
এই লেখাটি যারা পড়ছেন, ধারণা করে নিতে পারি, তাদের সবাই না হলেও, বেশিরভাগই অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদির সাথে পরিচিত আছেন। এবং এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা আনাগোনা করেন, এগুলোর একটি বিশেষ চরিত্র সম্পর্কেও তাদের সকলেরই জানার কথা। সেটি হলো: কিছুদিন পরপরই কোনো একটি বিষয় এখানে প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়ে যায়, পরে সেটি ভাইরাল হয়, এবং সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে তারকা-মহাতারকা সকলে সামিল হয় সেই স্রোতের জোয়ারে গা ভাসাতে।
এই ব্যাপারটিকে বলা হয়ে থাকে ‘ইন্টারনেট ফেনোমেনা’। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া যেকোনো কিছু; যেমন মিমস, জনপ্রিয় থিম, মজার সংলাপ, ছবি, ভিডিও, কৌতুক, চ্যালেঞ্জ, গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যু ইত্যাদিকে বলা হয় ইন্টারনেট ফেনোমেনা। এগুলোর শুরু অনলাইনেই হয় বটে, তবে একসময় এরা অনলাইনের সীমানা ডিঙিয়ে বাস্তব জগতেও বিচরণ শুরু করে।
এ ধরনের ইন্টারনেট ফেনোমেনাকে আমরা মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। ক) আঞ্চলিক ফেনোমেনা, খ) আন্তর্জাতিক ফেনোমেনা। এই যে কিছুদিন আগেও বাংলাদেশী ফেসবুক ব্যবহারকারীরা প্রচন্ড রকমের মেতে ছিল “এই মনে করেন, ভাল্লাগে, খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে” সংলাপটি নিয়ে, এর গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু কেবল বাংলাদেশীদের, কিংবা বড়জোর বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ একে তো এই ভাষাটি পৃথিবীর সকলের জানা নেই, তার উপর আবার এই সংলাপটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার যে অন্তর্নিহিত কারণ, সেটির সাথে নৈকট্য রয়েছে কেবল বাংলাদেশীদেরই। তাই এটিকে নিছকই একটি আঞ্চলিক ফেনোমেনা বলা যেতে পারে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক ফেনোমেনা হলো সেগুলো, যেগুলোর বিস্তৃতি নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ না থেকে, পুরো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- অনলাইনে যখন ‘আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ’ বা ‘মি টু মুভমেন্ট’ শুরু হয়েছিল, সেগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ঘটেছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষেরই। তাই এগুলোকে বলা যায় আন্তর্জাতিক ফেনোমেনা। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যেই ২০১৯ সালের তৃতীয় সপ্তাহ শেষ করতে চলেছি, তাই এ বছরও বেশ কিছু ইন্টারনেট ফেনোমেনার সাথেই আমাদের সাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক ফেনোমেনাও রয়েছে: ‘বার্ড বক্স চ্যালেঞ্জ’ ও ‘টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ’।
বার্ড বক্স চ্যালেঞ্জ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এবং এই চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ও হতাহতেরও ঘটনা ঘটেছে। তবে আমাদের বাংলাদেশে কিন্তু কাউকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে তেমন দেখা যায়নি। এর কারণ নেটফ্লিক্স অরিজিনাল ‘বার্ড বক্স’ নামক যে ছবিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সাধারণ মানুষ এই চ্যালেঞ্জটি নিচ্ছে, সেটি আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই এখনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আর তাছাড়া বার্ড বক্স চ্যালেঞ্জে অনেকে চোখ বেঁধে ভিডিও গেমস খেলা থেকে শুরু করে রাস্তায় গাড়ি পর্যন্ত চালাতে শুরু করেছে। নিতান্তই বোকা না হলে শেষোক্ত কাজটি কেউ করবে না।
এ কারণেই, বার্ড বক্স চ্যালেঞ্জটি আলোচনায় এলেও, এত বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি, যেটি পেয়েছে টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জই ২০১৯ সালের প্রথম জনপ্রিয় ইন্টারনেট ফেনোমেনা। ‘থ্রো-ব্যাক থার্সডে’ বা ‘ফ্ল্যাশব্যাক ফ্রাইডে’ জাতীয় ফেনোমেনাগুলোকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে এই টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ।
টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ কী?
