বছর ঘুরে রোজার ঈদ কাছে আসবার সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বে অধীর আগ্রহ নিয়ে যে খবরটার অপেক্ষা করা হয় সেটি হলো চাঁদ দেখা গেলো কি না। কীভাবে এ চাঁদ ‘দেখা’ হয়? খালি চোখের ব্যবহার কেমন আর কখনই বা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়? কেন দেশে দেশে চাঁদ দেখার সময়ে পার্থক্য হয়? বিভিন্ন সংস্কৃতি বা ধর্মে এর গুরুত্ব কী ছিল বা এখনো আছে? এই নতুন চাঁদ নিয়েই আমাদের আজকের লেখাটি।
প্রথমে আসি ‘নতুন চাঁদ’ বলতে কী বোঝায় সে কথায়। আমরা কথায় কথায় ‘নতুন চাঁদ’ বলতে সেই পশ্চিমাকাশে এক ফালি চাঁদকেই বুঝে থাকি, কিন্তু আসলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় ‘New Moon’ বলতে যা বোঝায় সেটা অমাবস্যা নামক চন্দ্রকলার প্রথম ধাপের অন্তর্গত, যখন চাঁদ আর সূর্য একই বরাবর থাকে; ফলে পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদকে তার কক্ষপথে দেখতে পাই না সহজে। তবু এই দশায় খুব চিকন করে হলেও আমরা কখনো কখনো দেখতে পারি, যেটাকে ‘ক্রিসেন্ট’/’Crescent’ বলা হয়। সত্যি সত্যি অমাবস্যার ছবি প্রথম তুলেছিলেন ফ্রেঞ্চ জ্যোতির্বিদ থিয়েরি লিগ্যাল, যদিও ‘অমাবস্যার ছবি’ (!) কথাটাই অদ্ভুত শোনায়।
চান্দ্র মাসের গড় সময় হলো ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড, অর্থাৎ এক নতুন চাঁদ থেকে পরের নতুন চাঁদ পর্যন্ত। কিন্তু এটা স্থির থাকে না. কারণ সূর্যের মহাকর্ষ বলের প্রভাবে চন্দ্রের কক্ষপথ হালকা পরিমাণে বিকৃত হয়; যার ফলে চান্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য ২৯.২৬ থেকে ২৯.৮০ দিন পর্যন্ত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে যেমন নিশ্চয়তার সাথে গ্রহ নক্ষত্রের কোন সময় কী অবস্থান হবে তা বলা যায়, তেমনই বলা যায় চাঁদের ক্ষেত্রেও; কিন্তু সেই অবস্থানে থেকে চাঁদকে পৃথিবী থেকে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ দেখতে পাবে কিনা সেটা শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় না।
উদাহরণস্বরূপ আমরা এবারের রমজান মাসের রোজা শেষে নতুন চাঁদ দেখে ঈদের কথা বলতে পারি। এ নতুন চাঁদ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, “গ্রিনিচ মান সময় ২টা বেজে ৩১ মিনিটে ২৪ জুন তারিখে প্রথম এ চাঁদ দেখা যাবার মতো অবস্থানে আসবে; এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন চাঁদের ফালি দেখা যাবার কথা ২৪ জুন ২০১৭ তারিখ শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব দিক কিংবা মোজাম্বিকের দক্ষিণ থেকে। আবহাওয়া খুব ভালো থাকলে খালি চোখে ‘দেখা যেতে পারে’ ২৪ জুন দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা থেকে…” ইত্যাদি।
