষ্ট জমির সমস্ত তথ্য গ্রহণ করে এবং সেটা প্রসেস করে জানিয়ে দেয় কীভাবে পুরো জমির ব্যবস্থাপনা করা উচিৎ, কী ফসল ফলানো বর্তমানে ভালো হবে, কী কী রিস্ক ফ্যাক্টর আছে, এবং সবশেষে সমস্যা অনুযায়ী পরামর্শও দিয়ে থাকে।
আগামী শতাব্দীতে দেখা যাবে- কৃষি কোম্পানিগুলো নিজেদের একেকটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে পরিবর্তন করে নিয়েছে। ক্লাউড প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশাল অবকাঠামোর খরচে না গিয়েও ছোট কোম্পানিগুলো সব সুবিধা ভাগ করে নিতে পারবে। এছাড়া, এসব তথ্যের বিশ্লেষণ কৃষিকাজ যেমন আরও কার্যকর করে তুলবে, তেমনি পরিবেশের উপরেও তুলনামূলক কম বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
ফিন্যান্স
বর্তমানে বেশিরভাগ শেয়ার ব্যবসার দৈনিক কাজগুলো করা হয় ব্ল্যাক-বক্স পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে কম্পিউটারের নির্দিষ্ট কিছু অ্যালগরিদম এবং শেয়ার সম্বন্ধে তথ্য, যেমন- শেয়ার প্রাইস, পরিমাণ, সময়— এই সমস্ত তথ্য দিয়ে সহজেই কোনো এক ব্যবসা বা কোম্পানি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। বর্তমান ব্যবসা জগতে পণ্যের সাপ্লাই চেইন, ইনভেন্টরি ম্যানেজ করা ইত্যাদি কম্পিউটারের মাধ্যমেই করা হচ্ছে। তবে এই কাজ আরো দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে করতে পারে ডেটা। নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্ত তথ্য থেকে পণ্য প্রস্তুত না করেই অ্যানালাইসিস করা সম্ভব ওই অঞ্চলে পণ্যটি কেমন চলবে। সিমুলেট করা সম্ভব পণ্যের ব্যবহার। শুধু পণ্যই না, বরং পেমেন্ট বা অর্থ ম্যানেজের ক্ষেত্রেও বিগ ডেটা বেশ ভালো ফলাফল দিচ্ছে। ব্যক্তির নিত্যদিনের খরচের প্যাটার্ন দেখে সহজেই কখন, কোন পণ্য তার সামনে দেখানো দরকার সেটা বুঝতে পারছে কোম্পানিগুলো, বিজ্ঞাপন হচ্ছে সুনির্দিষ্ট। এই সবকিছুর জন্যই ‘ফিনটেক’ অর্থাৎ ফিন্যান্স এবং টেকনোলজির ব্যবহারকে সার্থক বলাই যায়।
ফিনটেক-এ ২০০৮ সালে যেখানে ৯৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক বিনিয়োগ ছিল, সেখানে ২০২১ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২১০ বিলিয়ন ডলারে।[৭] ব্যাংকগুলো আধুনিক হচ্ছে এবং ফিনটেক যে আসলেই সম্ভাবনাময় তা এই বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ দেখেই ধারণা করা যায়।
ভবিষ্যতে ব্যক্তির ব্যাংকিং ডেটা থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রোফাইল তৈরি সম্ভব হবে, যার দ্বারা তার অর্থ খরচের যে অভ্যাস সেটা প্রভাবিত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ঋণ নেয়া কিংবা কোনো কাজের জন্য বিনিয়োগের আবেদন করলে ব্যাংকগুলো সহজেই আবেদনকারীর অর্থনৈতিক লেনদেনের ইতিহাস এবং অন্যান্য তথ্য সহজেই পেয়ে যাবে। যার মাধ্যমে নির্ণয় সম্ভব হবে কেমন ঋণ কীভাবে দিলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। এছাড়া, বর্তমানে ক্যাশলেস পেমেন্ট বা অনলাইন পেমেন্ট এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে।
যুদ্ধ
যুদ্ধের প্রাণ বলা হয় সঠিক পরিকল্পনা এবং সৈন্য নির্বাচনকে। এবং এখানেই বিগ ডেটার সাফল্য নিহিত। যুদ্ধের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একদম সঠিক অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য, যুদ্ধের এলাকার আবহাওয়াসহ প্রতিটি অঞ্চলের নিখুঁত মানচিত্র পাওয়া সম্ভব। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আরো বিশাল অবদান রাখে শত্রু সম্পর্কে সঠিক তথ্য আমলে নেয়া। এক্ষেত্রে বিগ ডেটার থেকে পারদর্শী কোনো প্রযুক্তি নেই।
সামগ্রিকভাবে একটা ধারণা নেয়া যেমন সম্ভব, তেমনই শত্রুর সৈনিকদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলও তৈরি করা সম্ভব। যার ফলে কোন ইউনিটের সৈনিকের কী কী দুর্বলতা সেটা জানতে পারা সম্ভব। কোন যুদ্ধে কোন সৈনিক অংশগ্রহণ করবে সেটার আগাম তথ্যও জানা বেশ সহজ হয়ে যাবে। এছাড়া, সঠিক তথ্য থেকে নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করলে অবস্থানুযায়ী অস্ত্রের ব্যবহার করে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। যার ফলে কম সময় এবং সম্পদ বিনষ্ট করেই খুব দ্রুত শত্রুকে পরাজিত করা সম্ভব।
তথ্যের এই সুবিধা শুধু শত্রুর ক্ষেত্রে নয়, বরং নিজেদের সৈনিকদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন- কোন যুদ্ধের জন্য কোন সৈনিক সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করতে পারবে সেটা আগেই জানা সম্ভব। যুদ্ধের অঞ্চলের সব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ শেষে সেই তথ্য ভিআর প্রযুক্তিতে ব্যবহারের মাধ্যমে যুদ্ধের আবহ তৈরি করে কৃত্রিম যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি সম্ভব, যেখানে সৈনিকরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।
