![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/space.jpg?w=1200)
গত বছরের কথা। একদিন রাতে ছাদের উপর বসে আকাশ ভরা তারা দেখছিলাম। সেদিন ছিল লোডশেডিং। আকাশে ছিল না চাঁদ। মেঘের উপস্থিতিও ছিল না তেমন। আলোক দূষণহীন অবস্থায় তারা দেখার এক উপযুক্ত পরিবেশ। ভাগ্যক্রমে সেদিন তারার সাথে দেখা মিলেছিল আরো একটি জিনিসের।
রাতের আকাশে তাকিয়ে থাকার সময় তারকাময় দৃশ্যের সাথে দেখতে অনেকটা তারারই মতো উজ্জ্বল এবং ধীরে ধীরে চলতে থাকা কোনো বিন্দু আপনার চোখে পড়েছে? যদি সেটা মিটমিট করে না জ্বলে থাকে তবে আপনার জন্য সেটি অনেক আনন্দঘন এক মুহূর্ত। কারণ সেই চলমান বিন্দুটিই হলো মানব ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব উদ্ভাবন যাতে অবদান ছিল ১৬টি দেশের। সেটি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস) বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/space_station_over_earth-680x451.jpg)
স্পেস শাটল এন্ডেভার থেকে STS-130 এর একজন ক্রু মেম্বারের তোলা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন; Source: NASA
সেদিন জানা ছিল না কী দেখেছি। তাই আনন্দিত হবার বদলে বেশ আশ্চর্যই হয়েছিলাম। তবে কিছুদিন পরেই একটি বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন পড়ে জানতে পারি সেদিনের দেখা বস্তুটি আসলে কী ছিল। আপনি দেখুন বা না-ই দেখুন, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সহযোগিতাপূর্ণ এই প্রকল্পটি কিন্তু একদিনে মহাকাশে পাঠানো হয়নি। এর পেছনে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো দেশের অনেক ইতিহাস। কীভাবে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল সেটি? আর কী-ই বা করা হয় এই মহাকাশ স্টেশনে? সেখানে থাকা নভোচারীদেরই বা সময় কীভাবে কাটে? সেগুলো নিয়েই সাজানো হয়েছে এই লেখাটি।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো মহাকাশ বিষয়ক গবেষণাকে আরো ত্বরান্বিত করা। ভবিষ্যতে মহাকাশে মানুষের অভিযান, মাইক্রোগ্র্যাভিটি, মহাকাশে জীবের টিকে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করা হয় এখানে। ১৬টি দেশের সহযোগিতা আর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল এই বাসযোগ্য কৃত্রিম উপগ্রহের মহাকাশে যাত্রার সূচনা হয় ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর কাজাখস্তানের বাইকোনুর কসমোড্রোম লঞ্চ সাইটের একটি লঞ্চ প্যাড থেকে প্রোটন-কে নামের রাশিয়ান রকেটের মাধ্যমে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/international-space-station-1176518_1280-680x452.jpg)
আইএসএস থেকে রাতের পৃথিবীর সৌন্দর্য; Source: Pixabay
আকারে প্রায় একটি ফুটবল মাঠের সমান আর ওজনে প্রায় ৩২০টি গাড়ির থেকেও বেশি (প্রায় ৪৫০ টন) এই মহাকাশ স্টেশনকে একদিনে কিন্তু পুরোটাকে তার কক্ষপথে পাঠানো হয়নি। আগেই বলেছি, এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক টুকরো ইতিহাস। প্রায় বার বছর ধরে ৩০টিরও বেশি মিশন পরিচালনার মাধ্যমে পূর্ণতা পায় আইএসএস।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/iss.jpeg)
Source: NASA
প্রতি ঘণ্টায় ২৮,০০০ (প্রায়) কিলোমিটারেরও বেশি বেগে পৃথিবীকে প্রতি ৯০ মিনিটে একবার প্রদক্ষিণ করে চলেছে এটি। ১৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে আবর্তনরত এই দানব স্পেস স্টেশন একদিনে আনুমানিক ১৬ বার প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীকে। মহাকাশের লোয়ার আর্থ কক্ষপথে পৃথিবী থেকে ৪০৮ কিলোমিটার দূরত্বে আবর্তন করে চলেছে আইএসএস।
