মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলোর তালিকা করতে বসলে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে বিমান বা উড়োজাহাজের কথা। একশ বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ বিমানকে অসংখ্য কাজে ব্যবহার করেছে। চাষাবাদ, মালামাল পরিবহন, গোয়েন্দাগিরির কাজ, যুদ্ধসহ নানা ভূমিকায় বিমান মানুষের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রয়োজনানুসারে বিমানের দেহকাঠামোতেও আনা হয়েছে নানা পরিবর্তন। বিশেষ করে মালামাল পরিবহন আর যুদ্ধের কাজে খুব বড় আকারের বিমানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে বানানো হতে থাকে এমন বিশাল সব বিমান, যেগুলো আস্ত ট্যাংক থেকে শুরু করে বিরাটাকায় যন্ত্রপাতি বা মালামাল অনায়াসে বয়ে নিয়ে যেতে পারে হাজার হাজার মাইল দূরত্বে। এমনই কয়েকটি বিশালাকায় বিমান নিয়ে আজ আলাপ হবে।
আন্তোনভ-১২৪ রুসলান (ন্যাটো নাম: কন্ডোর)
সত্তরের দশকে সোভিয়েত নেতারা একটি বড় আকারের বিমানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তখনও পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে ভারী মালামাল পরিবহনের উপযুক্ত বিমান তেমন ছিল না। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৫ সালের প্যারিস এয়ার শোতে উন্মোচন করা হয় আন্তোনভ-১২৪ রুসলান।
২২৬ ফুট লম্বা রুসলান ওজন নিতে পারে দেড়শো টন। এর দুই ডানার সংযোগস্থলের কাছে ডেকে আরো ৮৮ জন মানুষ বসতে পারে। ৬ থেকে ১০ জনের একটি ক্রু দল বিমানটিকে চালায়। চারটি বিরাট জেট ইঞ্জিন এই বিশাল বিমানকে ঘন্টায় সাড়ে আটশো মাইল বেগে ছোটার শক্তি দেয়। রুসলানের বিশাল আকারের তুলনায় বিমানটি চালানো অনেক সহজ, তাই কার্গো পাইলটদের কাছে বিমানটি বিশেষ জনপ্রিয়। মালামালপূর্ণ অবস্থায় বিমানটি তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিতে সক্ষম। একেকটি বিমানের নির্মাণব্যায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। বিমানটি এবড়োখেবড়ো আর অসমতল রানওয়েতেও দিব্যি স্বচ্ছন্দে চলতে পারে। এর ভেতরে একটি ৩০ টন ওজন বহনে সক্ষম ক্রেন আছে।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে আন্তোনভের মালিকানা পায় ইউক্রেন। কিয়েভের পক্ষে এই বিশাল বিমানগুলো পরিচালনা করা সহজ ছিলো না। আবার বিমানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দরকারি প্রকৌশলী আর যন্ত্রপাতিও সে সময় যোগাড় করা কঠিন ছিলো। ফলে অনেকগুলো রুসলানকে বসিয়ে রাখা হয়। এখন আবার রাশিয়া আর ইউক্রেন বিমানগুলো পুনরায় চালু করবার আলোচনা শুরু করলেও সাম্প্রতিক যুদ্ধের কারণে আলোচনা আবার আটকে গিয়েছে। উল্লেখ্য, ন্যাটো ইরাক আর আফগানিস্তানে এই বিমান ব্যবহার করেছে।
এয়ারবাস এ৩৮০
এটি বিশ্বের সবথেকে বড় বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমান। ২০০৫ সালে এয়ারবাস মার্কিন কোম্পানি বোয়িং এর সাথে টক্কর দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই বিমান বানায়। বিমানটি ২৩৮ ফুট লম্বা, পাড়ি দিতে পারে পনেরো হাজার কিলোমিটার পথ, বইতে পারে সাড়ে পাঁচশো থেকে আটশ মানুষ। বিমানটি এতটাই প্রকান্ড যে, সাধারণ বিমানবন্দরে এগুলো অবতরণ করতে পারে না। বিশেষভাবে বানানো রানওয়ে আর অন্যান্য সুবিধা থাকা লাগে। চারটি রোলস রয়েস ট্রেন্ট ৯০০ ইঞ্জিন বিমানটিকে আকাশে ভাসিয়ে রাখে।