কেন এক দেশে চাঁদ দেখা গেলেও অন্য দেশে দেখা যেতে দেরি হতে পারে? কারণ খালি চোখে চাঁদকে দেখতে হলে চন্দ্র আর সূর্যের মাঝে ১০.৫ ডিগ্রি কোণ থাকতেই হবে। এবং যে পরিমাণ দূরত্ব অর্জন করলে এই কোণ তৈরি হবে, সে পরিমাণ যেতে যেতে চাঁদের ১৭ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায় প্রথম কোনো প্রান্ত থেকে নতুন চাঁদের ফালি দেখবার পর থেকে (‘Conjunction’)। এ কারণেই আজ আমেরিকাতে চাঁদ দেখে গেলেই যে আজই বাংলাদেশে চাঁদ দেখা যাবে তা নয়। কিংবা সৌদি আরবে চাঁদ উঠলো বটে, কিন্তু বাংলাদেশে ন্যূনতম কোণ না পেলে এখানে চাঁদ দেখা যাবে না, সাধারণত পাওয়া যায়ও না। তাই চাঁদের বয়স কত সেটা আদৌ আসল কথা নয়, সেই কোণ হয়েছে কিনা বা ইংরেজিতে যেটাকে ‘Elongation’ বলে তা অর্জিত হয়েছে কিনা সেটাই হচ্ছে চাঁদ চোখে দেখতে পাবার নির্ণায়ক। তাই আমরা জানি আজ চাঁদ আকাশের অমুক অবস্থানে আছে, কিন্তু তারপরেও সেটা আমাদের চোখে ধরা দেবে না। এবং এই ধরা দেওয়া না দেওয়ার উপর ভিত্তি করেই হাজারো বছর ধরে ধর্মীয় নিয়মকানুন ও সংস্কৃতি কিংবা নতুন মাসের হিসেব চলে আসছে।
যেমন সময়ের হিসেবে বলতে গেলে বহুকাল আগেই সনাতন বা হিন্দু ধর্মে চন্দ্রদর্শন গুরুত্ববহ ছিল। শুভ-অশুভ মুহূর্ত ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো মনে রাখা হতো চন্দ্র-তারিখের সাপেক্ষে। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারত অনুযায়ী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অমাবস্যার পরদিন শুরু হয়েছিল, দিনটা ছিল মঙ্গলবার।
চাইনিজ ক্যালেন্ডারে নতুন চাঁদের সাথে নতুন মাস শুরু হয়। চাইনিজ কিছু কিছু বৌদ্ধ মাসের অমাবস্যা আর পূর্ণিমার সময় কেবল শাক-সবজি খেয়ে উপবাসে থাকে। এ ক্যালেন্ডারে অবশ্য সূর্যের হিসেবও আছে।
ইহুদী ধর্মের পঞ্জিকাতে প্রতি মাসের শুরু নতুন চাঁদের সাথে সাথে, ছোটখাটো ছুটির দিনও থাকে সেটা। হিব্রু ক্যালেন্ডার অবশ্য lunisolar calendar, যার মানে চাইনিজদের মতোই চন্দ্র-সূর্য মিলিয়ে। এটা এমনভাবে হিসেব করে বানানো যেন ইসলাম ধর্মের মতো উৎসবগুলো দশ দিন করে বছর বছর না পেছায়, অর্থাৎ প্রতি বছর একই দিনে পাওয়া যায়। ইহুদী পণ্ডিত দ্বিতীয় হিল্লেলের সূচনা করা এ প্রথা নবম শতকে আরো বিশুদ্ধ করা হয় টলেমি ও ব্যাবিলনীয়দের হিসেব নিকেশ ব্যবহার করে। সেই হিসেবটা এতো নিখুঁত ছিল যে তা আসলেই রীতিমত বিস্ময়কর। তাদের হিসেবে চান্দ্রমাসের গড় ছিল ২৯.৫৩০৫৯৪ দিন। আর আজকের আধুনিক হিসেব মতে সেটি ২৯.৫৩০৫৮৯ দিন। এত নিখুঁত হবার কারণেই সেই তখনকার সময় থেকে আজ পর্যন্ত আসল সময় থেকে মাত্র চার ঘণ্টা পিছিয়েছে হিব্রু ক্যালেন্ডার।