বর্তমানে বাংলাদেশের শতকরা ৪৯ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স ১৫-৩০ এর মধ্যে। তাদের জগতের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ভাইরাল কন্টেন্ট। ইন্টারনেটের কোনো এক কোনায় কেউ কিছু লিখলো, বা তৈরি করলো কোনো ছবি বা ভিডিও। তা রাতারাতি ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন সাইটে, অনেক অনেক মানুষ তা দেখলো, পছন্দ করলো কিংবা অনেক বেশি সমালোচনার ঝড়ে মাতলো- এ ব্যাপারটিকেই বলে কন্টেন্ট ভাইরাল হওয়া। আজ অল্পবয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ভাইরাল কন্টেন্টের আশপাশে থাকতেই স্ক্রিন চাপছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু কেন কিছু জিনিস ভাইরাল হচ্ছে? কিছু জিনিস হচ্ছে না? তা কি আমরা ভেবেছি কখনো?
কখন কোনো জিনিস ভাইরাল হয়?
কেন কোনোকিছু ভাইরাল হয়, তা নিয়ে তেমন একটা গবেষণা পারতপক্ষে হয়নি। কারণ ইন্টারনেট ব্যাপারটা দ্রুত ছড়িয়ে গেলেও, মানবসভ্যতার ইতিহাসের তুলনায় ইন্টারনেট কিন্তু বেশ নতুন। তাই এখনো ইন্টারনেটের প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে এর ভেতরের যুক্তি বা দর্শন নিয়ে কাজ করবার ঝোঁক মানুষের মাঝে পুরোপুরি আসেনি। তবে ইন্টারনেটের মাঝে কিছু শেয়ার করা অনেকটা সামাজিকভাবে তথ্য ছড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটার মতোই। সভ্যতার শুরু থেকেই গুজব আর শ্রুতিকথাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো। এই তথ্য ভাগ করে নেওয়াই এখন রূপ নিয়েছে ইন্টারনেটের শেয়ারে। এ ধরনের তথ্য ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল মানুষের আবেগ। এই আবেগ কিন্তু ইন্টারনেটেও আমরা কম দেখি না।
এই ভাবনাটি থেকেই ২০০৮ সালে একটি গবেষক দল নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রায় ৭০০০ প্রবন্ধ নিয়ে গবেষণা করে তিন মাস ধরে। প্রবন্ধের কোন বৈশিষ্ট্য সেই প্রবন্ধটিকে সর্বোচ্চ শেয়ারের দিকে নিয়ে যায়, তা দেখাই ছিল এই দলটির লক্ষ্য। তারা নিজেরাও ব্যাপারটার সুরাহা করার চেষ্টা করলেন, আবার একটি শব্দভাণ্ডার ভিত্তিক কম্পিউটার অ্যালগরিদম বানিয়েও দেখার চেষ্টা করলেন ফলাফল। দু’ক্ষেত্রেই দেখলেন, আবেগই উত্তর।
হ্যাঁ, ইন্টারনেটকে নেতিবাচকতার আড্ডাখানা মনে হতে পারে বটে, কিন্তু গবেষকরা দেখলেন, ইতিবাচক আবেগ উৎসারিত করা লেখা নেতিবাচকগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শেয়ার হয়। তবে একটি প্রবন্ধ যদি বেশ নেতিবাচক হয়, আর আরেকটি যদি হয় কিছুটা ইতিবাচক, তবে সেই দৌড়ে নেতিবাচকটাই এগিয়ে থাকবে।
তাই বোঝা গেল, শুধু ইতিবাচক বা নেতিবাচক আবেগই এখানে কারণ নয়, সেই আবেগের প্রকটতাও ব্যাপার এখানে। সেই আবেগটা আপনাকে কতটুকু উত্তেজিত করবে, সেটাও দেখার বিষয়। আপনার ফুসফুস যত পাম্প করবে, হৃদস্পন্দন যত দ্রুত হবে, ততই সম্ভাবনা বাড়বে আপনার সেই প্রবন্ধটি শেয়ার করার। এটা বোঝার পর শুধুমাত্র উত্তেজনার উপরই গবেষকরা আরেকটি বিষয়ে অধ্যয়ন করলেন।
৯৩ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে তারা তাদের কিছু ভিডিও দেখালেন। ভিডিওগুলোর চার ধরনের আবেগ উৎসারিত করে- সন্তুষ্টি, আনন্দ, বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ। আনন্দ আর উদ্বেগকে ধরা হয় বেশি উত্তেজনাকর আবেগ, আর সন্তুষ্টি, বিষণ্ণতা এগুলো কম উত্তেজনার। সেখানে দেখা গেল, উঁচু উত্তেজনার একটি ভিডিও দেখার পর পরবর্তী কোনো সাধারণ প্রবন্ধ বা ভিডিও শেয়ার করার প্রবণতাও একজনের মাঝে বেড়ে যায়।
আরেকটি পরীক্ষায় ৪০ জন মানুষকে তারা শুধু দৌড়াতে বললেন, কারণ দৌড়ালে উত্তেজনা তৈরি হয় শরীরে। এরপর দেখা গেল এক অবাক করা বিষয়, শুধুমাত্র দৌড়ানোর কারণেই মানুষজন আর্টিকেল বা ভিডিও বেশি শেয়ার দিচ্ছে!
