প্রযুক্তি দুনিয়ায় আসছে নতুন চমক। হাই-ফিডেলিটি কোয়ান্টাম লজিক গেটস, ৫৩ কিউবিটসের ‘সিকামোর’ প্রসেসর আর সেই প্রসেসরের দ্বিমাত্রিক গ্রিডে থাকা প্রতিটি কিউবিট অন্য আরো চারটি কিউবিটের সাথে যুক্ত। আজকের ২০০ পেটাফ্লপস কিংবা আইবিএম কোম্পানির প্রতি সেকেন্ডে ২০০০০০ ক্যালকুলেশন করার ক্ষমতাধর ‘সামিট’ বা ৯৩ পেটাফ্লপ্স চাইনিস ‘সানওয়ে তাইহুলাইট’ এর চেয়েও ঢের ঢের শক্তিশালী যন্ত্রগণক হতে চলেছে এই কম্পিউটারটি!
চমকে গেলেন তো? কম্পিউটিংয়ের জগতে ঘটতে চলেছে অভাবনীয় এক বিপ্লব। আর সেই বিপ্লব এসে গেছে গুগলের হাত ধরে। এসে গেল সুপার কম্পিউটারের চেয়েও ক্ষমতাবান কোয়ান্টাম কম্পিউটার! নেচার সাময়িকী গত বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর ২০১৯) গুগলের ৭৮ জন বিজ্ঞানীর একটি দল প্রকাশ করেছে তাদের গবেষণার ফলাফল। এ গবেষণা দলে প্রধান হিসেবে ছিলেন জন মার্টিনিস। আরো ছিলেন চার্লস নিল, সের্গিও বইক্সো, পেডরাম রওশান, প্রযুক্তি দুনিয়ায় আসছে নতুন চমক। হাই-ফিডেলিটি কোয়ান্টাম লজিক গেটস, ৫৩ কিউবিটসের ‘সিকামোর’ প্রসেসর আর সেই প্রসেসরের দ্বিমাত্রিক গ্রিডে থাকা প্রতিটি কিউবিট অন্য আরো চারটি কিউবিটের সাথে যুক্ত। আজকের ২০০ পেটাফ্লপস কিংবা আইবিএম কোম্পানির প্রতি সেকেন্ডে ২০০০০০ ক্যালকুলেশন করার ক্ষমতাধর ‘সামিট’ বা ৯৩ পেটাফ্লপ্স চাইনিস ‘সানওয়ে তাইহুলাইট’ এর চেয়েও ঢের ঢের শক্তিশালী যন্ত্রগণক হতে চলেছে এই কম্পিউটারটি!এডুইন পেডনল্ট, জন গানেল, অ্যান্টনি ম্যাগগ্রেন্ট এবং অন্যান্যরা।
তাদের তৈরি গুগলের এই নতুন কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি একটি অতি-জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে একশ সেকেন্ডে, যেটি কিনা এখনকার সুপার কম্পিউটারগুলোর করতে ১০ হাজার বছরেরও বেশি সময় লেগে যেতো বলে তাদের দাবি!
তাহলে? গুগলের কাণ্ডকারখানা শুনে ঘাবড়ে গেলেন তো? আমিও গিয়েছিলাম। খবরটা শোনার পর ক’টা দিন অপেক্ষা করছিলাম। পাছে ন আবার আবিষ্কারটি ভুল প্রমাণ হয় বা ঘোষণাটি গুগল প্রত্যাহার করে নেয়! সাধারণ কম্পিউটারকে টপকে কোয়ান্টামের ম্যাজিক্যাল জগতে পৌঁছে যাওয়াকে বিজ্ঞানী জন প্রেসকিল ২০১১ সালেই ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’ বলে অভিহিত করেছেন। আর গুগলের সদ্য তৈরিকৃত কোয়ান্টাম কম্পিউটার সম্ভবত সেই লক্ষ পূরণে সফল হয়ে গেছে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, পৃথিবীর সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার সিকামোর উদ্ভাবনের কৃতিত্ব এখন গুগলের জিম্মায়। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক সেই কবেই বলে গেছিলেন “Any sufficiently advanced technology is indistinguishable from magic.” অর্থাত্ যথেষ্ট উন্নত প্রযুক্তি আর ম্যাজিকের মধ্যে দৃশ্যত পার্থক্যই নেই। এক্ষেত্রে কথাটি আরেকবার প্রমাণ হতে চলেছে।
কোয়ান্টাম কী?
