অ্যাপলের আইফোন, স্যামসাং কিংবা এলজি ইলেকট্রনিক্সের একটি নতুন ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনের দাম যেখানে কম করে হলেও আটশো ডলার, সেখানে সাধের সাথে সাধ্য সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। অথচ চীনভিত্তিক কয়েকটি স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কিন্তু বাজেটের মধ্যেই আধুনিক প্রযুক্তি এবং গুণগত মানের ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন বাজারে এনে হইচই ফেলে দিয়েছে।
২০১৪ সালের চীনা স্মার্টফোন ভেন্ডর অপো ইলেকট্রনিক্স প্রথম ‘ওয়ানপ্লাস’ সাব-ব্রান্ডের আওতায় বাজেট ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন বাজারে ছাড়ে। ওয়ান প্লাস ১ স্মার্টফোনটির তুমুল জনপ্রিয়তার পর প্রতিষ্ঠানটিকে আর বিকল্প ভাবতে হয়নি। ঠিক ওয়ানপ্লাসের দেখানো পথে হেঁটে আরেক চীনা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান শাওমি এখন সাশ্রয়ী ফ্লাগশিপ ‘পোকোফোন এফ১’ বাজারে এনে তুমুল জনপ্রিয়তার পথে। আজকের লেখায় বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কয়েকটি বাজেট ‘ফ্লাগশিপ কিলার’ স্মার্টফোন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
শাওমি পোকোফোন এফ১
চলতি বছরের আগস্ট মাসে চীনা স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান শাওমি কর্পোরেশন থেকে বাজেট ফ্লাগশিপ পোকোফোন এফ১ স্মার্টফোনটি বাজারে ছাড়া হয়েছে। বর্তমান স্মার্টফোন বাজারে একটি স্ন্যাপড্রাগন ৮৪৫ প্রসেসর এবং লিকুইড কুলিং সিস্টেমের স্মার্টফোন কিনতে যেখানে কম করে হলেও অন্ততপক্ষে পাঁচশ ডলার খরচ করতে হয়, ঠিক সেখানে এই পোকোফোনের বাজারমূল্য সত্যিই অবাক করার মতো।
পোকো এফ১ স্মার্টফোনে ৬.১৮ ইঞ্চির আইপিএস এলসিডি পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। ১৮.৭:৯ অনুপাতের পর্দাটি ১০৮০×২২৪৬ পিক্সেলবিশিষ্ট এবং ৪০৩ পিপিআই ঘনত্বের। ফোনটিতে কোয়ালকম কোম্পানির সাম্প্রতিক ফ্লাগশিপ স্ন্যাপড্রাগন ৮৪৫ সিরিজের অক্টাকোর প্রসেসর এবং গ্রাফিক্স ইউনিট হিসেবে অ্যাড্রিনো ৬৩০ ব্যবহার করা হয়েছে। স্মার্টফোনটির পর্দায় বর্তমান প্রজন্মের করনিং গোরিলা গ্লাস ব্যবহার করা হলেও বাইরের দিকটি খরচ সাশ্রয়ী প্লাস্টিক উপাদানে তৈরি। ফোনটিতে মিইউআই (পোকো সংস্করণ) ব্যবহার করা হয়েছে। এতে তৃতীয়/চতুর্থ প্রজন্মের কুইক চার্জ প্রযুক্তির ৪০০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রসেসরের পাশাপাশি এই পোকোফোনের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে ক্যামেরা বিভাগ। স্মার্টফোনটির রিয়ার ক্যামেরায় ১২ এবং ৫ মেগাপিক্সেলের দুটি সিএমওএস সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ১.৯ এবং ২.০ অ্যাপাচারের সেন্সর দুটি যথাক্রমে ১.৪ এবং ১.১২ মাইক্রনপিক্সেলসমৃদ্ধ। ডুয়েল পিক্সেল অটোফোকাস থাকার কারণে স্মার্টফোনটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ফোকাস নির্ধারণ করতে পারে। সেলফি ক্যামেরা হিসেবে ২.০ অ্যাপাচার এবং ০.৯ মাইক্রনপিক্সেলের একটি ২০ মেগাপিক্সেল সিএমওএস সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। স্মার্টফোনটি দিয়ে ৪কে ভিডিও ধারণের পাশাপাশি সেলফি ক্যামেরায় বিশেষ এইচডিআর মোড থাকার কারণে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন সেলফি তোলা সম্ভব। ইআইএস সুবিধা থাকলেও বাজেট স্মার্টফোনটিতে থাকছে না কোনো ওআইএস।
