গত কয়েক বছর ধরেই সারা পৃথিবীব্যাপী পরিধানযোগ্য বিভিন্ন গ্যাজেটের জয়জয়কার। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট-কম্পিউটারের সাথে পাল্লা দিয়ে স্মার্টওয়াচ, স্মার্ট-গ্লাস, স্মার্ট-জুতোর মতো পণ্যগুলো ধীরে ধীরে মূল ধারার প্রযুক্তি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এমনকি বর্তমান বাজারে স্মার্ট-জুয়েলারির সন্ধানও পাওয়া যায়। তবে হলফ করে বলা যায় এসব পরিধানযোগ্য গ্যাজেটের মধ্যে সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য হচ্ছে ফিটনেস ব্যান্ড বা ফিটনেস ট্র্যাকার! স্বাস্থ্য সচেতন হয়েই হোক কিংবা শুধু ফ্যাশনের জন্য, ফিটনেস ব্যান্ড তৈরিতে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, স্যামসাং, হাওয়াই ছাড়াও বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর যেভাবে গুরুত্বের সাথে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে সহজেই বোঝা যায়, পৃথিবীব্যাপী প্রায় সর্বস্তরের জনগণের কাছে এর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। কিন্তু ব্যবহারকারীরা কি জানে, ফিটনেস ব্যান্ড বা ফিটনেস ট্র্যাকার কীভাবে কাজ করে? কীভাবে ব্যবহারকারীর হাঁটার প্রতিটি পদক্ষেপ, ঘুমের পরিমাণ, হার্ট রেট পরিমাপ করে? কীভাবে পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে শরীরের তাপমাত্রার পার্থক্য পরিমাপ করে ব্যবহারকারীকে উপযুক্ত তাপমাত্রা সুপারিশ করে? কীভাবে প্রায় সব রকমের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে এবং সে অনুযায়ী ব্যবহারকারীকে স্বাস্থ্য-বার্তা দিয়ে সহযোগিতা করে? আজকের পুরো লেখাটি এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই!
প্রথমেই শুরু করা যাক ব্রেসলেট বা ঘড়ির মতো দেখতে ব্যান্ডটিতে কী কী কার্যক্ষম অংশ রয়েছে সেগুলো নিয়ে আলাপের মাধ্যমে।
একটি ফিটনেস ব্যান্ড মোট পাঁচটি লেয়ারে সমৃদ্ধ। সেন্সিং লেয়ার, ম্যাক লেয়ার, নেটওয়ার্ক লেয়ার, প্রসেসিং এন্ড স্টোরেজ লেয়ার এবং সার্ভিস লেয়ার। লেয়ারগুলো সম্পর্কে আরেকটু বিশদ আলোচনা করা যাক!
- সেন্সিং লেয়ার (Sensing Layer): এই লেয়ারটি মূলত বিভিন্ন সেন্সর সমৃদ্ধ, যেগুলোর কাজ হচ্ছে হাঁটার পদক্ষেপ, হার্ট-রেট, তাপমাত্রা সহ নানা কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করে ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (WAN); যেমন- জিএসএম, জিপিআরএস কিংবা এলটিই এর মাধ্যমে সার্ভারে তথ্য পৌঁছে দেওয়া।
- ম্যাক লেয়ার (MAC Layer): এই লেয়ারটি মূলত পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, সেবার মান এবং পাওয়ার ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত।
- নেটওয়ার্ক লেয়ার (Network Layer): এই লেয়ারটি IPV6 এর মাধ্যমে মূল ব্যান্ড থেকে অন্যান্য ডিভাইসে রাউটিং, অ্যাড্রেসিং এর মাধ্যমে তথ্য স্থানান্তরিত করে।
- প্রসেসিং এন্ড স্টোরেজ লেয়ার (Processing and Storage Layer): সেন্সিং লেয়ার থেকে আসা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ডাটাবেজে সংরক্ষণের কাজ সহ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের কাজটিও এই লেয়ার করে থাকে।
- সার্ভিস লেয়ার (Service Layer): এই লেয়ারটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাতকৃত তথ্যগুলোকে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সরবরাহ করে।
