বিশ শতকের প্রথম দিকের কথা, রেডিও ব্যবস্থা তখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রেডিওতে গান বা তাৎক্ষণিক খবর সম্প্রচার নতুন মাত্রা যোগ করেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। এদিকে বিনোদনের আরেকটি উৎস হয়ে উঠতে শুরু করেছে হলিউড সিনেমা। এ দুইয়ে মিলিয়ে অনকেই ভাবতে শুরু করেছেন রেডিওতে যেমন অডিও সম্প্রচার করা হয়, তেমনি করে কোনোদিন সিনেমার মতো ভিডিও সম্প্রচার করাও সম্ভব হবে কিনা!
ভিডিও সম্প্রচারের বিষয়টি শুনতে যতোটাই স্বাভাবিক ও অসাধারণ লাগুক না কেন, প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি বেশ জটিল একটি সমস্যা ছিল। এর জটিলতার কারণ বুঝতে হলে আমাদের ভিডিও বিষয়টিকে খানিকটা বিশ্লেষণ করতে হবে। ভিডিও অনেকগুলো স্থির চিত্র দিয়ে গঠিত হয়। একটি থেকে অন্য একটি ছবির পরিবর্তন বেশ সামান্য হয়। ছবিগুলোকে যখন অনেক দ্রুতগতিতে দেখানো হয়, তখন আমাদের মনে হয় আমরা চলমান কিছু দেখছি। এটিকে আমাদের মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা বলা চলে। সে অতি দ্রুতগতিতে দেখানো স্থির-চিত্রকে চলমান বলে মনে করে।
উদাহরণস্বরূপ এ চারটি ছবি দেখুন। এ ছবিগুলো একটির থেকে অন্যটি কিছুটা ভিন্ন। বাচ্চাটির বাঁ-পায়ের দিকে লক্ষ্য করুন, এটি পর পর ছবিগুলোতে একটু একটু করে উপরে উঠছে। আর খেলনাটিও প্রত্যেকটা ছবিতে একটু করে এগোচ্ছে। এবার নিচের gif ফাইলটি দেখুন। ছবিগুলোকে দ্রুতগতিতে দেখানোর ফলে মনে হচ্ছে এটি আসলে স্থির-চিত্রের সমষ্টি নয় বরং চলমান কোনো ছবি। সব ভিডিওর ক্ষেত্রেই বিষয়টি এরকম। অর্থাৎ ভিডিও আদতে স্থির-চিত্র দিয়ে গঠিত হয়।
এবার স্থির-চিত্রকে বিশ্লেষণ করা যাক কিছুটা। এক-একটি ছবির ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয় পিক্সেল। ইমেজকে একটি গ্রিড হিসেবে ভাবলে পিক্সেল হচ্ছে এ গ্রিডের একটি ক্ষুদ্র বর্গাকার ঘর। এক একটি পিক্সেলের রঙ ও আলোর তীব্রতা (ইন্টেনসিটি) ভিন্ন ভিন্ন হয়। আমাদের কোনো ছবিকে সম্প্রচার করতে হলে, এর প্রত্যেকটি পিক্সেলের তথ্য পাঠাতে হবে রিসিভারে। এরপর রিসিভারে পিক্সেলগুলোকে ঠিক জায়গামতো একত্রিত করে দেখাতে পারলেই আমরা পাবো কাঙ্ক্ষিত ইমেজ। আর বেশ কয়েকটি ইমেজকে দ্রুতগতিতে পাঠাতে পারলে আমরা করতে পারবো ভিডিও সম্প্রচার।
গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হলে কয়েকটি সমস্যার সমাধান দরকার হয়। প্রথমত, এই ছবির পিক্সেলগুলোকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই বৈদ্যুতিক সংকেতকে রিসিভারে পাঠানোর পর তাকে আগের ছবির মতো সাজাতে হবে। সবশেষে এ দুটি প্রক্রিয়াকে অনেক দ্রুতগতিতে পুনরাবৃত্তি করতে হবে, যাতে দর্শক একটি চলমান ভিডিও দেখেন।
টেলিভিশনের ধারণা আসার অনেক আগেই প্রথম সমস্যাটির সমাধান করে রেখেছিলেন জার্মান প্রকৌশলী পল নিপকভ। ১৮৮৪ সালের দিকে তিনি একটি অপটিক্যাল ডিভাইস উদ্ভাবন করেন, যা পরে নিপকভ ডিস্ক নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এতে একটি ঘূর্ণায়মান ডিস্ক ছিল, যার প্রান্তের দিকে অনেকগুলো ছিদ্র সর্পিলাকারে সাজানো ছিল। এ ডিস্কের ছিদ্রগুলো থেকে আসা আলো ফেলা হতো একটি ডিটেক্টরে। ডিটেক্টরটি ছিল একটি আলোক সংবেদী পদার্থ দিয়ে তৈরি, যাতে আলো পড়লে সেটি সে অনুসারে ইলেকট্রিক্যাল ভোল্টেজ উৎপন্ন করতো।
