আজ আমরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করছি, তা কিন্তু রাতারাতি এমন একটা অবস্থায় আসেনি। একটু ভেবে দেখুন, আজ যে কম্পিউটারগুলো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তার বদলে এমন কম্পিউটার বাজারে বিক্রি হচ্ছে যার আকার-আয়তন বড় কোনো কক্ষের সমান! হ্যাঁ, প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো কিন্তু ঠিক এমনই ছিল। তখন কম্পিউটার বলতে আজ আমরা যে প্রমাণ আকৃতির যন্ত্রটি ব্যবহার করি, তার কোনো তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক অস্তিত্বই ছিল না, বরং কম্পিউটার বলতে তখন এমন অনেকগুলো যন্ত্রের সমাহার বোঝাতো যা সুন্দর করে সাজানো থাকতো একটি কক্ষের পুরোটা জুড়েই। পরবর্তীতে হাজার হাজার মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, গবেষণা এবং অবদানের ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি আজকের দিনের কম্পিউটার।
১৯৪০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কম্পিউটারের যাত্রা বা অগ্রগতির যে ইতিহাস রয়েছে, তার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এই সময়টাকে মূলত পাঁচটি প্রজন্মে (GENERATION) ভাগ করেছেন। কম্পিউটার যাত্রার এই প্রজন্মগুলো হচ্ছে-
- প্রথম প্রজন্ম: ভ্যাকুয়াম টিউব (১৯৪০-১৯৫৬)
- দ্বিতীয় প্রজন্ম: ট্রানজিস্টর (১৯৫৬-১৯৬৩)
- তৃতীয় প্রজন্ম: সার্কিট ( ১৯৬৪-১৯৭১)
- চতুর্থ প্রজন্ম: মাইক্রোপ্রসেসর (১৯৭১- বর্তমান)
- পঞ্চম প্রজন্ম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ)
১ম প্রজন্ম: ভ্যাকুয়াম টিউব (১৯৪০-১৯৫৬)
আগেই বলা হয়েছে, আজ কম্পিউটার বলতে যে যন্ত্রটি বোঝায়, প্রথম প্রজন্মে,ল তা কিন্তু আজকের অবস্থায় ছিল না। তখন কম্পিউটার অর্থ ছিল বেশ কয়েকটি ছোট-বড় যন্ত্রের সমষ্টি। আর এই কম্পিউটার রাখতে ছেড়ে দিতে হতো একটি বেশ বড় মাপের কক্ষ। বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউবের (Vacuum Tube) দরকার পড়তো সার্কিট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, স্মৃতি বা মেমোরির জন্য ব্যবহৃত হতো অনেকগুলো ম্যাগনেটিক ড্রাম। এই কম্পিউটার রক্ষণাবেক্ষণ করাও ছিল অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ, কেননা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তির দরকার পড়তো এই যন্ত্রগুলো চালানোর জন্য। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হওয়ার কারণে প্রায়ই বিকল হয়ে যেত এই কম্পিউটার ব্যবস্থা।
পুরোপুরি যান্ত্রিক ভাষার (Machine Language) উপর নির্ভরশীল ছিল তখনকার কম্পিউটার সেবা। প্রোগ্রামিং ভাষা এতটাই প্রাথমিক স্তরের ছিল যে একবারে একের বেশি কমান্ড বা নির্দেশনা প্রদান করা একেবারেই অসম্ভব ছিল। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটির বেশি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতো না। কম্পিউটার অপারেটরকে দিন, সপ্তাহ, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসও পার করতে হতো কোনো নতুন সমস্যার ইনপুট দিতে। পাঞ্চ কার্ড এবং কাগজভিত্তিক হতো সেসব ইনপুট। প্রিন্ট করা কাগজে বেরিয়ে আসত সমস্যার সমাধান।