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে চান্দ্র মাস গৃহীত হয় ইসলাম ধর্মে। ইসলামিক ক্যালেন্ডার (হিজরতের আগে বা পরে যখনই বলি না কেন) আগাগোড়াই চান্দ্র পঞ্জিকা। মাসের শুরু শেষের সাথে সূর্যের কোনোই প্রভাব সেখানে নেই (অবশ্য নতুন দিনের শুরু হয় সূর্য ডুবলে)। আগে যেমনটা বলা হয়েছে, চাঁদ কোথায় থাকবে সেটা জানা থাকলেও দেখা যাবে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না বিধায় আগে থেকে কখনোই বলা যায় না রমজান মাস কবে শুরু হবে, বা ঈদই বা কবে হবে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ চাঁদ দেখে থাকলে সেটা কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটিকে জানানো যায়, তাছাড়া টেলিস্কোপের সাহায্যে তো দেখার চেষ্টা করাই হয়। ২০০৭ সালে নর্থ আমেরিকা ফিকহি কাউন্সিল এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চ সারা বিশ্বের মুসলিমকে একই ক্যালেন্ডারের নিচে নিয়ে আসতে মক্কার হিসেবে সূর্যাস্তের আগে নতুন চাঁদ দেখা গেলে সারা বিশ্বের জন্য সেটা একই ধরার প্রস্তাব করা হয়, যদি পরের দিন সূর্যাস্তের পরে সেই চাঁদ ডোবে। তবে সেটা সর্বজনগৃহীত হয়নি।
ইসলাম ধর্মে চান্দ্র মাসের শুরু খুব বেশি গুরুত্ববহ হওয়ার কারণে পুরোপুরি আধুনিক বিজ্ঞানের উপর আস্থা রাখা হবে কিনা সে বিষয়ে সৌদি ফতোয়া কাউন্সিল গত শতকে দ্বিধায় ছিল। অন্যান্যদের বিশ্বাস আধুনিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণমাফিক হলেও সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ আব্দুল্লাহ বিন বাজ-এর বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়াশুনা ছিল না; এজন্য তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবী গোলাকার নয়, বরং সমতল। তিনি স্বদেশী কারো স্বচক্ষে দেখবার আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করেননি যে পৃথিবী গোল। ১৯৮৫ সালের ১৭ জুন বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমানের পুত্র প্রিন্স সুলতান কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে মহাশূন্যে গমন করেন। সাত দিন পর ফেরার পর তাঁর বক্তব্যের পর গ্র্যান্ড মুফতির বিশ্বাস পরিবর্তন হয় পৃথিবীর আকার নিয়ে। তখন আরেকটি জিনিস প্রিন্স সুলতান বলেছিলেন যে, যেটা পৃথিবী থেকে দেখা যায়নি খালি চোখে, সেটা উপরে গিয়েও দেখা যায়নি, অর্থাৎ অমাবস্যার নতুন চাঁদ তিনি উপরেও আঁধারই পেয়েছিলেন। [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রিন্স সুলতান প্রথম মুসলিম যিনি জিরো গ্র্যাভিটিতে নামাজ ও পবিত্র কুরআন পড়েছিলেন, যদিও সেটার আলাদা করে ধর্মীয় মাহাত্ম্য নেই।]