নিপকভ ডিস্ক যখন ঘুরতো তখন এর ছিদ্রগুলো সামনে রাখা ছবির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত, একে একে গোটা অংশটির উপর দিয়ে ঘুরে যেত। এ প্রক্রিয়াকে স্ক্যানিং বলা হয়। স্ক্যানিংয়ের ফলে একে একে গোটা ছবি থেকে আলো এসে পড়তো ডিটেক্টরে। ডিটেক্টর সে আলোর ইন্টেনসিটি অনুযায়ী ইলেকট্রিক্যাল ভোল্টেজ উৎপন্ন করতো। ফলে একটি ছবি সহজেই ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে রূপান্তরিত হয়ে যেতো। এ সিগন্যালকে এবার খুব সহজেই দূর দূরান্তে পাঠানো যেত। থিওরিটিক্যালি এ সিগন্যালকে কাজে লাগিয়ে এবার আগের চিত্রটি পাওয়া সম্ভব।
এরপর কয়েক দশক ধরে বেশ কয়েকজন গবেষক নিপকভ ডিস্ক নিয়ে কাজ করেন। ১৯২৩ সালের দিকে জন লগি বেয়ার্ড নামের একজন স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার প্রথম এ ডিস্ক ব্যবহার করে ভিডিও সম্প্রচার করতে সক্ষম হন। এতে তিনি দুটি ডিস্ক ব্যবহার করেন। একটি উপরের বর্ণনার মতো করে ছবিকে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে রূপান্তর করতো। অন্যটি থাকতো রিসিভারে, যেটি আগেরটির মতো সমান গতিতে ঘুরতো। এ দুটির সমন্বয়ের ফলে পিক্সেলগুলো ঠিকঠাক অবস্থানমতো সাজানো যেত। রিসিভারে বৈদ্যুতিক বাতি থাকতো। যেটি ইলেকট্রিক্যাল ভোল্টেজ অনুসারে বিভিন্ন ইন্টেনসিটির আলো দিত। এভাবে পিক্সেলগুলোর রঙ ও অবস্থানের সমন্বয় করে বেয়ার্ড তৈরি করে ফেলেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল টেলিভিশন।
যদিও বেয়ার্ডের এ উদ্ভাবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তার এ সম্প্রচার ব্যবস্থা ছিল খুবই নিন্মমানের। ১৯২৬ সালে তার দেখানো প্রথম সম্প্রচারে তিনি মাত্র তিরিশটি উলম্ব রেখা স্ক্যান করতে সমর্থ্য হন। প্রতি সেকেন্ডে সম্প্রচার করতে পারেন মাত্র পাঁচটি ফ্রেম। এর দুর্বলতার পেছনে বড় কারণ ছিল নিপকভ ডিস্কের মেকানিক্যাল প্রকৃতি। ডিস্কগুলো ঘুরে ঘুরে স্ক্যানিং করার কারণে, সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতো না। এ সমস্যার সমাধান লুকিয়ে ছিল ইলেকট্রনিক্সে। কিন্তু সে সময়ের বড় বড় সব কোম্পানিগুলো এ বিষয়টি ধরতে পারেনি।
বেয়ার্ডের সাফল্যের পর এটিএন্ডটি, জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কোম্পানিগুলো টেলিভিশন নিয়ে গবেষণায় লেগে পড়ে। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ-কড়ি ও জনবল নিয়োগ দেয় নিপকভ ডিস্ককে উন্নত করার কাজে। তারা বুঝতে পারেনি যে এক কানা গলির পথ ধরে এগোচ্ছে তারা। যে পথে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। শেষতক এ সমাধানের পথ খুঁজে বের করেছিলেন ফাইলো ফার্ন্সওর্থ নামের এক খামার-বালক।
