
স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর অনেকেই ধারণা করেছিল, অ্যাপল তাদের ব্যবসায় হোঁচট খাবে। কিন্তু তখনের অ্যাপলের থেকে আজকের চিত্র সম্পূর্ণই আলাদা। অ্যাপলের শেয়ারমূল্য রেকর্ড ছাড়িয়েছে, এবং বর্তমানে কোম্পানিটির বাজারমূল্য প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কানাডা, রাশিয়া বা স্পেনের জিডিপির চেয়েও বেশি। আর স্মার্টফোনের বাজারে বরাবরের মতোই তারা তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করা টিম কুক স্টিভ জবসের সৃষ্টিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। সারা বিশ্বে অ্যাপলের পৃথক একটি ফ্যানবেজ তৈরি হয়েছে এবং একে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নির্মাতা হিসেবে। এছাড়া সৌন্দর্য ও গুণগত মানের ধারাবাহিকতাও তারা যথাযথভাবে বজায় রেখেছে।
অ্যাপলের সিইও কথন
কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় ১৯৮৫ সালে স্টিভ জবসকে পদত্যাগ করতে হয়। কারণ বোর্ড ডিরেক্টররা ভেবেছিলেন, কোম্পানির অগ্রগতিতে তিনি কোনো প্রধান ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু জবসের চলে যাওয়ার পরেই কোম্পানিটি চরম অধঃপতনের শিকার হয়। পরবর্তী বারো বছর অ্যাপল ভিন্ন তিন সিইও-কে পায়, কিন্তু কারো মাঝেই অ্যাপলের সৌভাগ্য ফিরিয়ে আনার মতো গুণাগুণ ছিল না।

১৯৯৭ সালে পুনরায় স্টিভ জবস অ্যাপলের সিইও হিসেবে ফিরে আসেন। এরপরই তিনি অ্যাপলকে উপহার দেন তার উদ্ভাবনী জাদু। জবসের চিন্তাধারা ছিলো অনেকগুলো সাধারণ পণ্য তৈরি না করে কিছু অসাধারণ পণ্য তৈরি করার। এই সিদ্ধান্তই অ্যাপলকে তখন দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। তিনি শুধু নতুন কিছু উদ্ভাবনই করেননি, কোম্পানির মূল জায়গাগুলোতে নিয়োগ করেছিলেন গুণী মানুষদের, যারা এখন পর্যন্ত অ্যাপলকে পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। স্টিভ জবস অ্যাপলের উন্নয়নের নীলনকশা তৈরি করে গিয়েছেন, আর সেই নকশা অনুসরণ করেই টিম কুক অ্যাপলকে প্রথমে বানিয়েছেন বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি।
টিম কুকের অ্যাপলে পথচলা
১৯৭৮ সালে হাই স্কুল জীবন শেষ করার পর কুক আলাবামার অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরপর ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুকুয়া স্কুল অফ বিজনেস থেকে ১৯৮৮ সালে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
ছাত্র হিসেবে তিনি বরাবরই ভালো ছিলেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরেই তিনি আইবিএম-এ যোগ দেন। ১২ বছর আইবিএম-এ কাজ করার পর ১৯৯৪ সালে তিনি যোগ দেন ইন্টেলিজেন্ট ইলেকট্রনিক্স-এ। এর তিন বছর পর কমপ্যাক্ট কম্পিউটার কর্পোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন, তবে সেখানে বেশি দিন থাকেননি। ৬ মাস পরে অ্যাপলে যোগ দেন কুক।

