Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সোভিয়েত মিগ সিরিজের বিখ্যাত কিছু যুদ্ধবিমান

বিমানযুদ্ধ বা বিমানের ব্যাপারে যারা কিঞ্চিত জ্ঞানও রাখেন, তাদের সবার কাছেই মিগ খুব পরিচিত নাম। আর হবেই বা না কেন? একটি পরাশক্তির বিক্রমের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে গত প্রায় ছয় দশক ধরে এই বিমান পরিচিত হয়ে এসেছে। মিগ ঘরানার বিমানকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বে রাশি রাশি গবেষণা চালানো হয়েছে। লেখা হয়েছে গল্প, বানানো হয়েছে সিনেমা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছুদিন পর, ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে মিগ ডিজাইন ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রধান ছিলেন আরটেম মিকোয়ান আর মিকাহিল গুরোভিচ নামের দুই ইঞ্জিনিয়ার। সোভিয়েত বিমান শিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল অনেকটা এরকম- কেন্দ্র থেকে সেনাবাহিনীর পরামর্শমতো নানান চাহিদা জানিয়ে ডিজাইন ব্যুরোগুলোতে পাঠানো হতো। পরে ব্যুরো থেকে ডিজাইন পাঠানো হলে বিমানটি কারখানা থেকে তৈরি করা হতো।

১৯৪০ সালে মিগের প্রথম যুদ্ধবিমান মিগ-১ আকাশে ওড়ে। এরপর আসে মিগ-৩। এই বিমানগুলো আকাশের অনেক উঁচুতে উড়তে পারতো। পরে ১৯৪৬ সালে মিগ সিরিজের প্রথম জেট বিমান হিসেবে তৈরি করা হয় মিগ-৯। আজ জনপ্রিয় এই যুদ্ধবিমান সিরিজের কয়েকটি সম্পর্কে জানাবো।

কয়েকটি মিগ বিমান; Source: southfront.org

মিগ-১৫ (ন্যাটো নাম: ফ্যাগট)

১৯৫০ সালের ৩০ নভেম্বর। একটি বি-২৯ বোমারু উড়ছে কোরিয়ার উত্তরাংশে। আচমকা ছোট্ট একটা বিমান এসে কয়েক পশলা গুলি করেই পালিয়ে গেল। বি-২৯ এর গানম্যান বুঝতেই পারলেন না কোত্থেকে কী হলো। তবে গতিবেগ দেখে পশ্চিমা পাইলটরা বুঝে গেলেন, খুব শক্ত কোনো প্রতিপক্ষের হাতে পড়তে চলেছেন তারা। এভাবেই যুদ্ধে প্রবেশ করে বিখ্যাত মিগ-১৫ যুদ্ধবিমান।

ঘণ্টায় প্রায় হাজার কিলোমিটার বেগে উড়তে পারা মিগ-১৫ প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৪৯ সালে। পরের বছরই বেঁধে যায় কোরিয়া যুদ্ধ। সেখানে মিগ-১৫ তার সেই সময়কার সর্বাধুনিক ডিজাইন, সুইপ্ট উইং, আড়াই হাজার কিলোমিটার রেঞ্জ নিয়ে খুব দ্রুত বিখ্যাত হয়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি দেশের বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছে এই বিমান। এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজারের বেশি মিগ-১৫ বানানো হয়েছে। দুটি রকেট বা বোমা ছাড়াও দুটি কামান সংযুক্ত থাকতো এতে।

মিগ-১৫; Source: airshowinfo.hu

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অনেক জার্মান বিজ্ঞানীকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের হাত ধরেই সোভিয়েতরা মিগ-১৫ এর প্রাথমিক কাজ শুরু করে। পরে ব্রিটিশদের কাছ থেকেও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। প্রথম যখন চীনা বাহিনীর ছদ্মবেশে সোভিয়েত পাইলটরা মিগ-১৫ নিয়ে কোরিয়ার আকাশে হানা দিলো, পশ্চিমা বাহিনী তখন এর গতিবেগ আর নিয়ন্ত্রণ দেখে অবাক হয়ে যায়। বিশালকায় মার্কিন বি-২৯ বোমারু ছিল মিগ-১৫ পাইলটদের প্রিয় শিকার। এর বাইরে মার্কিন স্যাবর জেট (এফ-৮৬) এর বিরুদ্ধে এর যুদ্ধগুলোও খুব বিখ্যাত। ইয়েভগেনি পেপেলিয়েভ আর নিকোলাই সুত্যাগিন ২২টির বেশি মার্কিন বিমান শিকার করেছেন মিগ-১৫ ব্যবহার করে।

মিগ-১৫ এর একটু উন্নত সংস্করণ, মিগ-১৭ ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সুপারসনিক যুদ্ধবিমানগুলোর ওপরে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। মিগ-১৭ কে পরবর্তীতে মিগ-১৯ এ রূপান্তর করা হয়, যুদ্ধবিমান হিসেবে সেটিও বেশ সফল।