কিন্তু শুরুর গল্পটা এখনো জানা হলো না। এবারে পাড়ি জমানো যাক বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মহাকাশ স্টেশনের শুরুর সময়টাতে।
শুরুর গল্প
একটা সময় ছিল যখন মহাকাশ স্টেশনের কথা কেবল বিজ্ঞান কল্পগল্পেই শোভা পেত। কিন্তু বাস্তবতার মুখ দেখতে পাড়ি দিতে হয়েছে বেশ কিছুটা পথ। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথা বলতে গেলে শুরুতেই যে মানুষটার নাম উঠে আসে তিনি হলেন আমেরিকার চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। ১৯৮৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি নাসাকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অন্যান্য দেশের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি স্পেস স্টেশন তৈরি করার আদেশ দেন দশ বছরের মধ্যে, যাতে মানুষ মহাকাশে থেকেই আরো নিখুঁতভাবে গবেষণার কাজগুলো করতে পারে। শুরু হয় মহাকাশ স্টেশন তৈরির কার্যক্রম। এর দুই বছর পরই জাপান, কানাডা এবং ইউরোপ এই প্রকল্পে অংশীদারির চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭ সালে এর চুড়ান্ত নকশা সম্পন্ন হয় আর তার পরের বছরই রিগান এর নাম দেন ‘ফ্রিডম‘।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/1280px-Space_Station_Freedom_design_1991-680x506.jpg)
‘স্পেস স্টেশন ফ্রিডম’ এর নকশা; Source: NASA/Tom Buzbee
কিন্তু এই প্রকল্পে বাঁধ সেধে বসে অর্থ সংকট। নকশাকৃত স্পেস স্টেশন ফ্রিডমের নির্মাণের জন্য খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার ধ্বংসে সাতজন ক্রুর মৃত্যুর পর এই প্রজেক্টের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৯৩ সালে পুনরায় এর নকশা করার আদেশ দেন। কিন্তু এবারের খরচের দিকটা মাথায় রেখে নকশা করার এবং আরো কিছু দেশের সহযোগিতার জন্য আদেশ আসে।
এবারের খরচের কথা মাথায় রেখে আরো উন্নত একটি মডেল তৈরি করা হয় যার নাম দেয়া হয় ‘আলফা’। কিন্তু খরচ আরো কমে আসে রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। স্থগিত রাখা রাশিয়ান স্পেস স্টেশন মির-২ এর যন্ত্রাংশ আর মডিউলগুলো ব্যবহার করা হয় এতে। সবমিলিয়ে আগের ফ্রিডমের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী আর উন্নত একটি স্টেশন তৈরি সম্ভব হয়। আর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/Screenshot_2018-04-13-18-22-01-680x480.jpg)
‘স্পেস স্টেশন আলফা’-র নকশা; Source: NASA
যুক্তরাষ্ট্র (নাসা), রাশিয়া (রসকসমস), ব্রাজিল, কানাডা (কানাডা স্পেস এজেন্সি), জাপান (জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি) এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রধান ১১টি দেশের ‘স্পেস স্টেশন ইন্টার গভর্নমেন্টাল অ্যাগ্রিমেন্ট’-এ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে রচিত হয় সম্মিলিতভাবে কাজ করার এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। এর মাধ্যমে সবগুলো দেশ প্রয়োজন অনুযায়ী আইএসএস মডিউল পাঠানো, আর্থিক সহায়তা, মিশন পরিচালনা এবং এর দেখাশোনা করা, গবেষণা আর তথ্য ভাগাভাগি করে নেয়ার নিশ্চয়তা পায়। ১৫০ বিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলার ব্যয়ে তৈরি এই স্পেস স্টেশন ২০১৫ সালের এক তথ্যানুযায়ী মানব ইতিহাসে তৈরি সবথেকে ব্যয়বহুল বস্তু।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/IMG_20180413_180620_516-1-680x631.jpg)
Source: Niccolo’s Blog
এবারে জেনে নেয়া যাক আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের টুকরো ইতিহাস আর একে কীভাবে পাঠানো হয়েছিল তার কক্ষপথে।
আইএসএস এর মহাকাশ যাত্রা