প্রত্যেকটি ফিটনেস ব্যান্ডের নির্মাণশৈলী একই হলেও সেন্সিং লেয়ার এর ভিন্নতা একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করে ফেলে। তবে এক ডিভাইসে ব্যবহৃত সেন্সরগুলো অন্য ডিভাইসে ব্যবহৃত সেন্সরের থেকে আলাদা এবং অধিক বা কম কার্যক্ষম হলেও, তাদের কাজ করার পদ্ধতি একই। আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক সেন্সরগুলোর কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে।
অ্যাক্সেলেরোমিটার
ফিটনেস ব্যান্ডের সবচাইতে মৌলিক এবং সাধারণ সেন্সরটি হচ্ছে অ্যাক্সেলেরোমিটার (Accelerometer)। এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হলেও ফিটব্যান্ডগুলোতে ট্র্যাকার হিসেবে কাজ করে। সাধারণত ব্যবহারকারীর হাঁটার স্টেপ পরিমাপেই এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ত্বরণ, কম্পন, অরিয়েন্টেশন; অর্থাৎ ডিভাইসটি কি উলম্বভাবে আছে, নাকি আনুভূমিকভাবে আছে, তার উপর নির্ভর করে ব্যবহারকারীর অবস্থান, গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারে।
ডিভাইসগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্সেলেরোমিটার ব্যবহার হয়। একটির চাইতে অন্যটি ভিন্ন, শক্তিশালী, সংবেদনশীল এবং এগুলোর মধ্যে অক্ষের ভিন্নতাও রয়েছে। সাধারণত দুই অক্ষের অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর ডিভাইসগুলোতে ব্যবহার করা হয়। তিন-অক্ষের সেন্সরগুলো থ্রি-ডাইমেনশনে অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। ফিটনেস ট্র্যাকারের যথার্থতা বৃদ্ধির জন্য কোম্পানিগুলো দিন দিন উন্নত ও বেশি কার্যক্ষম অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর ফিটব্যান্ডগুলোতে ব্যবহার করছে।
জিপিএস (GPS)
বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনের কাজে জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের ব্যবহার হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তি, বস্তু সহ যেকোনো কিছুর অবস্থান, দিকনির্দেশনা খুঁজে বের করার প্রয়োজনে এই প্রযুক্তির ব্যবহার অনন্য। ফিটব্যান্ডগুলোতে জিপিএসের ব্যবহার পুরোপুরিভাবে শুরু না হলেও দিনদিন এর ব্যবহার বেড়েই চলছে। হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং এর মতো স্পোর্টস এবং শারীরিক কসরত আরো যথাযথভাবে পরিমাপ করার জন্য এই প্রযুক্তি সাধারণ অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর প্রযুক্তি থেকে উত্তম। তাছাড়া ব্যবহারকারীদের সহজেই তাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে জিপিএস সাহায্য করে, যা মাউন্টেইন রানিং, সাইক্লিং, বাইকিং, ট্রেকিং এবং হাইকিংয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
জিপিএস প্রযুক্তি অনেক পুরনো হলেও, অন্যান্য সেন্সরের তুলনায় তুলনামূলক ব্যাটারি পাওয়ার বেশি লাগে বিধায় সবধরনের ব্যান্ডে এর ব্যবহার এখনো শুরু হয়নি। তবে দিন দিন প্রযুক্তিকে কোম্পানিগুলো আরো কার্যক্ষম, ব্যবহারযোগ্য করে তুলছে।
গ্যালভানিক স্কিন রেসপন্স (GSR) সেন্সর
জিএসআর সেন্সরগুলো মূলত ত্বকের বৈদ্যুতিক সংযোগ পরিমাপ করে। অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক বল প্রয়োগের ফলে, অতিরিক্ত শারীরিক কসরত, কিংবা উত্তেজনার কারণে যখন শরীর ঘামতে থাকে, তখন ত্বক প্রাথমিক অবস্থার তুলনায় আরো বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়ে উঠে। আর ফিটনেস ব্যান্ডে থাকা সেন্সর সেটিই পরিমাপ করে এবং অন্যান্য সেন্সরের সংগ্রহ করা তথ্যের সংমিশ্রণে ফিটব্যান্ডগুলোকে শারীরিক কসরতের পরিমাণ এবং প্রবলতা নির্ণয় করতে সাহায্য করে, যাতে করে খুব সহজেই ব্যবহারকারীরা তাদের উপর দিয়ে যাওয়া ধকলের পরিমাণ জানাতে পারে। আগামীতে এই প্রযুক্তি স্ট্রেস, ফোবিয়া, পোস্ট-ট্রমা স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রোগীদের সাহায্য করবে বলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিশেষ করে আইওটি (IoT) সমৃদ্ধ মেডিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে জিএসআর সেন্সর বেশ বড় ভূমিকা পালন করবে।