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সবকিছুই অনিশ্চিত এবং সম্ভাবনাময়। এ এক প্রহেলিকা। এটি পদার্থবিদ্যার এমন এক শাখা যা কিনা প্রাকৃতিক বস্তুদের পারমাণবিক ও অতি-পারমাণবিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যা একটি বিশেষ প্যারাডক্সের ব্যাখ্যা দিতে পারছিল না। উত্তপ্ত বস্তুর যেভাবে তাপ বিকিরণ করার কথা, সেভাবে নাকি করে না। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন সমস্যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিলেন এবং তৈরি করলেন পদার্থবিদ্যার একটি নতুন শাখা- কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
১৯২০ সাল নাগাদ এ শাখাটির পরিমার্জন এবং পরিবর্ধন করেন বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোয়েডিঙ্গার, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং ম্যাক্স বর্ন। শ্রোয়েডিঙ্গার, কোয়ান্টামের অদ্ভূতুড়ে প্রতিপাদ্য বোঝাতে নিয়ে এলেন অনিশ্চয়তা নীতি। আর নিয়ে এলেন বিড়ালের এক প্রপঞ্চ।
কল্পনা করুন, একটা বাক্সের ভেতর একটি বিড়াল আছে। বকে আছে তেজস্ক্রিয় পদার্থ। একটা রিলে সিষ্টেমের মধ্যে থাকা একটা হাতুড়ি আর হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডে ভরা একটি শিশিও আছে। এবার ওই তেজস্ক্রিয় পদার্থের ভেতর থেকে যদি একটা পরমাণু ভাঙে (যা কিনা আবার নাও ভাঙতে পারে), তবে ওই রিলেটা কাজ শুরু করবে। রিলেতে থাকা হাতুড়িটি আঘাত করবে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডের শিশিতে এবং সেই শিশি থেকে বেরিয়ে আসা বিষে মারা যাবে বন্দি বিড়াল।
এবার অন্য সম্ভাবনাগুলো ভাবুন। মানে, হাতুড়ির আঘাত শিশির গায়ে পড়েছে এবং পড়েনি, শিশিবন্দী বিষ বাক্সের মধ্যে ছড়িয়েছে এবং ছড়ায়নি, বিড়ালটা মরেছে এবং মরেনি। বাক্স বন্ধ অবস্থায় দুটো বিড়াল- জীবিত ও মৃত। বাক্স খুললে? স্রেফ একটাই বিড়াল- জীবিত অথবা মৃত। শ্রোয়েডিংগার বোঝালেন বন্ধ বাক্সে বিড়ালটি একইসাথে জীবিত ও মৃত। কী বিভ্রান্তকারী ব্যাপার!
দৃশ্যমান জগতের বস্তুরা বেশ বড় বলে ব্যাপারটা আমাদের চোখে অবাক ঠেকলেও ক্ষুদ্র জগতে কোয়ান্টাম ফিজিক্স মেনে চলা সুক্ষ্মাতিসুক্ষ কণাদের দুনিয়ায় এমনটাই হয়ে থাকে। কণাটি এক জায়গায় এক দশায় থাকার বদলে একইসাথে একই সময়ে অন্য অনেক জায়গায় এবং অনেক দশায় থাকতে পারে।
তাহলে এই থিওরি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে কী করে খাটে? প্রচলিত কম্পিউটার যে বাইনারি পদ্ধতিতে কাজ করে সেখানে অঙ্ক মাত্র দুটি: 0 এবং 1। অর্থাত্ সুইচ অফ এবং সুইচ অন। তথ্যপ্রযুক্তির পরিভাষায় একে বলা হয় ‘বিট’। এখনকার কম্পিউটার ইলেকট্রিক সুইচের অন-অফ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও এর প্রসেসর একইসঙ্গে 0 ও 1 এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এই জায়গাতেই এগিয়ে আছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। 1 আর 0 দিয়ে চারটি ফেজের একটি সাধারণ কম্পিউটারে পাওয়া যেতে পারে (00, 01, 10 এবং 11)। কিন্তু সবগুলো ফেজ এক ধাপেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে পাওয়া সম্ভব।