UNIVAC এবং ENIAC ছিল প্রথম প্রজন্মের দুটি কম্পিউটার ব্যবস্থা। মার্কিন জনগণনা দপ্তর তাদের গণনা কাজের জন্য ১৯৫১ সালে UNIVAC কম্পিউটার ব্যবহার করা শুরু করে। এটিই ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রিত প্রথম কম্পিউটার ব্যবস্থা।
দ্বিতীয় প্রজন্ম: ট্রানজিস্টর (১৯৫৬-১৯৬৩)
কম্পিউটারের ২য় প্রজন্মের পুরোটা জুড়েই আছে ট্রানজিস্টরের জয়গান। প্রথম প্রজন্মের শেষের দিকে এসে ১৯৪৭ সালে বেল ল্যাবে (Bell Labs) ট্রানজিস্টর আবিষ্কৃত হলেও ৫০’এর দশকের শেষে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ সময় ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পুরোপুরি ট্রানজিস্টরের ব্যবহার শুরু হয়।
ট্রানজিস্টরের ব্যবহার কম্পিউটারের জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। কম্পিউটারের আকার, আয়তন, গতি, মূল্য সবক্ষেত্রেই সুবিধাজনক এক পরিবর্তন আসলো ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিসটর ব্যবহারের কারণে। কিন্তু প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হবার সমস্যাটি থেকেই গেল। এ সময় বাইনারি যান্ত্রিক ভাষার পরিবর্তে সাংকেতিক ভাষার প্রচলন শুরু হল। Assembly নামের এই কম্পিউটার ভাষা আসার ফলে প্রোগ্রামাররা নির্দেশনা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধা পেতে শুরু করলেন। এই প্রজন্মে COBOL এবং FORTRAN নামক প্রাথমিক পর্যায়ের প্রোগ্রামিং ভাষা তৈরি হল কম্পিউটারকে নির্দেশনা প্রদানের জন্য। কম্পিউটারের স্মৃতি বা মেমোরির ক্ষেত্রে ম্যাগনেটিক ড্রামের বদলে ম্যাগনেটিক কোরের ব্যবহার সার্থকভাবে সূচনা করলো একটি স্টোরেজ ব্যবস্থার।
এই প্রজন্মের প্রথম দিকের কম্পিউটারগুলো মূলত পারমাণবিক শক্তি শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
তৃতীয় প্রজন্ম: সার্কিট (১৯৬৪-১৯৭১)
এই প্রজন্মে এসে ট্রানজিস্টরের আকার এবং আয়তন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে শুরু হল। অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টরের সমষ্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো সিলিকন চিপ, যা সেমিকনডাক্টর (Semiconductor) নামে পরিচিতি পেল। এই ‘সমষ্টিগত সার্কিটের ব্যবহার’ গতি এবং কার্যদক্ষতার ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ধারণা পুরোপুরি বদলে দিল।
পাঞ্চ কার্ড এবং কাগজে ছাপানো ব্যবস্থার পরিবর্তে একে একে এই সময়ে কম্পিউটারের জগতে আসলো কি-বোর্ড, মনিটর এবং কম্পিউটার চালানোর জন্য একটি অপারেটিং ব্যবস্থা (Operating System)। এর ফলে একসাথে একটির বদলে কয়েকটি অ্যাপ্লিকেশন চালানোর মতো একটা পরিবেশ তৈরী হলো। সেখানে অপারেটিং সিস্টেমটি একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা হসেবে মেমোরিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম্পিউটারের আকার, আয়তন অনেকটা ব্যক্তিবান্ধব হয়ে ওঠে এই প্রজন্মে। কম্পিউটারের মূল্য চলে আসে অনেকটা হাতের নাগালে। আজকের দিনে আমরা যে কম্পিউটার বিপ্লব দেখতে পাচ্ছি, তার গোড়াপত্তন হয় এই সময়টায়।
চতুর্থ প্রজন্ম: মাইক্রোপ্রসেসর (১৯৭১ – বর্তমান)