এ কারণেই হয়তো উত্তেজনাকর শিরোনামওয়ালা ক্লিকবেইট লেখাগুলো এত ভালো ব্যবসা করে। আর্টিকেলে যা-ই থাকুক, শিরোনাম পড়েই আমরা উত্তেজিত হয়ে যাই, আর আমাদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে যায় তখন এই লেখাগুলো। তবে কোনোকিছু বেশি শেয়ার হবার পেছনে অন্যান্য কারণকেও দেখেছেন এই গবেষকরাই। যেমন লেখার বিষয়বস্তু কতটুকু প্রয়োজনীয়, এটাও দেখার বিষয়।
এভাবে আমরা দেখলাম কোন কোন ব্যাপার থাকলে আমাদের কিছু শেয়ার করার প্রবণতা বাড়ে।
কিন্তু আমরা যখন কিছু শেয়ার দিই, আমাদের মনে তখন প্রেরণা হিসেবে কী থাকে? এই শেয়ার দেয়ার মাধ্যমে আমরা আসলে কী অর্জন করার চেষ্টা করি?
আমরা কেন কোনো কিছু ‘শেয়ার’ দিই?
এই বিস্তৃত গবেষণাটি থেকে বিজ্ঞানীরা শেষপর্যন্ত পাঁচটি নির্দিষ্ট প্রেরণা বের করেছেন। আমরা কোনোকিছু শেয়ার করি-
১. বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ এবং বিনোদনকারী ব্যাপারগুলোকে আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর জীবনের অংশ বানানোর জন্য
২. নিজেদেরকে অন্যদের সামনে সংজ্ঞায়িত করার জন্য
৩. আমাদের জীবনে থাকা সম্পর্কগুলোকে শক্ত এবং বিকশিত করার জন্য
৪. আত্মতৃপ্তি লাভের জন্য
৫. আমাদের বিশ্বাসকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্য
এই ব্যাপারগুলোই আমাদের বিভিন্ন লেখা বা ছবি বা ভিডিও শেয়ার করবার জন্য প্রণোদনা দেয়
ব্যাপারটা আমাদের জন্য উপকারী না অপকারী?
হাস্যকর শিরোনামের সাথে একটি কার্টুন চরিত্রের ছবি আরেকজনের সাথে শেয়ার করার ব্যাপারটি বাইরের থেকে হাস্যকর মনে হতে পারে, সত্য। কিন্তু এটা করার মাধ্যমে আমরা আসলে নিজেদেরকে প্রকাশ করছি, আর যাদেরকে দেখাচ্ছি, তাদেরকে নিয়ে একটি সামাজিক অভিজ্ঞতার অংশ হচ্ছি। তাই শুধু একটু হাসার জন্যই কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ায় বসে মিম দেখা কার্যকর নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো কিন্তু আপনাকে সমাজের সদস্য হিসেবে দক্ষ বানাতে পারে!
সাম্প্রতিক একটি মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোতে সময় কাটানো এবং চ্যাটিং বা ম্যাসেজিংয়ে অংশগ্রহণ করা আপনার সহমর্মিতা বৃদ্ধি করতে পারে, মানুষকে আরো ভালোমতো বোঝার ক্ষমতা তৈরি করতে পারে!
আর এভাবে স্ক্রিন আর নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে সহমর্মিতা ছড়ানোর দক্ষতা কিন্তু প্রত্যক্ষ জীবনেও আপনাকে একজন সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারে।
এছাড়াও আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া আর ভাইরাল কন্টেন্টের প্রতি এই আচ্ছন্নতার ফায়দা নিয়ে আরো গবেষণা হয়েছে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের সাইটগুলোতে পোস্ট করার মাধ্যমে আমাদের একাকিত্বের অনুভূতিও কমতে পারে।
এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের অজান্তেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্টিং বাড়াতে প্রভাবিত করা হয়েছিল। দেখা গেল, যখন তারা তাদের স্ট্যাটাস আপডেট সক্রিয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের একাকিত্বও কমে যাচ্ছে। এই একাকিত্ব কমার কারণ ছিল তাদের বন্ধু এবং পরিচিতিদের সাথে নিয়মিত সম্পৃক্ততার অনুভূতি। আপনি যখন আপনার বিভ্রান্তি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেন, আপনার বন্ধুরা, কিংবা ইন্টারনেটের অনেক র্যান্ডম মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, তার অনুভূতিটি তার একার নয়। তারা আর একা অনুভব করে না, এভাবে ভার্চুয়াল জগতেই তৈরি হয় এক বিস্তৃত সংযোগ।
অবশ্য অনেক অধ্যয়নে অনেক গবেষক নেতিবাচক সিদ্ধান্তেও পৌঁছেছেন। তারা বলছেন সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটালে বিপরীত প্রভাবও পড়তে পারে, প্রত্যক্ষ জগত থেকে সংযুক্তিও হারিয়ে ফেলতে পারে মানুষ। কারণ প্রযুক্তির জগত থেকে যে সম্পৃক্ততার অনুভূতি, সহমর্মিতার শিক্ষা আমরা নিব, সামনাসামনি যদি তা ব্যবহার না করি, তবে তা ভার্চুয়ালই থেকে যাবে, বাস্তব আর হবে না। একসময় দেখা যাবে, সামাজিক মাধ্যমে হাজার হাজার যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবিক অর্থে যে সেই মানুষটি একা, সেই অনুভূতি তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
সবমিলিয়ে বলতে গেলে, এই ভাইরাল কন্টেন্টের সংস্কৃতি আসলে সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিরই অংশ। এর ইতিবাচক নেতিবাচক সবদিকই আছে। ইতিবাচককে গ্রহণ করে নেতিবাচককে আমরা ত্যাগ করতে পারবো, এই সংস্কৃতিতে নিয়ন্ত্রিতভাবে অংশগ্রহণ করবার মাধ্যমে।
ফিচার ইমেজ: anthillonline.com