টেন ইয়ার চ্যালেঞ্জকে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #HowHardDidAgingHitYou নামেও অভিহিত করছে। এই চ্যালেঞ্জের ফরম্যাটটি খুবই সহজ। ব্যবহারকারীকে তার দশ বছর আগের সাধারণ কোনো ছবি এবং বর্তমানের সাধারণ কোনো ছবি, কিংবা দশ বছর আগের প্রোফাইল পিকচার এবং বর্তমানের প্রোফাইল পিকচার আপলোড করে সেগুলোর মধ্যে তুলনা করে দেখাতে হবে যে, দশ বছরে তাদের মধ্যে কতটা পরিবর্তন হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশেষ কয়েকটি জিনিস মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে চাওয়া হচ্ছে: বয়স বৃদ্ধি চেহারায় কোনো পরিবর্তনই আনেনি, কিংবা বয়স বৃদ্ধি ও সময়ের পরিবর্তন চেহারার জেল্লা আরও বাড়িয়েছে, এবং সর্বোপরি দশ বছরে ব্যক্তি আরও সুদর্শন হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ দশ বছরে নিজের চেহারার উন্নতি বা স্থিতাবস্থা জাহির করতে চাওয়াই এই চ্যালেঞ্জের মূল লক্ষ্য, যে কারণে পরবর্তীতে এটি একটি সম্পূর্ণ ইতিবাচক নামও পেয়েছে, তা হলো ‘গ্লো-আপ চ্যালেঞ্জ’। এছাড়া অনেকে এটিকে 2009vs2019-ও বলছে।

কীভাবে শুরু হলো এই ট্রেন্ডটি?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অধিকাংশ জনপ্রিয় ট্রেন্ডের মতোই, এই ট্রেন্ডটিও প্রথম কার হাত ধরে শুরু হয়েছিল, সে-ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, এবং তা পাওয়া সম্ভবপরও নয়। তবে ধারণা করা যায়, নতুন বছরের শুরুতে কোনো একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী হয়তো তার পুরনো প্রোফাইল পিকচার ঘাঁটতে ঘাঁটতে লক্ষ্য করেছিল যে তার দশ বছর আগেকার ছবির সাথে বর্তমান সময়ের ছবির মধ্যে কী বিস্তর তফাৎ, এবং তখন সে সেই দুটি ছবিকে পাশাপাশি রেখে পোস্ট করেছিল। অনুমান করা হচ্ছে, এ ধরনের প্রবণতার ক্ষেত্রে ফেসবুকের ‘মেমোরি’ ফিচারটিও একটি বড় ভূমিকা রেখে থাকতে পারে। এই ফিচারের মাধ্যমে সরাসরি বহু পুরনো ছবি ও পোস্ট দেখতে পাওয়া যায় বলেই ব্যবহারকারীদের পক্ষে দশ বছর আগের সাথে বর্তমানের পার্থ্যক্য চিহ্নিত করতে পারা সুবিধাজনক হয়েছে।
এই ট্রেন্ড ২০১৯ সালেই কেন এত জনপ্রিয়তা পেল, ২০১৮ বা ২০১৭ সালে কেন পেল না, এ ব্যাপারেও একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব উঠে এসেছে। অনেকের দাবি, ২০১৯ সালে এই ট্রেন্ডটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কারণ এর ঠিক দশ বছর আগে তথা ২০০৯ সালেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে প্রথম গণজোয়ার দেখা গিয়েছিল। ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির অস্তিত্ব ২০০৯ সালের আগেও ছিল বটে, কিন্তু ২০০৯ সালেই এগুলো জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছায়। ২০০৯ সাল ছিল ফেসবুকের বদলে যাওয়ার বছর। ওই বছর জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়ন। কিন্তু কেবল ওই বছরের ১২ মাসেই নতুন আরও ২০০ মিলিয়ন নতুন ব্যবহারকারী ফেসবুকে নিবন্ধন করে। এছাড়া টুইটারও ওই বছর শেষ করে ১৮ মিলিয়ন ব্যবহারকারী নিয়ে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, এই মুহূর্তে যাদের বয়স ২৫ বা ততোধিক, তাদের অধিকাংশই প্রথম ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছিল ২০০৯ সালে। ১০ বছরে তাদের বয়স যেমন বেড়েছে, তেমনই ১৫ বছরের চেহারার সাথে ২৫ বছরের চেহারারও আকাশ-পাতাল তফাৎ দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টিই সেসব ব্যবহারকারীকে অনুপ্রাণিত করছে এমন একটি চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে সবার সামনে নিজের পরিবর্তনটিকে তুলে ধরতে।
কীভাবে ভাইরাল হলো ট্রেন্ডটি?