অপটিকাল হার্ট রেট মনিটর (OHRM)
ফিটনেস ব্যান্ডগুলো হার্ট রেট পরিমাপের জন্য ফটোপ্লেথ্যাসমোগ্রাফি (Photoplethysmography) নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। সহজে বলতে গেলে, ফটোপ্লেথ্যাসমোগ্রাফি হচ্ছে একধরনের অপটিকাল পদ্ধতি, যা রক্তের পেরিফেরাল সঞ্চালনে আয়তনের পরিবর্তন সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে ফিটনেস ব্যান্ড থেকে ত্বকে আইআর রশ্মি নির্গত হয়। ঐ রশ্মি পেশি, স্কিন পিগমেন্ট, শিরা এবং ধমনীর রক্তের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়ার পরপরেই আবার বাউন্স করে ফিরে আসে। আইআর রশ্মি তীক্ষ্ণতা যখন পার্শ্ববর্তী অন্যান্য টিস্যু থেকে রক্তের মাধ্যমে বেশি নিমজ্জিত হয়, তখন খুব সহজেই রক্তের ওঠানামা পরিমাপ করতে পারে এবং সেগুলোকে ফটোপ্লেথ্যাসমোগ্রাফি সেন্সরগুলোর মাধ্যমে হার্ট রেট হিসেবে প্রকাশ করতে পারে।
ব্যান্ডের মান, দাম আরো অন্যান্য জিনিসের উপর নির্ভর করে অপটিকাল হার্ট রেট মনিটরের ভিন্নতা রয়েছে। তবে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যান্ডগুলো নির্ভুল হার্ট-রেট পরিমাপ করতে পারে।
থার্মোমিটার
প্রায় প্রত্যেকটি ব্যান্ডেই আজকাল তাপমাত্রা নির্ণয়ের জন্য থার্মোমিটার ব্যবহার করা হয়। এই ফিচারটি অ্যাথলেটদের জন্য বেশ কার্যকর। সাধারণত কঠিন কোনো ওয়ার্কআউটের সময় সবচাইতে ভালো রিকভারির সময়টি বেছে নিয়ে ট্রেনিং প্লান করার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা নির্ণয় প্রয়োজন হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে এই ফিচারটি বেশ প্রয়োজনীয়।
ইউভি (UV) সেন্সর
ইউভি সেন্সরের কাজ হচ্ছে ব্যবহারকারীর আশেপাশের উজ্জ্বলতা পরিমাপ করা এবং সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর রেডিয়েশনের ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া।
এমবিয়েন্ট লাইট সেন্সর
আমরা প্রায় প্রত্যেকেই এমবিয়েন্ট লাইট (Ambient Light) সেন্সরের সাথে পরিচিত। স্মার্টফোনে অটো ব্রাইটনেস অপশনটি চালু করে রাখলে, দিনরাতের আলো পরিমাপ করে ফোনের ব্রাইটনেস বাড়ানো এবং কমানোর কাজটি এই সেন্সরের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। কিন্তু ফিটনেস ব্যান্ডে এটি সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়।
উপরোক্ত সেন্সরগুলো ফিটনেস ব্যান্ডগুলোকে ব্যবহারকারীর হার্ট-রেট, শরীরের তাপমাত্রার পরিমাণ সহ নানান ধরনের তথ্য দিয়েই শুধু সাহায্য করতে পারে। তবে তথ্যগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজন ভালো একটি সফটওয়্যার। আর এখানেই মূলত বিভিন্ন ফিটনেস ব্যান্ডগুলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরী হয়। প্রায় প্রতিটি কোম্পানির ফিটনেস ব্যান্ডের জন্য তৈরি করা সফটওয়্যারগুলোর অ্যালগরিদমে ভিন্নতা থাকায় সবসময় দুটি ব্যান্ডের তথ্য একইরকম না-ও হতে পারে। তবে দিন দিন কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থেই সফটওয়্যারগুলোর মান এবং নির্ভুলতা বৃদ্ধি করছে।
ফিচার ছবি: consumerreports.org