মিগ-২১ (ন্যাটো নাম: ফিশবেড)

মিগ-২১ ওরফে বালালাইকা খুব সম্ভবত মিগ সিরিজের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম। ৬২ বছর আগে এটি প্রথম আকাশে উড়েছিল। বহু দেশের বিমানবাহিনীতে এর উপস্থিতি দেখা যায়। বিশ্বে মিগ-২১ এর চেয়ে বেশি সুপারসনিক বিমান আর বানানো হয়নি। ৬০টিরও বেশি দেশের হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে এগারো হাজার মিগ-২১ বিমান আকাশে উড়েছে।

৪৮ ফুট লম্বা, ম্যাক ১ গতিসম্পন্ন মিগ-২১ ডেল্টা উইং বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। ২৩ এমএম জিএসএইচ মেশিনগানের পাশাপাশি এটি ৪টি কখনোবা ২টি মিসাইল নিতে পারতো। দীর্ঘদিন বিমানবাহিনীতে থাকার কারণে প্রয়োজন অনুসারে নানা সময়ে মিগ-২১ এ বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিমানটি আকাশে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, যুদ্ধক্ষেত্রে এটাই ছিল এর বড় দুর্বলতা। তবে এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মিগ-২১ আকাশযুদ্ধে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে।

রোমানীয় মিগ-২১; Source: Youtube

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বহু বোয়িং বি-৫২, এফ-১০৫ এবং এফ-৪ ফ্যান্টম যুদ্ধবিমান কমিউনিস্ট পাইলটদের শিকার হয়েছে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যেই ৫৬টি মার্কিন বিমান মিগ-২১ এর শিকার হয়। এই সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে। মিগ-২১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় বাহিনীর হয়ে অনেকগুলো পাকিস্তানি বিমানকে ভূপাতিত করে।

ভারতীয় পাইলটরা খুব সহজেই পাকিস্তানি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এবং এফ-১০৪ এর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। তবে মিগ-২১ চালাতে হলে খুবই দক্ষ পাইলট প্রয়োজন। ভারতসহ আরো অনেক দেশের বিমানবাহিনীতে মিগ-২১ চালু আছে। এর একটি চীনা সংস্করণ ‘চেংদু জে-৭’ বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতেও ছিল।

যান্ত্রিক গোলযোগ মিগ-২১ এর জন্য একটি বড় সমস্যা। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সম্ভবত ভারতীয়রা। পুরনো বিমানগুলোকে চালু রাখতে তাদেরকে প্রচুর ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। অনেকে তো বিমানটিকে ‘উড়ন্ত কফিন’ বলেও ডাকেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে বানানো ৮৪০টি মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের অর্ধেকই দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।

মিগ-২৩ (ন্যাটো নাম: ফ্লগার)

ষাটের দশকে মিগ-২১ এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে কাটিয়ে উঠার করার জন্য মিগ-২৩ তৈরি করে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। ভ্যারিয়েবল সুইপ্ট উইং বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমান বেশ কিছু বোমা বহন করতে সক্ষম। অস্ত্রশস্ত্র, বিশেষ করে মিসাইলও নিতে পারতো বেশ কয়েকটি। প্রায় ৫০ ফুট লম্বা, একক ইঞ্জিনবিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানে আছে লুক ডাউন বা শুট ডাউন রাডার। এটি বিমানের অনেক নিচে বা উপরে যেকোনো লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। বিমানটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ম্যাক ২.৩।

মিগ-২৩; Source: migflug.com

মিগ-২৩ সম্ভবত মিগ সিরিজের সবচেয়ে বাজে যুদ্ধবিমান। এতে প্রচুর জ্বালানী লাগতো। রক্ষণাবেক্ষণ করাও ছিল প্রচুর ঝামেলাপূর্ণ। তাছাড়া মিগ-২৩ বানানো হয়েছিল সোভিয়েত রণনীতি মাথায় রেখে। বিশাল সংখ্যক মিগ-২৩ এক লাইনে এসে একসাথে আক্রমণ চালাবে, এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়েছিল বিমানটিকে। অথচ বড় বড় দল বানিয়ে হামলার চেয়ে আকাশযুদ্ধের মহড়া নিতে হয়েছে বেশি। বলাই বাহুল্য, ইসরায়েলিদের ফরাসী মিরেজের কাছে ‘৮০ এর দশকে ভয়াবহ পর্যদুস্ত হয় এই বিমান।

মিগ-২৫ (ন্যাটো নাম: ফক্সব্যাট)