প্রথম কার হাত ধরে এই ট্রেন্ডটির প্রচলন ঘটেছিল, তা আমরা কোনোদিনও জানতে পারব না। তবে এই ট্রেন্ডটি ভাইরাল করতে যার অবদান রয়েছে, তার সন্ধান কিন্তু আমরা ঠিকই পেয়েছি। তিনি হলেন আমেরিকার ওকলাহোমায় বসবাসরত কোকো নিউজের প্রধান মেটেওরোলজিস্ট ডেমন লেন। গত ১১ জানুয়ারি তিনি নিজের দশ বছর আগের এবং বর্তমানের দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে ফেসবুকে পোস্ট করেন, কীভাবে দশ বছরে তার জীবন পাল্টে গেছে তা লেখেন, এবং অন্যদেরকেও চ্যালেঞ্জ জানান দশ বছরে তাদের কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা দেখাতে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তার সেই পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়, এবং তার দেখাদেখি অন্যরাও দশ বছরে নিজেদের কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে নাকি আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়নি, তা দেখাতে শুরু করে। প্রথম তিনদিনেই এই বিষয়ক ৫২ লক্ষ পোস্ট হয় ফেসবুকে। এছাড়া ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোড়ন পড়ে যায় এই ট্রেন্ডের।
এই ট্রেন্ডটিকে ভাইরাল করায় কি ফেসবুকের হাত আছে?
যেকোনো জনপ্রিয় জিনিসের পেছনেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটতে খুব বেশি সময় লাগে না। একই কথা প্রযোজ্য টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জের ব্যাপারেও। আপাতদৃষ্টিতে খুবই নির্মল বিনোদনের মাধ্যম বলে এটিকে মনে করা হলেও, কেউ কেউ মনে করছেন এর পেছনে আরও গূঢ় কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ ব্যাপারটি প্রথম সকলের দৃষ্টিগোচরে আনেন ওয়্যারড ম্যাগাজিনের লেখিকা কেটি ও’নিল। সকলে যখন টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে নিজের দশ বছর আগের ছবি খুঁজে বের করতে ব্যস্ত, নিজের টুইটার একাউন্ট থেকে একটি ব্যাঙ্গাত্মক টুইট করেন তিনি, যেখানে ইঙ্গিত দেন কীভাবে টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জের ডেটাগুলোকে ফেস-রিকগনিশন অ্যালগরিদমের কাজে লাগাতে পারে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
কেটির টুইটটিও যখন টুইটারে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, তখন নিজের ম্যাগাজিনেই এ ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্টিকেল লেখেন তিনি, যেখানে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেন বিষয়টি। তার মতে, ফেসবুক বা অন্য যে কেউ যদি এমন উন্নতমানের একটি ফেস রিকগনিশন সিস্টেম তৈরি করতে চায় যার মাধ্যমে কেবল একজন মানুষের বর্তমান ছবি দেখেই তাকে চিহ্নিত করা যাবে না, পাশাপাশি সময়ের সাথে সাথে ওই ব্যক্তির চেহারা, মুখভঙ্গি ও অভিব্যক্তিতে কী কী ধরণের পরিবর্তন এসেছে ও ভবিষ্যতে আসতে পারে, তা নিরূপণ করাও যাবে, সেক্ষেত্রে এ ধরণের ডেটা খুবই কাজে লাগতে পারে।
নিজের যুক্তিকে আরও জোরদার করতে তিনি লেখেন, সাধারণত মানুষ ফেসবুকে ছবি তুলে সাথে সাথেই পোস্ট করে না। এমন অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কেউ একজন হয়তো আজ একটি ছবি তুললো, কিন্তু অনেকদিন পরে সেটি আপলোড দিল। এমনকি অনেকে তিন-চার বছর আগেকার ছবিও নতুন করে আপলোড দিয়ে থাকে। তাই কেবল আপলোডের তারিখ দিয়েই সময়ের ব্যবধানের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না। এই সমস্যাটির সমাধান করে দিচ্ছে টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে ব্যবহারকারীরা যে দিন বা বছরের ছবি কাজে লাগাচ্ছে, সেটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দিচ্ছে। তাই এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগই নেই। ফেসবুক যদি তার ফেস রিকগনিশন অ্যালগরিদমকে আরও কার্যকর ও নিখুঁত হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে চায়, তাহলে এমন একটি চ্যালেঞ্জ সত্যিই অনেক সহায়ক হবে। আর তাই ফেসবুক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এই চ্যালেঞ্জের ট্রেন্ডটিকে ভাইরাল করে থাকতে পারে।
ফেসবুকের কী বক্তব্য এ ব্যাপারে?
