যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, গত এক দশকে গোটা বিশ্বের কোন একটি খাতে সবচেয়ে বেশি উন্নতি ঘটেছে, তাহলে উত্তরটি অবশ্যই হবে প্রযুক্তি। পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তো বটেই, এমনকি তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোও কোনো না কোনোভাবে প্রযুক্তির আশীর্বাদধন্য হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এ কথা কখনোই বলা যাবে না যে প্রযুক্তির প্রভাব সবসময় ইতিবাচকই থেকেছে।
বরং গত এক দশকে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়ার মতো বেশ কিছু স্ক্যান্ডালেরও জন্ম দিয়েছে প্রযুক্তি শিল্প, আর সেখানে বাদ যায়নি অ্যাপল, গুগল, ফেসবুকের মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টেক জায়ান্টরা। আত্মহত্যা, গণহত্যা, যৌন হয়রানি, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের মতো বিচিত্র সব প্রাযুক্তিক স্ক্যান্ডাল হয়েছে পত্রিকার শিরোনাম। চলুন পাঠক, পেছন ফিরে দেখা যাক প্রযুক্তি জগতে গত এক দশকে ঘটে যাওয়া এমনই কিছু উল্লেখযোগ্য স্ক্যান্ডাল।
ফক্সকনে আত্মহত্যার মিছিল
চীনের শেনজেনে অবস্থিত ফক্সকন প্রযুক্তি উৎপাদন কারখানা। বিভিন্ন গ্যাজেট তৈরি করে তারা। তাদের ক্লায়েন্টের তালিকায় রয়েছে অ্যাপল, এইচপি, নিনতেন্দোর মতো সব ব্র্যান্ড। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের উপর এক সময়ে অমানবিক কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হতো। আর তা সহ্য করতে না পেরে, ২০১০ সালে অন্তত ১৪ জন শ্রমিক নিজেদের জীবনের ইতি ঘটান।
ফক্সকন কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ ছিল একদমই জঘন্য। অথচ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্লায়েন্টদের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সাধারণ শ্রমিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য করা হতো ওভারটাইম কাজ করতে। কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপকরাও ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর। সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখলেই তারা কেটে রাখতেন শ্রমিকদের বেতন। কোনো শ্রমিক যদি কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে কারখানার উপর থেকে লাফ না দেয়, তা নিশ্চিত করতে সেফটি নেটও বসিয়েছিলেন তারা। সেই সাথে শ্রমিকদেরকে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরও করিয়েছিলেন যেন তারা আত্মহত্যা না করেন।
কিন্তু এসবের পরও থেমে থাকেনি মৃত্যুর মিছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে কমপক্ষে ১৪ জন শ্রমিকের আত্মহননের সংবাদ নিশ্চিত হওয়া যায়, যাদের এই চরম সিদ্ধান্তের পেছনে দায়ী ছিল ফক্সকন কারখানার অমানুষিক কাজের চাপ। এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রচুর আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছিল। নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে অ্যাপল, এইচপি এবং ফক্সকনের অন্যান্য ক্লায়েন্টরা জানিয়েছিল তারা ফক্সকনের উপর চাপ প্রয়োগ করবে তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত করার জন্য। এছাড়া এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে চীনে শ্রমিকদের ওভারটাইম কাজের পরিমাণও নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
এনএসএ’র গুপ্তচরবৃত্তি
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক সদস্য এডওয়ার্ড স্নোডেন। ২০১৩ সালে তিনি রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। কারণ তিনি ফাঁস করে দিয়েছিলেন যে, আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি গোপনে নজরদারি করছে সাধারণ মানুষের গুগল ও ইয়াহু অ্যাকাউন্টের উপর, এমনকি বিনা অনুমতিতে তাদের সকল টেক্সট, অডিও, ভিডিওসহ যাবতীয় ফাইল চুরিও করে নিচ্ছে।
সেই সময়ে গুগল ও ইয়াহু উভয়ই স্নোডেনের ফাঁস করা এই তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। কেননা তাদের দাবি ছিল, তারা কখনোই সরকারকে তাদের সার্ভারে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে গুগল এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়েছিল যে বেশ অনেকদিন ধরেই তারা শঙ্কিত ছিল এ ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির সম্ভাবনায়।
স্নোডেনকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক আজও জারি রয়েছে। কারো কাছে তিনি একজন জাতীয় বীর। আবার কেউ কেউ তাকে মনে করেন বিশ্বাসঘাতক। এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে গুপ্তচরবৃত্তি আইন ভঙ্গের অভিযোগ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে দয়া প্রার্থনা করেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। তাই এ মুহূর্তে তিনি মস্কোতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।
গ্যালাক্সি নোট সেভেন বিস্ফোরণ
স্মার্টফোনের দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৬ সালের আগস্টে স্যামসাং বাজারে এনেছিল গ্যালাক্সি নোট সেভেন। তাদের স্লোগান ছিল, ‘দ্য স্মার্টফোন দ্যাট থিংকস বিগ’।
কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড চালিত এই ‘ফ্যাবলেট’ শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় স্যামসাং ইলেকট্রনিক্সের জন্য এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। অনেক ব্যবহারকারীই অভিযোগ জানাতে থাকেন যে তাদের কেনা নতুন নোট সেভেনে আগুন ধরে যাচ্ছে। স্যামসাংও এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। তারা জানায় যে নতুন করে নিরাপদ মডেলের ফোন উৎপাদন করা হবে এবং ভুক্তভোগীদেরকে পুড়ে যাওয়া ফোনের বদলে সেগুলো দেয়া হবে।
কিন্তু এক পর্যায়ে খবর আসতে থাকে যে রিপ্লেসমেন্ট ফোনগুলোও চার্জে দেয়া অবস্থায় পুড়ে যাচ্ছে। অবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয় এ মডেলের নতুন ফোন উৎপাদন। পাশাপাশি বাজার থেকেও তুলে নেয়া হয় সব নোট সেভেন।
মিয়ানমারের গণহত্যায় ফেসবুকের ‘নির্ণায়ক ভূমিকা’
২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চলে নির্মম গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, যার পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা চলে আসতে থাকে বাংলাদেশে। সেই থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কটে জর্জরিত এ দেশ। কিন্তু এজন্য দায়ী কে বা কারা?