ফুটবল মাঠের আকৃতির সমান এবং প্রায় ৪,০৮,০০০ কেজির স্পেস স্টেশনটিকে একবারে পাঠানো হয়নি এর কক্ষপথে। ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি মিশন পরিচালনা করে সম্পূর্ণ করা হয় স্পেস স্টেশনটির সবগুলো মডিউল সংযোজনের কাজ। একেকবারে একেকটি মডিউল যোগ করা হতে থাকে, যার প্রতিটির কাজ আলাদা আলাদা। আর এতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া। কানাডা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং জাপানের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ মডিউল এবং মিশনগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক এবারে।
জারিয়া (Zarya)
২০ নভেম্বর, ১৯৯৮। বেশিরভাগ মানুষের চোখ ছিল সেদিন টেলিভিশনের পর্দায়। আর কাজাখস্তানের বাইকোনুর কসমোড্রোমের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তখন একইসাথে ব্যস্ত আর উত্তেজিত। ‘থ্রি টু ওয়ান..’ কাউন্টডাউন শেষ হবার সাথে সাথে লঞ্চ সাইট ৮১-এর এরিয়া ২৪ লঞ্চ প্যাড থেকে সর্বপ্রথম আইএসএস মডিউল ‘জারিয়া‘কে নিয়ে উৎক্ষেপিত হয় প্রোটন-কে রকেটটি। এটির দায়িত্ব ছিল রাশিয়ান স্পেস এজেন্সির উপর।
রকেটটি জারিয়াকে নিয়ে যায় পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতার লোয়ার আর্থ কক্ষপথে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে এবং রাশিয়ান প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয় জারিয়া। রাশিয়ান শব্দ ‘জারিয়া’ মানে হল সূর্যোদয়।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/694px-Zarya_from_STS-88-651x720.jpg)
জারিয়া; Source : NASA
দুটি সোলার প্যানেল বিশিষ্ট এ মডিউলটিতে আছে একটি প্রোপালশন সিস্টেম যেটি আইএসএস-কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর তার কক্ষপথ বিচ্যুত হওয়া থেকে নিরাপদ রেখেছে। শুরুর দিকে একে ব্যবহার করা হত আইএসএস নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ এবং বৈদ্যুতিক শক্তির কাজে। বর্তমানে এটিকে ব্যবহার করা হয় স্টোরেজ ক্যাপাসিটি আর অতিরিক্ত জ্বালানীর ট্যাংক হিসেবে।
ইউনিটি (Unity)
এর কয়েক সপ্তাহ পরেই ৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮ এ নাসা ‘স্পেস শাটল এন্ডেভার’-এর মাধ্যমে ৬ জন ক্রু নিয়ে পাঠায় ‘ইউনিটি‘। ডকিং শেষে ৬ জন ক্রু এন্ডেভারে করে আবার ফিরে আসেন পৃথিবীতে। এটি একটি নোড মডিউল আর প্রথম নোড মডিউল হবার জন্য এর আরেক নাম নোড-১ নামেও পরিচিত। পরবর্তীতে যতগুলো মডিউল পাঠানো হয়েছে সেগুলো ইউনিটির সাথে যুক্ত হয়েছে।
১৮ ফুট দৈর্ঘ্যের আর ১৪ ফুট ব্যাসার্ধের সিলিন্ডারের মতো দেখতে এই মডিউলটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৫০,০০০ এর মেকানিক্যাল আইটেম আর ছয় মাইল তার।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/ISS_Unity_module-680x560.jpg)
নোড মডিউল ইউনিটি; Source : NASA
ভেজডা (Zvezda)
একইসাথে মহাকাশে এবং আইএসএস-এ মানুষের বসবাস করার নতুন ইতিহাস রচিত হয় ‘ভেজডা‘ মডিউলটি পাঠানোর পর। জারিয়া পাঠানোর দুই বছর পর আবারো বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে নতুন এই মডিউল পাঠানোর প্রস্তুতি নেয় রাশিয়ান স্পেস এজেন্সি।
২০০০ সালের ১২ জুলাই কসমোড্রোম লঞ্চ সাইট থেকে একটি থ্রি স্টেজ প্রোটন-কে রকেটের মাধ্যমে ভেজডা পাঠানো হয় আইএসএস এর সাথে যুক্ত করার জন্য।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/19308918319_b9c5b2a55b_o-495x720.jpg)
রাশিয়ার এই প্রোটিনে রকেটে পাঠানো হয় ভেজডা; Source: Scott Andrews/NASA