বিশেষ সুবিধা হিসেবে কুইক চার্জ ৩ এবং এপিটিএক্স সুবিধাযুক্ত স্মার্টফোনটির র্যাম এবং রমের ভিন্নতায় বেশ কয়েকটি সংস্করণ থাকছে। বাংলাদেশের বাজারে আকর্ষণীয় এই ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনটি বর্তমানে ৩০ হাজার টাকার আশেপাশে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।
শাওমি এমআই ৮
২০১৭ সালের নভেম্বরে শাওমির পক্ষ থেকে ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন এমআই ৮ বাজারে ছাড়া হয়েছে। এই সিরিজের আগের সফলতার কথা মাথায় রেখেই নতুন স্মার্টফোনটি সাজানো হয়েছে। কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগনের শক্তিশালী ৮৪৫ অক্টাকোর চিপসেটের সাথে ফোনটিতে গ্রাফিক্সের জন্য আড্রিনো ৬৩০ জিপিইউ ব্যবহার করা হয়েছে। স্মার্টফোনটিতে ৬.২১ ইঞ্চির ১০৮০×২২৪৮ পিক্সেলের সুপার অ্যামোলেড পর্দা থাকছে। করনিং ৫ সুরক্ষাবিশিষ্ট এই পর্দাটি আধুনিক এইচডিআর১০ এবং ডিসিআই-পি৩ সমর্থন করে। স্মার্টফোনটিতে ৩৪০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ার ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে।
এমআই ৮ স্মার্টফোনে ১২ মেগাপিক্সেলের দুটি রিয়ার ক্যমেরা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রধান ক্যামেরাটি ১.৮ অ্যাপাচার ও ১.৪ মাইক্রনপিক্সেলের সাম্প্রতিক সনি আইএমএক্স সেন্সর এবং দ্বিতীয় ক্যামেরাটি ২.৪ অ্যাপাচার এবং ১ মাইক্রনপিক্সেলের টেলিফটো সেন্সর। ফ্লাগশিপ ইমেজ সেন্সরের কারণে স্মার্টফোনটি দিয়ে বেশ ভালো মানের নয়েজবিহীন ছবি ছবি তোলা সম্ভব। সেলফি ক্যামেরায় ২০ মেগাপিক্সেলের স্যামসাং আইএসওসেল সেন্সর ২ অ্যাপাচার এবং ০.৯ মাইক্রনপিক্সেলের স্যামসাং আইএসওসেল সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ৬৪/১২৮/ ২৫৬ গিগাবাইট স্টোরেজের সাথে ৬/৮ গিগাবাইট র্যামের সংস্করণের এই ফোনে মিইউআই (MIUI) ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাজারে এই স্মার্টফোনটির প্রান্তিক মূল্য ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি।
ওয়ানপ্লাস ৬
চার বছর আগের ওয়ান প্লাসের শুরুর গল্পটা ঠিক এখনকার পোকো স্মার্টফোনটির মতোই। চীনা স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অপো ইলেকট্রনিক্সের সাব-ব্র্যান্ড ওয়ানপ্লাস শুরুতে বেশ বাজেট বান্ধব ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন তৈরি করলেও সময়ের ব্যবধানে চাহিদার সাথে সাথে তাদের স্মার্টফোনগুলোরদাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৮ সালে ওয়ানপ্লাসের সর্বশেষ ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনটি হচ্ছে ওয়ানপ্লাস ৬। এতে ৬.২৬ ইঞ্চির অপটিক অ্যামোলেড পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। ১০৮০×২২৮০ পিক্সেলবিশিষ্ট পর্দাটি ৪০২ পিপিআই ঘনত্বের এবং ১৯:৯ অনুপাতে তৈরি।
কোয়ালকম কোম্পানির সাম্প্রতিক ফ্লাগশিপ স্ন্যাপড্রাগন ৮৪৫ সিরিজের অক্টাকোর প্রসেসর এবং গ্রাফিক্স ইউনিট হিসেবে অ্যাড্রিনো ৬৩০ ব্যবহার করার কারণে প্রসেসর এবং গ্রাফিক্সের দিক থেকে স্মার্টফোনটি খুবই শক্তিশালী। এ ফোনটি কাচের তৈরি এবং পর্দার সুরক্ষা হিসেবে করনিং গোরিলা গ্লাস ৫ ব্যবহার করা হয়েছে। ডিসিআই-পি৩ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ স্মার্টফোনটিতে ৩৩০০ মিলিঅ্যাম্পিয়ার ব্যাটারি এবং সাম্প্রতিক স্টক আন্ড্রয়েডের আদলে তৈরি অক্সিজেন ওএস ব্যবহার করা হয়েছে।
হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি এই ওয়ানপ্লাসের ক্যামেরা বিভাগ নজরকাড়া বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। স্মার্টফোনটির রিয়ার ক্যামেরায় ১৬ এবং ২০ মেগাপিক্সেলের দুটি সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। দুটি সেন্সরই ১.৯ অ্যাপাচারের এবং যথাক্রমে ১.২২ এবং ১ মাইক্রনপিক্সেলের। আধুনিক ফেস ডিটেকশন অটোফোকাস থাকার কারণে স্মার্টফোনটি দ্রুতগতিতে ফোকাস নির্ধারণে সক্ষম। সেলফি ক্যামেরা হিসেবে ২.০ অ্যাপাচার এবং ১ মাইক্রনপিক্সেলের ২০ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা থাকছে। এই ফোনের ক্যামেরা বিভাগের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্মার্টফোনটির তিনটি ক্যামেরা সেন্সরই সাম্প্রতিক সময়ের সনি আইএমএক্স সেন্সর। কাজেই ছবির গুণগত মান দৃষ্টিনন্দন। এছাড়া, স্মার্টফোনটি দিয়ে ৪কে ভিডিও ধারণের পাশাপাশি সেলফি ক্যামেরায় বিশেষ এইচডিআর মোড থাকার কারণে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন সেলফি তোলা সম্ভব। এই ফোনে ইআইএস এবং ওআইএস দুটোই থাকছে ।
বিশেষ সুবিধা হিসেবে ড্যাশ চার্জ প্রযুক্তি থাকছে। র্যাম এবং রমের ভিন্নতায় দুটি সংস্করণে বের হওয়া স্মার্টফোনটি বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে ৪২-৪৫ হাজার টাকায় কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।
এসেন্সিয়াল পিএইচ-১
২০১৭ সালের আগস্টে এসেন্সিয়াল স্মার্টফোনের ১ম সংস্করণটি বাজারে আসলেও দামের বিবেচনায় এই ফোনটির বর্তমান গুরুত্ব যথেষ্ট। স্মার্টফোনটির বর্তমান দাম বাজেটের মধ্যেই। ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনটিতে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন ৮৩৫ চিপসেট এবং অ্যাড্রিনো ৫৪০ জিপিইউ ব্যবহার করা হয়েছে। ৫.৭১ ইঞ্চির এই স্মার্টফোনটিতে ১৩১২×২৫৬০ পিক্সেলের আইপিএস পর্দা রয়েছে। সাথে থাকছে ৩০৪০ মিলিঅ্যাম্পিয়ারের কুইক চার্জ সুবিধার ব্যাটারি।
রিয়ার ক্যামেরা হিসেবে ১৩ মেগাপিক্সেলের সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ১.৯ অ্যাপাচারের রিয়ার ক্যামেরাটিতে লেজার অটোফোকাস থাকার কারণে ছবি তোলার ক্ষেত্রে নির্ভুল ফোকাস নির্ধারণে সক্ষম। ৮ মেগাপিক্সেলের সেলফি ক্যামেরা থাকছে স্মার্টফোনটিতে। ৪কে ভিডিওসহ যাবতীয় ফ্লাগশিপ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এই স্মার্টফোনটির জন্য গুগল ফার্মওয়্যার আপডেট দিয়ে থাকে। ঠিক পিক্সেল স্মার্টফোনের মতোই স্মার্টফোনটির আপডেট খুবই দ্রুত। কেউ যদি বেশ কম দামে গুগল পিক্সেল সিরিজের বিকল্প খুঁজে থাকেন, তার জন্য স্মার্টফোনটি আদর্শ বিকল্প হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের করনিং গ্লাস সুরক্ষা, বিশেষ কুইক চার্জসহ যাবতীয় সবকিছুই থাকছে এই ফোনে। ৪ গিগাবাইট র্যামের সাথে ১২৮ গিগাবাইট স্টোরেজের এই স্মার্টফোনটির আনুষ্ঠানিক মূল্য প্রথমে অনেক বেশ থাকলেও এখন ৩০০ ডলারের কাছাকাছি দামে আন্তর্জাতিক শপিং সাইটে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।
ফিচার ইমেজ: Youtube