কেটি ও’নিলের ষড়যন্ত্র তত্ত্বটিকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমলে না নিলেও পারত। কিন্তু কেটির টুইটের মতো, আর্টিকেলটিও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে, এবং তারা এখন সত্যিই আশঙ্কা করছে ফেসবুক হয়তো আসলেই টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জের ছবিগুলোকে ফেস রিকগনিশনের কাজে লাগাতে পারে। আর যেহেতু ডেটা ফাঁস করায় ফেসবুকের অতীত ইতিহাস ভালো না, তাই অনেকে নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতে শুরু করে দিয়েছে। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফেসবুকের কী বক্তব্য, তা জানতে অনেকেই উদগ্রীব হয়ে ছিল। জনসাধারণের দাবি মেনে ফেসবুক মুখ খুলেছেও।
ফেসবুকের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন,
“এটি একটি ব্যবহারকারী-উৎপাদিত মিম, এবং এটি নিজে থেকেই ভাইরাল হয়ে গেছে। ফেসবুক এই ট্রেন্ডটির সূচনা ঘটায়নি, তাছাড়া এই মিমে ব্যবহার হওয়া ছবিগুলো আগে থেকেই ফেসবুকে ছিল। তাই নতুন করে এসব মিম থেকে ফেসবুকের কিছু পাওয়ার নেই (কেবল এটুকু বুঝতে পারা যে ২০০৯ সালে মানুষের ফ্যাশন ট্রেন্ড কতটা আপত্তিকর ছিল)। তবে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ব্যবহারকারীরা কিন্তু চাইলেই যেকোনো সময়ে ফেসিয়াল রিকগনিশন ফিচারটি বন্ধ করে দিতে পারে।”
এই ট্রেন্ড কি মানুষের নার্সিসিজমের আরও একটি নিদর্শন?
টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ আসলেই কতটা চ্যালেঞ্জ, এ বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বরং এটিকে অনেকেই মনে করছে নিজেদের নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম প্রকাশের আরও একটি মুক্তমঞ্চ হিসেবে। এবং এমন দাবিকে নেহাতই ফেলনা মনে করারও কোনো কারণ নেই। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেবল ওসব মানুষই টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে যারা গত দশ বছরে খুব বেশি বদলায়নি, অথবা বদলালেও সেই বদলটি ইতিবাচক দিকেই হয়েছে। মানুষজন এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে দেখাচ্ছে বয়স তাদের চেহারায় কোনো প্রভাব ফেলেনি, বয়স তাদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে নিজেদেরকে সবার সামনে জাহির করা, এবং তার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজেদের আত্মপ্রেমের বহিঃপ্রকাশই কিন্তু ঘটছে।
তাছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দশ বছরে চেহারা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু খুব কমই দেখা যাচ্ছে। তার মানে কি দশ বছরে সবাই-ই অপরিবর্তিত রয়েছে বা উন্নত হয়েছে? মোটেই না। আসল ব্যাপারটি হলো, যাদের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে, তারা এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিচ্ছেই না, কিংবা খুব কম নিচ্ছে। আবার অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের ‘শো অফ’ পছন্দ করে না বলেও এই চ্যালেঞ্জে সামিল হচ্ছে না। তাই ঘুরেফিরে সেই নার্সিসিজমের বিষয়টিই আবারও চলে আসছে। যারা নিজেদের চেহারা নিয়ে খুব বেশি আত্মতৃপ্তিতে ভোগে এবং অন্যদেরকে তা দেখানোর মাধ্যমে আরও অধিক সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, তারাই বেশি বেশি এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিচ্ছে। ফলে তাদের নার্সিসিজমটাই আরও প্রকট হয়ে উঠছে।

তবে হ্যাঁ, এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা মানেই যে নার্সিসিস্ট হয়ে যাওয়া, তেমনটিও নয় অবশ্যই। নিছক আগ্রহের বশে, কিংবা মজার ছলেও অনেকেই এতে অংশ নিচ্ছে। তাই কেউ যদি টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জে অংশ নেয়, তাহলেই সে নার্সিসিস্ট, এমন অতিসরলীকরণ মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য এই ট্রেন্ড আশির্বাদ না অভিশাপ?