বিশেষভাবে নির্মিত স্টেইনলেস স্টিলের ৬৪ ফুট লম্বা মিগ-২৫ এর ছবি যখন প্রথম পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পৌঁছায় তখন রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। বিশাল আকারের বিমানটিকে দেখে সবাই মনে করেছিল এটা বুঝি ভয়ানক কোনো যুদ্ধবিমান, যা আকাশে দারুণ ডগফাইট করবে। পরে ১৯৭৬ সালে এক সোভিয়েত পাইলট একটি মিগ-২৫ নিয়ে জাপানে পালিয়ে গেলে দেখা গেল, এটি একটি ইন্টারসেপ্টার বিমান। অর্থাৎ অনেক উঁচুতে বোমারু বিমান মোকাবেলা করবার জন্য এই বিমান বানানো হয়েছে।

আলজেরিয় মিগ-২৫; Source: militaryedge.org

১৯৭০ সালে মিগ-২৫ পাকাপাকিভাবে সোভিয়েত বাহিনীতে যোগ দেয়। এর গতিবেগ ছিল ম্যাক ৩.২। এ গতি তখনকার সময়ের হিসেবে সর্বোচ্চ। বর্তমানে কেবল লকহিড ব্ল্যাকবার্ডের গতি এর চেয়ে বেশি। মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান বহু রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড়বার রেকর্ড। ৪টি আর-৪০ মিসাইলের পাশাপাশি কয়েকটি বোমা নিয়ে বিমানটি হাজার মাইলের বেশি দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। শক্তিশালী রাডার আর জ্যামিং সিস্টেম থাকায় আকাশে বোমারু বিমানের জন্য এগুলো ছিল আতংকের নাম।

মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি ইরাক, ভারত, মিশর, সিরিয়া আর লিবিয়ার বিমানবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছে। ইরাকি পাইলট মোহাম্মাদ রাইয়ান ইরান-ইরাক যুদ্ধে মিগ-২৫ নিয়ে প্রভূত সাফল্য দেখিয়েছিলেন।পরবর্তীতে আশির দশকে মিগ-২৫ এর উন্নত সংস্করণ, মিগ-৩১ বানায় সোভিয়েতরা। রুশ বিমানবাহিনীতে বেশ কিছু মিগ-৩১ এখনো ব্যবহার করা হয়।

মিগ-২৯ (ন্যাটো নাম: ফালক্রাম)

মার্কিন এফ-১৫ এবং এফ-১৬ এর জবাব হিসেবে ১৯৮২ সালে সারাবিশ্বকে পরিচয় করানো হয় মিগ-২৯ নামের এই যুদ্ধবিমানটির সাথে। ১৯৭৭ সাল থেকেই মার্কিনরা এই বিমানের কথা জানতো। অত্যাধুনিক ডিজাইন এবং যন্ত্রপাতির কারণে, বিশেষ করে এর হেডস আপ ডিসপ্লে, ফ্লাই বাই ওয়্যার সিস্টেম, হ্যান্ডস অন থ্রটল অ্যান্ড স্টিক প্রযুক্তি মিগ-২৯কে যেকোনো পশ্চিমা বিমানের সমকক্ষ করে তুলেছিল। এর বিশেষ গড়ন আকাশযুদ্ধে একে ভয়ানক দক্ষ ডগফাইটার হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল।

মিগ-২৯; Source: militaryedge.org

৫৬ ফুট লম্বা আর ম্যাক ২.২৫ গতি নিয়ে মিগ-২৯ পাল্লা দিতে পারে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। তবে সেটা সর্বোচ্চ পাল্লা, অতিরিক্ত জ্বালানী নিয়ে। সাধারণত মিগ-২৯ খুব বেশি দূরত্বের মিশনে যেতে পারে না। এটি মূলত পয়েন্ট ডিফেন্স ফাইটার, অর্থাৎ কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহর বা স্থানকে রক্ষা করা বা নির্দিষ্ট টার্গেটে চকিত হামলা চালানোর জন্য খুবই উপযুক্ত।

বিমানবাহী রণতরীর জন্য বিশেষভাবে বানানো মিগ-২৯; Source: news.usni.org

দুর্বল রাডার আর সীমিত রেঞ্জ ছিল মিগ-২৯ এর অন্যতম দুর্বলতা। তাছাড়া বিমানটি রক্ষণাবেক্ষণ করাও ছিল খুব ব্যয়সাধ্য। অন্যান্য সোভিয়েত বিমানের তুলনায় মিগ-২৯ চালানো বেশ কঠিন হওয়ায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বিমানবাহিনী এই ভয়ংকর মারণাস্ত্রটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। ভারত বা রাশিয়ার পাইলটরা বিমানটিকে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে। বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতেও কয়েকটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান আছে। ঘন ঘন দুর্ঘটনায় পড়ার কারণে মিগ-২৯কে অবসরে পাঠাবার চিন্তা শুরু করেছে এর বর্তমান ব্যবহারকারীদের অনেকেই। এর পরিবর্তে বাজারে আসতে যাচ্ছে মিগ-২৯ এর একটি উন্নত ভার্সন মিগ-৩৫।

ফিচার ইমেজ – theaviationist.com

Related Articles