২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আবিস্কার ছিলো শুধুমাত্র একটি সিদ্ধান্তের ফল।” আসলে সেসময়ে অ্যাপলে যোগদানের সিদ্ধান্ত অনেকটা কঠিনই ছিল বলা যায়। তখন কোনো আইফোন, আইপ্যাড ছিল না, এবং অ্যাপল লাভের চেয়ে লোকসানের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছিল। টিম কুক নিজেও বলেছিলেন, তখন কোম্পানির কোনো ভবিষ্যত দেখছিলেন না তিনি।
যখন অ্যাপল শুধু ম্যাক তৈরি করতো, তখন বছরের পর বছর কোম্পানিটির লোকসান যাচ্ছিল, এবং ভাবা হয়েছিল অ্যাপল ধ্বংসের কিনারায় চলে এসেছে। টিম কুক যখন অ্যাপলে যোগ দেন, তার কয়েক মাস পূর্বে মাইকেল ডেলকে (ডেলের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা) জনসম্মুখে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- অ্যাপলকে ঠিক করার জন্য কী করা প্রয়োজন। তিনি উত্তর দেন, এটি বন্ধ করে দিয়ে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়া উচিত।
এসবের মাঝে কুক অ্যাপলে যোগ দিয়ে এক বছরেই ভাইস প্রেসিডেন্ট বনে যান এবং কোম্পানি থেকেও লাভ আসতে থাকে। এরপর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সালে চিফ অপারেটিং অফিসার পদে নিযুক্ত হলে তিনি বৈশ্বিক কেনাবেচা ও ক্রিয়াকলাপের দায়িত্ব নেন, যার মাঝে ম্যাকিন্টস বিভাগ পরিচালনার দায়িত্বও ছিল। তিনি অ্যাপলের ইনভেন্টরি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেন, যার ফলে পণ্যসমূহ পূর্বের চেয়ে তুলনামূলক কম সময়েই গ্রাহকদের হাতে পৌঁছার সুযোগ তৈরি হয়।
সিইও হিসেবে কুক
২০১১ সালে সিইও পদে যোগ দেয়ার আগে কুক ২০০৭ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করেন। তার সিইও হিসেবে পদোন্নতি হওয়ার পরই স্টিভ জবস মৃত্যুবরণ করেন। ফলে কুকের সিইও জীবনের শুরুটা তেমন মসৃণ ছিলো না। জবস একজন অসামান্য ব্যক্তি ছিলেন। তার আদর্শ ধরে কোম্পানি চালানো কোনো সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু কুক সফলভাবে সিইও হিসেবে তার প্রথম বছর পার করেন এবং টাইম ম্যাগাজিনের ‘One Hundred Most Influential people’-এ নিজের নাম লেখান। কিন্তু এ ছিল কেবল শুরু।

তবে ২০১২-এর শেষভাগে অ্যাপলের রেভিনিউ আশানুরুপ ছিল না, এবং কর্মকর্তাদের মাঝে এ নিয়ে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। এর সমাধানকল্পে কুক অ্যাপলের লিডারশীপ টিমকে ঢেলে সাজান এবং কিছু কর্মকর্তাকে অ্যাপল ছাড়তে বলা হয়। অ্যাপলকে নতুন করে সাজানো নিয়ে ভেতরে-বাইরে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কুকের ব্যাপারে আরও বিতর্ক হয় যখন তিনি নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করেন এবং কাঁচামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও কঠোরতা নিয়ে আসেন। অনেকের মনে হতে পারে, পরিবেশের উপকার করলে বিতর্ক কেন তৈরি হবে? আসলে তখন অনেক বিনিয়োগকারীর অ্যাপলের এসব সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি। তারা টিম কুককে পরামর্শ দিয়েছিলেন সেসব ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করতে যেগুলো তাদের তৎক্ষণাৎ লভ্যাংশ এনে দেবে। কুক অবশ্য এর জোরালো উত্তর দিয়ে বলেন,
যখন আমরা আমাদের পণ্যকে অন্ধদের ব্যবহারোপযোগী হিসেবে তৈরি করতে কাজ করি, তখন আমি আরওআই (রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট)-এর কথা চিন্তা করি না। যদি আপনারা আমাকে শুধু লাভের দিকে দেখে কাজ করতে বলেন, তাহলে আপনাদের স্টক থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।
কুক বরাবরই স্পষ্টভাষী। কিন্তু তার এই বক্তব্য অ্যাপলকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। আরেকটি বিতর্কিত ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে যখন এফবিআই সান বারডিনো গোলাগুলির একজন সন্দেহভাজনের আইফোনের তথ্য চাওয়ার জন্য অ্যাপলের কাছে অনুরোধ করে। কিন্তু টিম কুক সেই আইফোন আনলক করতে অস্বীকৃতি জানান। কোর্ট থেকে অ্যাপলকে নির্দেশ দেয়া হলে টিম কুক জনগণের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন, যাতে লেখা ছিল- অ্যাপলকে যদি সরকারের সাথে সম্মতি প্রদানে বাধ্য করা হয়, তাহলে গোপনীয়তা আইনের ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় তৈরি হবে।