জাতিসংঘের তদন্তকারী দল এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেয়েছে ফেসবুকের সম্পৃক্ততা। তাদের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনে পালন করেছিল ‘নির্ণায়ক ভূমিকা’। কারণ এই ফেসবুক থেকেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে, এবং রোহিঙ্গাদের সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
যেমন ফেসবুকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন আং লিয়ানের দুইটি অ্যাকাউন্ট ছিল। একটিতে তার অনুসারী ছিল ১৩ লাখ, অন্যটিতে ২৮ লাখ। এই দুইটি অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি প্রায়ই রোহিঙ্গাবিরোধী পোস্ট দিতেন। যেমন একটি পোস্টে তিনি রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন যে রোহিঙ্গা শব্দটিই নাকি বানানো।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের উগ্র জাতীয়তাবাদী, সকলেই ফেসবুকে সরব ছিল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। এভাবে ফেসবুকের গণ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে একটি গোটা জাতিকে তারা উৎখাত করতে পেরেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষও শেষ পর্যন্ত দায় স্বীকার করেছে যে তাদের প্ল্যাটফর্মটিকেই মিয়ানমারে জাতিগত ঘৃণা ও সহিংসতা বিস্তারে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু তারা এটি বন্ধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
গুগলে যৌন হয়রানি
২০১৮ সালের শেষ দিকে বিশ্বজুড়ে গুগল অফিসের হাজার হাজার কর্মী কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ ছিল গুগলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নামে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রথম প্রকাশিত হয় যে অ্যান্ড্রয়েডের অন্যতম নির্মাতা অ্যান্ডি রুবিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারীর উপর যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলেও, গুগল স্রেফ আভ্যন্তরীণভাবে বিষয়টি মিটমাট করে দিয়েই তাদের দায় মিটিয়ে ফেলেছে। কেননা গুগলে যে ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, তাতে কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে সেটি বাধ্যতামূলকভাবে সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়। অভিযোগকারীদের আদালত পর্যন্ত যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
এছাড়া জানা গেছে যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত এবং পরবর্তীতে প্রমাণিত হলেও রুবিন গুগল থেকে তার ‘এক্সিট প্যাকেজ’ হিসেবে ৯০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন। এক্ষেত্রে গুগলের যে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ছিল, সে কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন সিইও সুন্দর পিচাই। তবে পরবর্তীতে তিনি যৌন হয়রানি বিষয়ক ঘটনায় কোম্পানিটির যৌন হয়রানি বিষয়ক নীতিমালা আরো স্বচ্ছ ও কঠোর করার ঘোষণা দেন।
ফেসবুক-ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা
ফেসবুকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি ওঠে ২০১৮ সালে। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের লক্ষ্যে ফেসবুক থেকে প্রায় আট কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করেছিল ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা।
এছাড়া তারা তথ্যগুলোকে ব্রেক্সিট গণভোটে প্রভাব বিস্তারের জন্যও ব্যবহার করেছিল। এর মাধ্যমে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুকের বিজ্ঞাপনী নীতিমালা ভঙ্গ করেছিল এবং ফেসবুকও এ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল।
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার অবৈধভাবে ব্যক্তিগত তথ্য চুরির বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সংবাদ করেছিলেন দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক হ্যারি ডেভিস। তিনি লিখেছিলেন যে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টেড ক্রুজের হয়ে এবং কোটি কোটি মানুষের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বিনা অনুমতিতে তথ্য সংগ্রহ করছে তারা।
সে সময়ে ফেসবুক এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিল। শুধু জানিয়েছিল তারা এ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। এরপর এ সংক্রান্ত আরো সংবাদ প্রকাশ করেন সুইস প্রকাশনা দাস ম্যাগাজিনের হ্যানে গ্রাসেজার ও মিকাইক ক্রোগেরাস (২০১৬ সালের ডিসেম্বরে), দ্য গার্ডিয়ানের ক্যারল ক্যাডওয়ালাদর (২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে) এবং দ্য ইন্টারসেপ্টের মাতাথিয়াস স্কোয়ার্টজ। ফেসবুক এবারও কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
অবশেষে ২০১৮ সালের মার্চে স্ক্যান্ডালটি পূর্ণাঙ্গভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার এক সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার ওয়াইলির হুইসল-ব্লোয়ার (ফাঁসকারী) হিসেবে উত্থানের মাধ্যমে। তার বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এমনভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে যে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাজনীতিবিদরা ফেসবুকের কাছে সদুত্তর দাবি করতে থাকেন এবং মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ফেসবুকের বাজার মূলধন হ্রাস পায় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ২০১৮ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে গোটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হন ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ।
প্রযুক্তি জগতের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/