এ পর্যন্ত যত এয়ারবাস এ৩৮০ বানানো হয়েছে তার অর্ধেকই ব্যবহার করে এমিরেটস এয়ারলাইনস। সংখ্যাটা প্রায় একশো। অপেক্ষাকৃত শান্ত কেবিনের জন্য বিমানটি বিশেষ জনপ্রিয়। যাত্রী সুবিধার কথা মাথায় রেখে এর ভেতরে বসানো হয়েছে বার, রেঁস্তোরা এবং দোকান। সবমিলিয়ে উড়ন্ত হোটেল বলা চলে। দোতলা বিমানটি বেশ কিছু রেকর্ডের মালিক। এর গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় নয়শ কিলোমিটার।
এয়ারবাসের কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অত্যাধুনিক মার্কিন সামরিক বিমানগুলোর সমকক্ষ বলে মনে করা হয়। ফ্লাই বাই ওয়্যার সিস্টেম, লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিশালাকায় বিমানটিকে চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। বহু দেশ এই বিমানের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। একেকটির নির্মাণব্যায় প্রায় পঞ্চাশ কোটি মার্কিন ডলার।
লকহিড সি৫ গ্যালাক্সি
আড়াইশো ফুট লম্বা, ১৩০ টন ওজন বহনে সক্ষম লকহিড সি-৫ গ্যালাক্সি মার্কিন সামরিক বাহিনীর হাতে আসে ১৯৭০ সালে। ৭ জন ক্রু মিলে এই বিমান চালায়। বিমানটি আকারে বিরাট, পাল্লা দিতে পারে প্রায় নয় হাজার কিলোমিটার, গতিবেগ ঘন্টায় সাড়ে আটশ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে বেশ চমকদার মনে হলেও সি৫ প্রচুর সমস্যাপূর্ণ একটি বিমান। এর রক্ষণাবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ করার কাজগুলো অত্যন্ত জটিল। তাছাড়া বিমানটি অস্বাভাবিক উচ্চহারে জ্বালানী ব্যবহার করে। কাজেই এই বিমান চালানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর কারিগরী সমস্যাও অনেক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সায়গনের কাছে একটি সি৫ বিধ্বস্ত হলে দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়। পরে সুপার গ্যালাক্সি নামের আরেকটি উন্নততর সংস্করণ বানানো হয় সমস্যাগুলো মোকাবিলা করবার উদ্দেশ্যে।
বর্তমানে কর্মক্ষম সবগুলো গ্যালাক্সিই আপগ্রেড করা হয়েছে। অন্তত ২০৪০ সাল পর্যন্ত এগুলো ব্যবহার করা হবে। সি৫ গ্যালাক্সি সত্তরের পর থেকে মার্কিন বাহিনীর হয়ে বহু যুদ্ধে মালামাল পরিবহনের কাজ করে যাচ্ছে।
এয়ারবাস বেলুগা
১৯৯৫ সালে আকাশে ওড়ে এয়ারবাসের বিশেষ একটি বিমান, সুপার ট্রান্সপোর্টার। আসলে এটি এয়ারবাস এ৩০০ এর একটি বিশেষ সংস্করণ। দেখতে তিমি মাছের মতো হওয়ায় এর নাম হয়ে যায় ‘বেলুগা‘। ৫টি এ জাতীয় বিমান বানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত। ২০২০ সালের মধ্যে এর আরেকটি উন্নততর সংস্করণ বানানো হবে। একেকটি বিমানের নির্মাণব্যায় প্রায় ১৮ কোটি মার্কিন ডলার।
এয়ারবাস বেলুগা বানানো হয়েছে বেঢপ সাইজের মালামাল পরিবহনের জন্য। এজন্য এর আকারটাও এমন বদখত। বিমানটি কিন্তু আকারের তুলনায় ওজন তেমন নিতে পারে না, মোটে ৪৭ টন। ১৮৪ ফুট লম্বা বিমানটির গতিবেগ ম্যাক ০.৭। দুজন পাইলটই বিমানটি চালাতে পারে। আসলে বেলুগার অদ্ভুত আকারের কারণেই এর গতিবেগ বা ওজনের ব্যাপারে অনেক কড়াকড়ি অবলম্বন করতে হয়।