১৯২১ সালের কথা, ফার্ন্সওর্থের বয়স তখন পনের বছর। এসময় টেলিভিশনের ধারনাটি পেয়ে বসে তাকে। টেলিভিশন নিয়ে যেখানেই যা পায় তা পড়তে শুরু করে সে। খুঁজতে খুঁজতে নেচার সাময়িকীতে এ.এ. ক্যাম্পবেল সুইন্টন নামের এক ভদ্রলোকের লেখা একটি আর্টিকেল নজর কাঁড়ে তার। ১৯০৮ সালে লেখা সে নিবন্ধে সুইন্টন ইমেজ স্ক্যানিং ও প্রদর্শনের জন্যে ইলেকট্রনিক রশ্মি ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে এ প্রস্তাবনার বাইরে এ নিয়ে আর এগোননি তিনি।
আমরা জানি ইলেকট্রনের ভর অত্যন্ত কম; মাত্র ৯.১০৯ × ১০^(–২৮) গ্রাম। এছাড়া ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা থেকে ততদিনে জানা হয়ে গেছে যে, চুম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে ইলেকট্রনের রশ্মিকে নিয়ন্ত্রণ ও ফোকাস করা যায়। সব মিলিয়ে স্ক্যানিংয়ের জন্য একদম আদর্শ প্রযুক্তি। ঘর্ষণ বা জড়তাজনিত কোনো বাঁধা ছাড়াই স্ক্যানিং করতে পারবে এটি। কোনো মেকানিক্যাল ডিভাইসের সাহায্যে এর কাছাকাছি কার্যকরিতা অর্জনের কথা কল্পনা করাও সম্ভব না।
ফার্ন্সওর্থ এ সম্ভাবনাটি নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। তার বর্ণনা অনুসারে, একদিন একটি ট্রাক্টরকে এগিয়ে পিছিয়ে জমি চষতে দেখে তার মাথায় নতুন করে ঝেঁকে বসে স্ক্যানিংয়ের ধারণাটি। কলেজে নেওয়া কোর্সগুলোর কল্যাণে তিনি ততদিনে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের কথা জানতেন। তাছাড়া আলোক সংবেদী পদার্থ ব্যবহার করে ইলেকট্রনের সাহায্যে কীভাবে কোনো স্ক্রিনকে আলোকিত করা যায় তা-ও জানা ছিল।
সব মিলিয়ে তিনি একটি সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক টেলিভিশন ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা করেন। তার পরিকল্পিত টেলিভিশন ব্যবস্থায় ক্যামেরাটি হবে ইলেকট্রনিক, যেটি ফটোইলেকট্রিক প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে ভিডিও চিত্রকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর করবে। ক্যাথোড রশ্মি ডিভাইস ব্যবহার করে তৈরি হবে ডিসপ্লে ব্যবস্থাও। স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে যেটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলবে চলমান ছবি। বেয়ার্ডের ব্যবস্থায় যেমন নিপকভ ডিস্ক মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে, ফারন্সওর্থের ব্যবস্থায় তেমনি ক্যাথোড রে টিউব বা সিআরটি প্রযুক্তি কাজ করে মেরুদণ্ড হিসেবে।
পরিকল্পনা শেষে বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যে ছয় হাজার ডলারের তহবিল গড়ে কাজে লেগে পড়েন তিনি। নামজাদা বিশালাকায় কোম্পানিগুলোর তোয়াক্কা না করে, এ নতুন পথে চলা শুরু করে দেন আঠারো বছরের ফাইলো ফারন্সওর্থ। কী ভাবছেন, এরপর সব ঠিকঠাকভাবে হয়ে গেল? না ঘটনাটি তেমন নয়। ফ্রান্সওর্থ ঠিকই টেলিভিশন তৈরি করতে পেরেছিলেন। তবে তার নায়কোচিত উদ্ভাবনের এ গল্পে আগমন ঘটেছিল খলনায়কেরও। এফ.এম রেডিও উদ্ভাবনের সে কাহিনীর মতো এক্ষেত্রেও বিখ্যাত একটি কর্পোরেশন এসে হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল তার উদ্ভাবনের কৃতিত্ব। সেসব গল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে আগামী লেখায়।