তিন সুইচওয়ালা সাধারণ কম্পিউটারের যে কাজ করতে লেগে যায় আট ধাপ (000, 001, 010, 100, 101, 110, 011 এবং 111), তা কোয়ান্টাম কম্পিউটার করে ফেলতে পারবে মাত্র এক ধাপেই। এর সিকামোর (Sycamore) নামের বিশেষ চিপটিতে আছে ৫৩ কিউবিটস। কিউবিটসই হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মৌলিক একক। বিজ্ঞানী পল বেনিয়ফকে কৃতিত্ব দেওয়া হলেও বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৮১ সালে ক্যালটেক ইউনিভার্সিটির এক বক্তৃতায় প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রসঙ্গ তোলেন তার ‘Simulating Physics with Computers’ শিরোনামের বক্তৃতায়।
টেক্সাস ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্কট অ্যান্ডারসনসহ আরো অনেক বিশেষজ্ঞ কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এই সাফল্যকে ১৯০৩ সালে রাইট ভাইদের মাত্র ১২ সেকেন্ডের সেই ঐতিহাসিক উড়নের সাথে তুলনা করে একে ‘কিটি হক মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেভিড ডয়েশ তো আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে এক একটি কম্পিউটারকে এক একটি ব্রহ্মাণ্ডের সাথে তুলনা করে ফেলেছেন।
রেষারেষি
আই.বি.এম. ইতোমধ্যে গুগলের সাফল্যকে নস্যাত্ করে দিয়েছে, বলছে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। মাইক্রোসফট, ইনটেল, অ্যামাজন, আইবিএমের মতো বড় সংস্থাগুলোর দীর্ঘকালীন গবেষণা, অসংখ্য স্টার্ট আপ কোম্পানি গজিয়ে ওঠা, চীনের ৪০ কোটি ডলারের কোয়ান্টাম ল্যাব এবং আমেরিকার কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেখে অনুমান করা যায় এই প্রযুক্তির জন্য কী দারুণ ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে।
ভালো-খারাপ
ভালো আর খারাপের দিক বলতে গেলে সেই চিরন্তন তুলনা, বিজ্ঞান অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ, এই দ্বিধায় দীর্ণ হতে হবে আমাদের। জটিলতা এড়িয়ে অল্প কথায় ভালো আর খারাপ দুটি দিক জানার চেষ্টা করি। এর সাহায্যে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের অনেক জটিল সমস্যার গাণিতিক সমাধান অতি দ্রুত করা যাবে। তৈরি হবে নতুন ধরনের ওষুধ। গাড়ি এবং এরোপ্লেনের জন্য তৈরি হবে খুব হালকা ও উন্নত ব্যাটারি। নতুন অনুঘটকের সাহায্যে উন্নতমানের সার তৈরি হবে (যে পদ্ধতিতে খুবই নগণ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হবে)। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অ্যালগরিদমকে আরো অনেক উন্নত করে তোলা যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও বড়সড় লাফ মেরে পেরিয়ে যাবে অনেক ধাপ।
তবে এর কিন্তু ঝুঁকিও আছে বিস্তর। আজকের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং শুধু যৌগিক আর মৌলিক সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বিশাল যৌগিক সংখ্যার মৌলিক উৎপাদক না জানার কারণে তাকে খুঁজে বার করতে আজকের সুপার কম্পিউটারেরও হাজার হাজার বছর লেগে যেতে পারে। আর এর ভরসাতেই চলে আজকের ই-ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা। আর কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিন্তু এক লহমায় ভেঙে দিতে পারে সেই নিরাপত্তা।
ব্রিটিশ সাপ্তাহিকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ এর মতে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকবে, সেটি চাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য নিজেদের সার্ভারে নিয়ে নিতে পারবে, এনক্রিপশন ভেঙে সরকারি ডেটাবেস হ্যাক করে নিতে পারবে আর পারবে ব্যাঙ্কিং এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অচল করে দিতে। তাহলে? উত্তর রইলো ভবিষ্যতের পাতায়।