তবে শুনানির আগের দিন এফবিআই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আইফোনটি খুলতে সক্ষম হয় এবং মামলাটি সরিয়ে নেয়া হয়। কুকের বিরুদ্ধে নতুন উদ্ভাবনের স্বল্পতার অভিযোগও আনা হয়। তবে কুক এর বিরোধিতা করেন। স্টিভ জবসের মতো উদ্ভাবনী ক্ষমতা না থাকলেও তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা অ্যাপলে বড় মাপের লাভ এনে দেয়।
২০০৫ সালে তিনিই প্রথম ন্যান্ড ফ্ল্যাশ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং এতে দ্রুত বিনিয়োগ করার তাগিদ দেন। যার ফলে আইপ্যাড, আইপড, আইফোনের মতো ডিভাইসে এটি ব্যবহার করা হয় এবং দ্রুতই তা অন্য সবার মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কুক উৎপাদন খরচ কম রেখে ডিভাইসপ্রতি লাভের হার বৃদ্ধি করেন, যা অ্যাপলের মুনাফা আরও বাড়িয়ে তোলে।

২০১৪ সালে অ্যাপল বিটস মিউজিককে কিনে নেয় এবং একই বছরে অ্যাপল পে, বার্স্ট সেলফি ও অ্যাপল ওয়াচ এবং অ্যাপল নিউজের মতো জনপ্রিয় ফিচারের ঘোষণা দেয়। জবসের অনুপস্থিতিতে অ্যাপল ওয়াচ একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন ছিল। বর্তমানে অ্যাপল নিজেদের এমন এক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে যে অন্য কোম্পানিগুলোও অ্যাপলকে অনুসরণ করে নিয়মিতই।
ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া
সিইও হিসেবে টিম কুক যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন অ্যাপলের মূল্য ছিল ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা এখন ২ ট্রিলিয়নে পরিণত হয়েছে। ১ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হতে অ্যাপলের সময় লেগেছে ৪২ বছর, এবং ২ ট্রিলিয়নে যেতে শুধু ২ বছর। এ পরিসংখ্যানই বলে দেয় অ্যাপল কত শক্তিশালী হয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে।
কুক অ্যাপলকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। চীন, ভারতের মতো বড় বাজারের দেশগুলোতে তৈরি করেছেন কারখানা। ক্লাউড পরিসেবাতে যোগ দিয়ে সাবসক্রিপশনের মাধ্যমে মুনাফা তৈরির ব্যবস্থা করেছেন। অ্যাপ স্টোরের In-app-purchase ব্যবস্থায় ৩০ শতাংশ কর্তন নিয়ে ‘এপিক গেমস’-এর সাথে বিতর্ক তৈরি হলেও এ থেকে প্রাপ্ত মুনাফাও অ্যাপলের রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভালো প্রভাব ফেলেছে। সব মিলিয়ে অ্যাপল এমন একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে যা তাদের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সার্বিকভাবে কাজ করছে। তুলনামূলক কম নতুনত্ব এনেও অ্যাপলকে ট্রিলিয়নের ঘরে নিয়ে গিয়েছেন টিম কুক যা সত্যিই অতুলনীয়।

শুধু অ্যাপলেই নয়, এর বাইরেও কুক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। এর মাঝে বৈশ্বিক জলবায়ু, নবায়নযোগ্য শক্তি ছাড়াও ২০১২ সালে তিনি সিলিকন ভ্যালির হাসপাতালগুলোতে ৫০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেন যা নতুন অবকাঠামো নির্মাণ ও শিশু হাসপাতাল তৈরিতে ব্যয় করার নির্দেশ দেন। এছাড়া মৃত্যুর পর তার নিজস্ব সম্পদ দান করার কথাও বলেছেন তিনি।
সর্বোপরি, কুক অ্যাপলের সিইও হিসেবে যোগদানের পর নিজেকে এবং অ্যাপলকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, যা আর কারো পক্ষে করাই সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের সেরা সিইও-দের মাঝে যে তার নাম থাকবে, তা বলা যায় কোনো সন্দেহ ছাড়াই।