বেলুগা বানানো হয়েছে একান্তই এয়ারবাসের চাহিদাকে মেটানোর জন্য। বহুজাতিক কোম্পানিটি স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি আর ব্রিটেন থেকে নানা বিমানের যন্ত্রাংশ বানিয়ে এনে সেগুলোকে স্পেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মূল ফ্যাক্টরিতে জোড়া লাগায়। বেলুগা মূলত এ জাতীয় পরিবহনগুলোই করে থাকে।
আন্তোনভ-২২৫ ম্রিয়া (ন্যাটো নাম: কসাক)
আন্তোনভ-২২৫ ম্রিয়া এযাবতকালে বানানো সবথেকে ভারি বিমান। এই জাতীয় বিমান কেবল একটিই বানানো হয়েছে। ত্রিশ বছর আগে আকাশে ডানা মেলা সেই দৈত্যাকার বিমানটি অদ্যাবধি কর্মক্ষম আছে। আড়াই লক্ষ কেজির বেশি ওজন বহন করে বিশ্ব রেকর্ড করেছে এই বিমান।
বিশালাকায় বিমান বানানোর জন্য আন্তোনভ ডিজাইন ব্যুরোর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। আশির দশকে বুরান সিরিজের স্পেস শাটলগুলোর জন্য সোভিয়েতরা একটি ভারি বিমানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তখনকার দিনের মাইয়েশিশ্চেভ ভিএম ওজন নিতে পারতো মোটে ৫০ টন। তাই আন্তোনভ ডিজাইন ব্যুরো বানালো বিশালাকায় ম্রিয়া। বিমানটি আড়াই লক্ষ কেজি ওজনের মালামাল বহন করতে পারে। পিঠের ওপরে দুই লক্ষ কেজি ওজনের বস্তু নিয়েও দিব্যি উড়তে পারে। বিমানটির মালামাল রাখবার জায়গার উচ্চতাই হচ্ছে ৩৩ ফুট।
৬৪০ টনের এই ধাতব পাখিটিকে বহন করবার জন্য আছে ছয়টি প্রোগ্রেস ডি১৮টি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন। ছয়জন মানুষ লাগে এই ২৭৫ ফুট লম্বা বিমানটি চালাবার জন্য। গতিবেগ ঘন্টায় সাড়ে আটশ কিলোমিটার, রেঞ্জ পনেরো হাজার কিলোমিটারের কিছুটা বেশি। দুই ডানার মধ্যকার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮৮ মিটার। সবমিলিয়ে অতিকায় বিমানখানা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। পঞ্চাশটি মার্কিন সি৫ গ্যালাক্সির সমান ওজন এই বিমানটের।
১৯৮৯ এর প্যারিস এয়ার শোতে বুরান স্পেসপ্লেন পিঠে নিয়ে ম্রিয়া হাজির হলে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। বিমানটির দুর্ভাগ্য, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আন্তোনভ-২২৫ এর উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র ইউক্রেনের পক্ষে আর একে চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। এখন অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তোনভ বিমানটিকে ভাড়া দিয়ে থাকে। মার্কিন আর কানাডীয় সেনাবাহিনীর হয়েও কাজ করেছে এটি। আরেকটি অসমাপ্ত আন্তোনভ-২২৫ কে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করবার জন্য চীনা একটি প্রতিষ্ঠান আর আন্তোনভ কাজ করছে।
ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস ৬ এর শেষদিকে যে দানবাকৃতির বিমানটি দেখানো হয়, সেটি আন্তোনভ-২২৫। বিশ্বের বহু দেশে বিমানপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আন্তোনভ-২২৫। যেখানেই যাক, সেটা করাচি, মালয়েশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়াই হোক না কেন, বিমানবন্দরে রীতিমতো ভিড় জমে যায়। সংবাদপত্রে ফলাও করে এর আগমনী বার্তা ছাপানো হয়। পার্থেই যেমন একবার হাজার পঞ্চাশেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন স্রেফ বিমানটিকে একনজর দেখতে!
ফিচার ইমেজ – airliners.net