উপরের বলা সুবিধাগুলো দিতে পারে এমন একটি কোম্পানি হচ্ছে Palantir। মিলিটারি ব্যবহারে এই কোম্পানির লিস্টে আছে এফবিআই, এনএসএ এবং মার্কিন মিলিটারি।[৮] এই কোম্পানির ডেটা ড্রিভেন আরো অনেক টুল থাকলেও শুধুমাত্র ডিফেন্স সেকশন থেকেই এর সিংহভাগ আয় উঠে আসে। কোম্পানিটি দাবি করে, তাদের টুলের ব্যবহারে বিচ্ছিন্ন ডেটাকে বিশ্লেষণ করে একটা যুদ্ধের সম্পূর্ণ অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা সম্ভব। এবং বাস্তব দুনিয়ার ক্ষেত্রে ইরাক, আফগানিস্তানে যুদ্ধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্ভাব্য ক্ষতি, অ্যাটাক টার্গেটসহ যুদ্ধের অঞ্চলের ত্রিমাত্রিক ম্যাপ তৈরিতে সক্ষম হয়েছিল।[৯] এছাড়া, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাদক চোরাচালান, সাইবার ফ্রডসহ বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
মেডিসিন
প্রচলিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে নির্দিষ্ট রোগের সকল ধরনের রোগীর জন্য একই ওষুধ সরবরাহ করা। ব্যক্তিভেদে রোগের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। যার ফলে ওষুধের কার্যকারিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠছে। এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে ব্যক্তিভেদে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং ওষুধ সরবরাহ করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বিগ ডেটা। মানুষের জিনোম সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করে এবং সেই তথ্য ম্যাপিং করে কারো শরীর সম্বন্ধে সব ধরনের খুঁটিনাটি তথ্য বের করা সম্ভব। এছাড়া, এর ফলে সমস্ত রোগের একটা ডেটাবেজ তৈরি করা সম্ভব, যার ফলে পরবর্তী রোগের ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্যের সাথে তা প্রতিরোধ করা যাবে। এই জিনোমিক্স বা জিনোমকে ডেটা হিসেবে ব্যবহারের যে মার্কেট, তার বর্তমান মূল্য ২,০০০ কোটি মার্কিন ডলারের উপরে, এবং প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলেছে।[১০] জিনোম ডেটার ফলে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা পাল্টে দেয়া সম্ভব।
Personal Genome Diagnostics (PGDx) এর মতো কোম্পানি এখনই স্পেশালাইজড ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস সেবা দিচ্ছে। আপনার শরীরের টিউমারের সামান্য একটা স্যাম্পল তাদের কাছে পাঠিয়ে দিলে তারা তাদের বিশাল ডেটার মাধ্যমে এবং আপনার পাঠানো স্যাম্পলের জিনোম বিশ্লেষণ করে সহজেই আপনার ক্যান্সার বিষয়ক অনেক তথ্য দিতে পারবে। আপনার ক্যান্সার কেন বেড়েই চলেছে, কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এবং প্রতিকারের উপায় সম্বন্ধেও নির্ভুল তথ্য দিতে সক্ষম। বর্তমানের বহুল প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসা, যেমন কেমোথেরাপি, অনেক জেনারালাইজড চিকিৎসা; যার ফলে সুস্থ কোষও ধ্বংস হয়, এবং স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ফেলে। এর পরিবর্তে পার্সোনালাইজড চিকিৎসা আপনার অসুস্থ কোষই শুধুমাত্র ধ্বংস করবে, এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত চিকিৎসাসেবা দিতে পারবে।
এই সবই সম্ভব হবে শুধুমাত্র বিগ ডেটার কল্যাণে। যত বেশি ডেটা হবে, তত বেশি নিখুঁত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হবে। এই ধরনের প্রযুক্তির গুরুত্ব বাড়ছে বোঝাই যায়, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ফান্ড পাচ্ছে এসব নিয়ে কাজ করা কোম্পানিগুলো।
উপরের ক্ষেত্রগুলো অনেক সম্ভাবনার খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ। বিগ ডেটা এর বাইরেও অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাচ্ছে, এবং ভবিষ্যতে এই সাফল্যের পরিমাণ আরো বাড়বে। যেকোনো সমস্যার সমাধানে ডেটা হয়ে উঠবে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। সুস্বাস্থ্য, যুদ্ধ-প্রকল্প, ভালো পরিবেশসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে বিগ ডেটার কোনো বিকল্প নেই। ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবার তথ্য যেহেতু স্টোর হচ্ছে, তাই খুব সুনির্দিষ্ট সমাধান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা অসংখ্য ডেটা তৈরি করছি, এবং বিগ ডেটায় অবদান রাখছি, যা এই সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনাকে আরো জোরদার করে তুলছে। তবে পাশাপশি এটা খুব ভয়ংকরও বটে। আমরা নিজেদের অজান্তেই এমন কিছু স্পর্শকাতর তথ্য দিয়ে দিচ্ছি, যা আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা সম্ভব। আমরা প্রতিনিয়ত টার্গেট হচ্ছি, এবং আমার গোপনীয়তা আরো ভঙ্গুর হচ্ছে।