এই বিষয়টি নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। যেসব ব্যক্তি গত দশ বছরে লিঙ্গ পরিবর্তন করেছে, তাদের জন্য এই ট্রেন্ডটি একদিকে যেমন নিজেদেরকে উপস্থাপনের বড় একটি সুযোগ হতে পারে, তেমনই এই ট্রেন্ডটি তাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করছে ট্রান্সজেন্ডারদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
অনেকেরই অভিমত, ট্রান্সজেন্ডাররা যে তাদের লিঙ্গ পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন একটি লিঙ্গ গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে, তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার খুব সুন্দর একটি মাধ্যমে হতে পারে এই টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ। এবং এর মাধ্যমে খুব সহজেই ট্যাবু ভাঙা যেতে পারে। কিন্তু বিপরীত মতাবলম্বীর সংখ্যাই বোধহয় বেশি। অনেক মানবাধিকারকর্মীই ট্রান্সজেন্ডারদের উপর টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জের ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে মুখ খুলেছে। তারা বলছে, বেশিরভাগ ট্রান্সজেন্ডারই চায় তাদের অতীত ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকাতে, নতুন করে জীবন শুরু করতে। কিন্তু এই ধরনের চ্যালেঞ্জ, যা তাদের অতীতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের অতীতকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে বলছে, তা তাদের জন্য মর্মযাতনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এই দুই বিপরীতধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি মূলত সার্বিকভাবেই ট্রান্সজেন্ডারদের দ্বান্দ্বিক মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করছে। একশ্রেণীর স্বাধীনচেতা ট্রান্সজেন্ডাররা যেখানে নিজেদের শারীরিক পরিবর্তন ও সিদ্ধান্ত নিয়ে খুশি এবং গর্বভরে তা মানুষকে জানাতে চায়, অন্যশ্রেণীর ট্রান্সজেন্ডাররা এখনও তাদের অতীতকে লজ্জাজনক অধ্যায় বলে মনে করে, এবং সেই অতীত সকলের সামনে উন্মোচিত হোক তা কিছুতেই চায় না। শুধু টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ না, ভবিষ্যতে ট্রান্সজেন্ডাররা আরও অনেক ট্রেন্ডের ব্যাপারেই অস্বস্তিতে ভুগবে, যদি না তারা বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে পারে, এমনটিই বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের।
এই ট্রেন্ড কি সাধারণ মানুষের উপর কোনো মানসিক প্রভাব ফেলছে?
অবশ্যই। দশ বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। দশ বছর আগে হয়তো কারও জীবন অনেক সুন্দর ছিল, পরিবারের সব সদস্য বেঁচে ছিল, বন্ধুবান্ধব সবাই সাথে ছিল। তাই ঐ সময়ে তোলা ছবিগুলো তাদের মানসিক উৎফুল্লতারই পরিচায়ক। কিন্তু মাঝের দশ বছরে হয়তো অনেকেই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে জীবনে বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে। তাই এমন একটি ভাইরাল ট্রেন্ডের মাধ্যমে অন্যরা যখন নিজেদের পরিবর্তনটা তুলে ধরছে এবং তাদেরকেও এই কাজে উৎসাহিত করছে, তাতে নতুন করে তাদের বিষণ্নতা বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাছাড়া দশ বছর আগে কেউ হয়তো দেখতে সুন্দর ছিল, এখন বুড়িয়ে গেছে; দশ বছর আগে কেউ হয়তো হেঁটে বেড়াতে পারত, পরে কোনো দুর্ঘটনায় তারা পঙ্গু হয়ে গেছে – এসব ক্ষেত্রেও টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শেষ কথা
যেকোনো জিনিসের ভালো দিক, খারাপ দিক, দুই-ই থাকে। ঠিক তেমনটিই ঘটেছে টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রেও। কিন্তু দিনশেষে এটি অবশ্যই একটি সহজ-সরল বিনোদনের অনুষঙ্গ। একে অযথা জটিল করতে না যাওয়াই শ্রেয়। তবে তাই বলে এটি যেন কেবলই শো-অফ হয়ে না যায়।
ডেমন লেন নামের যে ব্যক্তি এই ট্রেন্ডটিকে ভাইরাল করেছেন, তিনি কিন্তু দশ বছর আগের তার সাথে বর্তমান তার কেবল চেহারার পার্থক্যতেই গুরুত্ব দেননি, বরং সামগ্রিকভাবে তার জীবন কতটা বদলে গেছে, সেটিতেও আলোকপাত করেছেন। আমরাও গত দশ বছরে আমাদের চেহারার সাথে সাথে জীবনেও কতটা পরিবর্তন ঘটেছে তা সবাইকে জানাতে পারি, এবং আরও দশ বছর পর আমরা নিজেদেরকে জীবনে কোথায় দেখতে চাই, সে-ব্যাপারেও একটি চ্যালেঞ্জ নিতে পারি। তাহলে কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জটি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/