আইএসএস এ সংযোগকৃত তৃতীয় এই মডিউলটি যোগাযোগ এবং বসবাসের জন্য ব্যবহার করা হয়। মহাকাশে মহাকাশচারীদের প্রথম বাসা ‘ভেজডা’র অর্থ হলো ‘নক্ষত্র’। জারিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে নির্মাণ করলেও ভেজডা নির্মাণের পুরো ব্যয়ভার বহন করে রাশিয়া। আর এই কাজের জন্য অর্থ জোগাড়ে অদ্ভুত এক কাজ করে তারা। ভেজডা উৎক্ষেপণের রকেটটিতে চোখে পড়ে পিজ্জা হাটের বিজ্ঞাপণ।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/lXHwA-680x680.jpg)
ভেজডা মডিউল; Source: space.stackexchange.com
তবে অর্থ সংকটের কারণে এই মিশনের কোনো ব্যাকআপ বা ইনস্যুরেন্স ছিল না। তাই রকেটটি কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে গেলে বিলম্বন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত রাখে ‘ইন্টারিম কন্ট্রোল মডিউল’। কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়েনি, তাই সেটি বাতিল করা হয়।
এর কয়েক মাস পরেই নভেম্বরে এক্সপেডিশন-১ মিশনে মহাকাশের প্রথম তিন বাসিন্দা ক্রু ১৩৬ দিন বসবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন আইএসএস-এ। তারা হলেন উইলিয়াম শেফার্ড (যুক্তরাষ্ট্র), ইউরি গিদজেনকো (রাশিয়া) এবং সের্গেই ক্রিকালেভ (রাশিয়া)।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/960px-ISS-Expedition_1-crew-680x544.jpg)
প্রথম তিন মহাকাশ বাসিন্দা; Source: NASA
ডেসটিনি (Destiny), কানাডার্ম২ (Canadarm2) এবং কোয়েস্ট (Quest)
২০০১ সাল ছিল আইএসএস এর জন্য বেশ ব্যস্ত একটা সময়। এই বছর বেশ কিছু মডিউল সংযোজন করা হয় স্পেস স্টেশনে।
ডেসটিনি মডিউলটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত চারটি বৈজ্ঞানিক রিসার্চ মডিউলসহ একটি ল্যাবরেটরি যেটি স্পেস স্টেশনে গবেষণা এবং আরো উন্নত যোগাযোগের জন্য এই মডিউল পাঠানো হয়। ভেজডা মডিউল ডকিংয়ের পর থেকে একের পর এক মিশন পরিচালনা করা হতে থাকে নভোচারীদের পাঠানোর জন্য। সেখানে নভোচারীরা কাটাতেন কয়েক মাস করে। জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত ২৩০ জন নভোচারী স্পেস স্টেশনে পাড়ি জমিয়েছেন গবেষণার কাজে। ডেসটিনি ডকিংয়ের পর নভোচারীরা মহাকাশেই গবেষণার কাজ করতে শুরু করেন। গবেষণার কাজে প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তিই আছে এতে।
২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি স্পেস শাটল অ্যাটলান্টিসে পাঠানো হয় মহাকাশে গবেষণার ইতিহাস রচনাকারী এই ল্যাবরেটরিটি।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/115927main_lab_comparison.jpg)
ডেসটিনির ভেতর; Source: NASA
এরপর শুরু হয় নভোচারীদের বিভিন্ন রকমের গবেষণা। এর মধ্যে সবথেকে আলোচিত হলো মাইক্রোগ্র্যাভিটি নিয়ে গবেষণা। মাইক্রোগ্র্যাভিটি মানব শরীরে কিরকম পরিবর্তন ঘটায়, শরীরের পেশি আর হাড়ে কী পরিবর্তন ঘটে, চোখের ওপর কেমন প্রভাব পড়ে এসব নিয়ে গবেষণা করেন তারা।
প্রতি সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টা কাজ করা লাগে স্পেস স্টেশনের নভোচারীদের। এর মধ্যে গবেষণা ছাড়াও প্রতিদিন নিয়ম করে প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করা লাগে। আর ব্যায়ামের সব সরঞ্জামই আছে সেখানে। পাশাপাশি স্পেসওয়াক, স্পেস স্টেশন মেইনটেনেন্স এবং রিপেয়ার তো আছেই। স্পেসওয়াক হলো স্পেস স্টেশনের বাইরে কাজ করা।
তবে মজার ব্যাপার হলো, এতকিছুর মাঝেও তারা বিনোদনেরও সময় পান। আর পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারেরও সুযোগ থাকে। গান, মিউজিক ভিডিও, কখনোবা নভোচারীরা মেতে উঠেন নিজেদের আড্ডায়। মহাকাশের রেকর্ড করা প্রথম মিউজিক ভিডিওটি এখন পর্যন্ত ইউটিউবে ৩৯ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।