কম্পিউটারের চতুর্থ প্রজন্মের ইতিহাস মানেই আধুনিক কম্পিউটারের জয়গানের ইতিহাস। প্রথম প্রজন্মে যে বড় বড় যন্ত্রগুলোর জন্য পুরো একটা ঘরের দরকার পড়তো, তার বদলে এই প্রজন্মে এসে দেখা মিলল একটা ছোট মাইক্রোপ্রসেসরের, যা কিনা হাতের তালুতেই এঁটে যায়। হাজার হাজার ‘সমষ্টিগত সার্কিট’ একটি ছোট সিলিকন চিপে বসে তৈরি হল এই মাইক্রোপ্রসেসর (Microprocessor)। ১৯৭১ সালে ‘ইন্টেল ৪০০৪ চিপ’ নামে বাজারে আসলো এমনই এক মাইক্রোপ্রসেসর, যা দিয়ে শুধুমাত্র একটি চিপের সাহায্যে সিপিইউ (Central Processing Unit), মেমোরি এবং যাবতীয় সব ইনপুট ও আউটপুট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আইবিএম (IBM) নামক কোম্পানি ১৯৮১ সালে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহার করার জন্য প্রথম কম্পিউটার বাজারে ছাড়ল। এর দু’বছর পরেই ম্যাকিন্টশ (Macintosh) নিয়ে বাজারে আসলো অ্যাপল নামের কোম্পানি। শুধু ডেক্সটপ কম্পিউটার নয়, মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবহার শুরু হল দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা প্রায় প্রতিটি যন্ত্রে। মাইক্রোপ্রসেসর বদলে দিল গোটা ইলেকট্রনিক্স দুনিয়া।
ছোট আয়তনের কম্পিউটার তৈরি নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হল এই সময়ে। অফিসে ব্যবহৃত কম্পিউটারগুলোকে একত্র করার জন্য তৈরি হল একটি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। পরবর্তীতে এই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাই জন্ম দিল একটি স্বাধীন ইন্টারনেট ব্যবস্থার, যা আজ আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ।
পঞ্চম প্রজন্ম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ)
কম্পিউটারের পঞ্চম প্রজন্মে এসে অর্থাৎ বর্তমান সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত গ্যাজেটগুলোতে, বিশেষ করে কম্পিউটার ও মোবাইলে, কীভাবে এই বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে কমান্ড বা নির্দেশনা প্রদান করা যায়, তা নিয়ে গবেষণার ফসল হচ্ছে ‘ভয়েস রিকগনিশন’ বা কণ্ঠস্বরের সাহায্যে কমান্ডিং। মাইক্রোসফট, গুগল এবং অ্যাপলের মতো কোম্পানি তাদের পিসি এবং স্মার্টফোনে সার্থকতার সাথে এই সুবিধা প্রদান করছে। কম্পিউটারে সুপারকনডাক্টরের (Superconductor) ব্যবহার অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় একে করেছে দ্রুততম। Parallel Processing সুবিধা মুহূর্তের মধ্যে অনেকগুলো কাজ একসাথে করতে সাহায্য করছে।
এছাড়া বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন, মলিকুলার এবং ন্যানোটেকনোলজি নিয়ে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হলে আগামী দিনে কম্পিউটারের বর্তমান আকার এবং আয়তন দুটোই বদলে যাবে পুরোপুরিভাবে। ‘রোবোটিক কম্পিউটিং’ নিয়েও গবেষণা চলছে নিরন্তর। মানুষের স্বাভাবিক ভাষা এবং কথোপকথন পুরোপুরি শনাক্ত করা, কম্পিউটারের একটি নিজস্ব শিক্ষণ ব্যবস্থা এবং একটি নিজস্ব মেরামত ক্ষমতাই আগামী দিনগুলোতে কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ।
ফিচার ইমেজ- auckland.ac.nz