অন্য কোনো ধর্মের ক্ষেত্রে এটা এতটা গুরুত্ববাহী নয়, কিন্তু “নতুন চাঁদ চোখে পড়বার পর যদি মনে হয় যে এটার বয়স দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের মতো লাগছে, সেক্ষেত্রে কি সেদিন থেকেই চান্দ্রমাসের প্রথম দিবস ধরতে হবে?” এরকম একটা প্রশ্ন প্রায়ই করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উত্তর দেওয়ার জন্যসহিহ মুসলিমের ৫৩৪ নং হাদিস উদ্ধৃত করা হয়, “আমরা উমরা করে গিয়েছিলাম, নাখলাহ উপত্যকায় কাফেলা থেমেছিল। তখন আমরা নতুন চাঁদ দেখার চেষ্টা করলাম। দেখবার পর লোকে বলল, আরে এ তো তিনদিনের চাঁদ! কেউ কেউ বলল, দুদিনের চাঁদ। আমরা ইবনে আব্বাস (রা)-কে গিয়ে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, রাসুল (সা) বলেছেন, যেদিন থেকে তোমাদের চোখে গোচর হবে নতুন চাঁদ সেদিন থেকেই মাস গণনা শুরু করবে, এর আগে নয়।“
রমজানের রোজার ক্ষেত্রেই মূলত চাঁদ দেখাটা বেশি গুরুত্ব নিয়ে করা হয়। তবে হাদিস অনুযায়ী এক্ষেত্রে কারো ‘দেখা’টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সহিহ মুসলিমের ২৩৭৮ নং হাদিসঃ “রাসুল (সা) বলেছেন, রমজানের প্রথম চাঁদ দেখতেই রোজা শুরু করো, শাওয়ালের প্রথম চাঁদ দেখতেই রোজা বন্ধ করো। তবে যদি আকাশ মেঘলা থাকে, তবে ত্রিশদিন রোজা পূর্ণ কর।“
অঞ্চলভেদে রমজানের পার্থক্য হয়ে থাকে। কোনো জায়গায় আগে শেষ, কোনো জায়গায় পরে শেষ হয়। এ ব্যাপারটা এখন নতুন নয়, ১৪০০ বছর আগেও হয়েছিল।সহিহ মুসলিম ২৩৯১ নং হাদিসে বলা হচ্ছে, “ফাজল বলেছেন, একবার আমি সিরিয়া গেলাম মুয়াবিয়ার কাছে, সেখানে আমার মা’র পক্ষ থেকে আমার কিছু কাজ ছিল। ওখানে থাকা অবস্থাতেই রমজান শুরু হলো। চাঁদ দেখলাম শুক্রবার রাত্রে। যখন আমি মদিনায় ফিরে এলাম তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কবে চাঁদ দেখেছিলে ওখানে? আমি বললাম, শুক্রবার। উনি বললেন, আমরা তো শনিবার দেখেছি। তুমি কি নিজের চোখে দেখেছো? আমি বললাম, জ্বি বটে। আমি দেখেছি। সবাই দেখেছে, সবাই রোজা রেখেছে, মুয়াবিয়াও রেখেছেন। ইবনে আব্বাস বললেন, কিন্তু আমরা ত্রিশ পর্যন্ত বা নতুন চাঁদ দেখা পর্যন্ত রাখব রোজা, আমাদের শুরু শনিবারেই হয়েছে। আমি তখন বললাম, মুয়াবিয়ার মতো মানুষের নিজের চোখে দেখা যথেষ্ট না আপনার কাছে? ইবনে আব্বাস বললেন, রাসুল (সা) আমাদের এমনটাই বলে গেছেন (স্ব অঞ্চল)।“
চাঁদ দেখাতে যে কখনো ভুল হয় না তা নয়, বরং অনেক সময়ই হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর মধ্যপ্রাচ্যে দাবি করা হয় যে নতুন চাঁদ দেখা গেছে। অথচ যারা দেখেছিল তারা ভুল করেছিলো, কোনো মেঘ বা অন্য কিছু দেখে তারা সেটাকে চাঁদ ভেবেছিলো। কারণ সত্যি কথা হচ্ছে, ১৮ ডিসেম্বরে নতুন চাঁদ তৈরিও হয়নি। কারণ ১৯ তারিখেও পূর্বে উল্লেখিত সেই কোণ মাত্র ৮.৫ ডিগ্রি হতো, ১০ এ পৌঁছাতো না। আবার আরেকবার অন্যরকম এক ঝামেলা হয়েছিল, ২০০৫ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে উত্তর আমেরিকায় শাওয়াল মাস ৩১ দিন হয়ে গিয়েছিল! কোনো এক জায়গায় ভুল হয়ে গিয়েছিল চাঁদ দেখাতে।
* পবিত্র রমজান মাসের পরিসমাপ্তিতে রোর বাংলার সকল পাঠকের জন্য থাকলো ঈদের শুভেচ্ছা *
ঈদ মোবারাক