ডেসটিনির নিয়ন্ত্রণে ছিল আরেকটি অংশ, তা হলো কানাডার্ম২। স্পেস স্টেশন চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর এই প্রকল্পে কানাডার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো এই রোবোটিক আর্মটি।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/24fd28df-b6d5-45f1-bf0c-9d83096c9a66.jpg)
কানাডার্ম২; Source: Canada Space Agency
১,০০,০০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত পেলোড সরানো, ডকিং সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় এটি। STS-100 এর মাধ্যমে ৭ এপ্রিল ২০০১ এ পাঠানো হয় এই রোবোটিক আর্মটি।
কোয়েস্ট হলো একধরনের এয়ারলক। ডকিংয়ের সময় কিংবা স্পেসওয়াকের সময় দরজা হিসেবে ব্যবহার করা হয় এটি। ১২ জুলাই ২০০১ এ নাসার স্পেস শাটল অ্যাটলান্টিসের মাধ্যমে পাঠানো হয় এয়ারলকটি।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/iss2.jpeg)
কোয়েস্ট এয়ারলক; Source: TurboSquid
কলম্বিয়া দুর্ঘটনা
১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে মিশন শেষ করে সাত জন ক্রু মেম্বার নিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসছে নাসার স্পেস শাটল প্রোগ্রামের মহাকাশযান কলম্বিয়া। নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারে চলছে ল্যান্ডিং প্রস্তুতি। কিন্তু পৃথিবীর কাছাকাছি আসার পর ল্যান্ডিংয়ের ১২ মিনিট পূর্বে হঠাৎ নাসার মিশন কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো কলম্বিয়ার। মিশন কন্ট্রোলারদের মনে তখন একটাই ভয়, সবাই উদ্বিগ্ন আর চোখ বিশাল মনিটরের দিকে। মিশন কন্ট্রোলাররা চেষ্টা করে যাচ্ছেন যোগাযোগ স্থাপনের। সকাল ৯টা বাজার একটু আগে একজন মিশন কন্ট্রোলারের কাছে আসলো একটি ফোন কল। কলার জানালেন, টেলিভিশন নেটওয়ার্কে দেখা যাচ্ছে একটি বিধ্বস্ত মহাকাশযান ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/wfcr-houston-mission-contro-680x453.jpg)
মিশন কন্ট্রোলের শাটল কলম্বিয়ার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পরের মুহূর্ত; Source: NASA
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/STS107-crash-04-701x531-680x515.jpg)
ফুটেজে ধরা পড়ে বায়ুমন্ডলে ধেয়ে আসা বিধ্বস্ত কলম্বিয়া; Source: Travel thru History
১৯৮৬ সালে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনায় সাত নভোচারীর মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পর আবারো নাসার সেই স্পেস শাটল প্রোগ্রামেরই মহাকাশযান কলম্বিয়া বিধ্বস্ত হয় ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ১৬ জানুয়ারি ২৮তম ও শেষবারের মত মহাকাশ যাত্রা করা কলম্বিয়া মহাকাশযানে থাকা ৭ জন ক্রু মেম্বারই মৃত্যুবরণ করেন। এরপরই নাসা শুরু করে ঘটনার তদন্ত। দুই বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় স্পেস শাটল পাঠানো। আর আইএসএস-এ রসদ পাঠানোর একমাত্র পথ তখন রাশিয়ার সয়ুজ।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/shuttle-challenger-crew.jpg)
কলম্বিয়া দুর্ঘটনায় নিহত সেই সাত মুখ; Source: NASA
ঘটনার তদন্তে জানা যায়, যাত্রা শুরুর সময় মহাকাশযানের রিফ্যাক্টরি ফোম খসে পড়ে আঘাত করে কলম্বিয়ার বাম পাখায়। আর এতেই ফিরে আসার সময় ঘটে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা। ২০১১ সালে নাসা তাদের স্পেস শাটল প্রোগ্রাম পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করে। কলম্বিয়া দুর্ঘটনার পুরো ঘটনাটি জানতে পড়ে আসতে পারেন রোর বাংলার এই লেখাটি।
আরো কিছু সংযোজন
ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এতে যোগ করা হতে থাকে আরো কিছু প্রযুক্তি। এর মধ্যে দ্বিতীয় স্পেস ল্যাবরেটরি কলম্বাস পাঠায় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/s122e009992_cropped.jpg)
কলাম্বাস ল্যাবরেটরি; Source: NASA
যোগ করা হয় রেডিয়েটর, যেগুলো স্পেস স্টেশনে তৈরি তাপ বিকিরণের মাধ্যমে মহাকাশে ছেড়ে দিয়ে স্পেস স্টেশনের পুরো সিস্টেমটিকে ঠান্ডা রাখে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/717950main_s128e007239_226.jpg)
রেডিয়েটর; Source: NASA
সোলার প্যানেলগুলো স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা হয় ২০০৯ সালে। ১১২ ফুট দৈর্ঘ্যের আর ৩৯ ফুট প্রস্থের এই সোলার প্যানেলগুলো ৫৫টি বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/04/Earth_horizon_and_International_Space_Station_solar_panel_array_Expedition_17_crew_August_2008-680x452.jpg)
আইএসএস এর সোলার প্যানেল; Source: NASA
আইএসএস এর ভবিষ্যত শঙ্কা
গত এক দশকে মহাকাশ গবেষণা আর মহাকাশের নানা অজানা দিক জানাতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন অবর্ণনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, এর ভবিষ্যত রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
২০২৪ সালের পর নাসা এই খাতে আর কোনো অর্থ ব্যয় করবে না। এখন পর্যন্ত ১৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে নাসা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে এই প্রকল্পে।
ফান্ডিংয়ের সংকটের কারণে হয়তোবা ২০২৮ সালের পর শেষ হতে যাচ্ছে কালজয়ী এই স্পেস স্টেশন। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন এই প্রকল্প বন্ধ করার।
তবে কোনো প্রাইভেট কোম্পানী চাইলে এতে অর্থায়ন করে চালু রাখতে পারে এই প্রকল্প, কিন্তু নাসার উপস্থিতি থাকবে অনিশ্চিত।
যদি তা না হয়, তবে ২০২৮ সালের মধ্যে সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে এই প্রকল্পের আর স্পেস স্টেশনটিকে আছড়ে ফেলা হবে প্রশান্ত মহাসাগরে।
মহাকাশের অন্যতম এই অংশে নারীদের অবদানও কম নয়। ২০১৬-১৭ এর এক মিশনে একটানা ২৮৯ দিনের স্পেসফ্লাইটের রেকর্ড করেছেন আমেরিকান নভোচারী পেগি হুইটসন। এর আগে ১৯৯ দিনের রেকর্ডটি ছিল সামান্থা ক্রিস্টোফারেটির।
স্পেসএক্স আর রাশিয়ান মহাকাশযান সয়ুজ প্রতিনিয়ত স্টেশনে রসদ আর মালামাল সরবরাহ করে চলেছে।
মানুষ উড়তে শেখার পর খুব একটা বেশি সময় নেয়নি মহাকাশে বসবাস শুরু করতে। আইএসএস তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ। অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে যাত্রার পূর্বপ্রস্তুতি বলা চলে একে। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা আর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত হচ্ছে আইএসএস এর। সামনে দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বলে রাখা ভালো, সব ক্ষেত্রেই আকাশে দেখা চলমান উজ্জ্বল বিন্দুটি যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রই হবে এমনটা নয়। প্রায় ১০০এরও বেশি উপগ্রহ দেখা যায় পৃথিবী থেকে। তবে সেগুলো দেখার জন্য আপনাকে পাড়ি জমাতে হবে শহর থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত কোনো এক গ্রামে যেখানে আলোর কৃত্রিমতার ছাপ নেই। তবে পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে থাকায় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনেরর দেখা পাবার সম্ভাবনাই বেশি। এর উজ্জ্বলতা শুক্র গ্রহের মতোই।