“মেইড ইন চায়না” কথাটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। বিশ্বের প্রায় সব দেশের বাজারের সাথেই চীনের বাজার জড়িত। চীনের লোকেরা বানাতে পারে না এমন কিছু নেই, একথা আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি। একটি আসল পণ্য বাজারে আসার প্রায় সাথে সাথেই “মেইড ইন চায়না” ট্যাগ লাগিয়ে এর নকল পণ্য বাজারে ছড়িয়ে যায়। শুধু কি পণ্য নকল করাতেই চীন এগিয়ে? যদি বলি একটি গোটা শহর কিংবা একটি গোটা মহাদেশ নকল করে ফেলতেও সক্ষম তারা! না, ভুল পড়েননি। গোটা ইউরোপ মহাদেশটিকে নকল করে নিজ দেশে নিয়ে আসা যেন এক ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের কাছে।
আইফেল টাওয়ার থেকে শুরু করে লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ, ল্যুভর জাদুঘরের পিরামিড, সিঙ্গাপুরের অপেরা হাউজ, এমনকি আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টিও বাদ যায়নি! খালে ভরা গোটা ভেনিস শহরটাকেই চীন নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিয়েছে। এমনকি নিজ দেশের মহাপ্রাচীরটির মতো করে ছোট একটি মহাপ্রাচীর বানিয়ে রেখেছে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য। তারা যে মোট কতটি শহরের নকল করেছে তার সঠিক কোনো হিসাব খুঁজে পাওয়া কঠিন। এর সবই করেছে তারা দর্শক ও পর্যটক আকর্ষণের জন্য। তবে এর মধ্যে এমন কিছু নকল রয়েছে যেগুলোর কথা আলাদা করে না বললেই নয়। এমনই কিছু নকল শহরের গল্প আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
চীনের ভালোবাসার শহর ঝেজিয়াং ওরফে প্যারিস
ভালোবাসার শহর প্যারিসের কথা শুনলেই সবার প্রথমে মাথায় আসে আইফেল টাওয়ারের কথা। ৩০০ মিটার উচ্চতার আসল আইফেল টাওয়ারকে ছোট করে চীন নিয়ে এসেছে মাত্র ১০৮ মিটারে! শুধু এই আইফেল টাওয়ারটিই নয়, প্যারিসে থিয়েটার ও ক্যাফের জন্য বিখ্যাত শাম্পস ইলসেস সড়কের অবিকল এক সড়ক তৈরি করে নাম দিয়েছে জিয়াংজে সড়ক। এই সবকিছুই আপনি পাবেন চীনের ঝেজিয়াং শহরে। শহরটাতে গেলে আপনার মনে হবে এ যেন ছোট এক প্যারিসে চলে এসেছেন। এই শহরটি মূলত চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ সালে শুরু করা এই প্যারিস প্রকল্পটি বর্তমানে দর্শকদের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। বিয়ে করার পর দম্পতিরা সোজা এই শহরে চলে আসেন ছবি তোলার জন্য। কে না চায় ভালোবাসার শহরে নিজেদের ভালোবাসার একটি স্মৃতি রেখে যেতে!
চার স্তম্ভওয়ালা লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ
লন্ডনের টেমস নদীর উপর ২১৩ ফুট উচ্চতার টাওয়ার ব্রিজের কথা তো আমরা সবাই জানি। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কেমন হবে যদি পাশাপাশি দুটি টাওয়ার ব্রিজ দাঁড় করানো যায়? অবিকল দুটি টাওয়ার ব্রিজ পাশাপাশি দেখে প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও নকলটি কিন্তু কাজের বেলায় মোটেও আসলটির ধারে কাছে নয়। চীনের সুঝোউ নদীর উপর ১৩১ ফুট উচ্চতার চারটি স্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চীনের এই টাওয়ার ব্রিজ। লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজের মতো জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলেও, ২০১৭ সালে উন্মুক্ত হওয়া এই ব্রিজটি এখন দর্শক আকর্ষণের এক কেন্দ্রবিন্দু।
ভেনিস এখন দালিয়ানে
১০০টিরও বেশি দ্বীপ দিয়ে তৈরি শহর ভেনিসে নৌকায় করে ভেসে বেড়াতে কার না ভালো লাগে! খালে ভরা গোটা এই শহরটাকেই চীন দালিয়ানে তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের মতো করে! শুধু একটি-দুটি পুরনো দালান নকল করেই এরা ক্ষান্ত দেয়নি। ৪ কিলোমিটার লম্বা খাল কেটে এর উপর তৈরি করেছে ২০০টি প্রাচীন ধরনার দালান, যার সবকটিই আপনি পাবেন আসল ভেনিসের আনাচে কানাচে। ২০১৬ সালে খুলে দেয়া এই নকল ভেনিসে আপনি পারবেন সত্যিকারের ভেনিসের মতোই নৌকায় করে শহর ভ্রমণের স্বাদ নিতে। পুরো দালিয়ানকে ভেনিসে পরিণত করতে চীনের খরচ পড়েছে প্রায় ৭৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যুদ্ধের কলোসিয়াম থেকে জুয়া খেলার কলোসিয়াম
রোমের কলোসিয়ামের ব্যাপারে জানেন না এমন লোক পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। ৮০ খ্রিস্টাব্দে উন্মুক্ত হওয়া এই ঐতিহাসিক জায়গাটি ব্যবহার হতো গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে যুদ্ধ প্রদর্শনী এবং অন্যান্য খেলাধুলার কাজে। বর্তমানে অবশ্য এটি কেবলই একটি দর্শনীয় স্থান। চীনের ম্যাকাওতে এমনি দেখতে একটি কলোসিয়াম আছে। সেটি অবশ্য খেলাধুলার কাজে ব্যবহার করা হয় না। এটির ভিতরে গেলে আপনি দেখতে পাবেন সারি সারি শপিং মল এবং ক্যাসিনো।
চীনের দ্বিতীয় মহাপ্রাচীর
শুধু বাহিরের দেশকে নকল করলে একটা কথা ছিলো। নিজের দেশের ঐতিহ্যকে নকল করে বসলে আর কী বলার থাকে! ২২০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২০৬ খ্রিস্টপূর্ব, এই সময়ের মধ্যে চীনের উত্তর দিকের বেশ কয়েকটি প্রদেশের পাহাড়ের উপর দিয়ে তৈরি করা মহাপ্রাচীরের কথা তো আমরা সবাই জানি। এই মহাপ্রাচীরের প্রকৃত দৈর্ঘ্য ৯০০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। মধ্যচীনের নানচাং শহর এই ৯০০০ কিলোমিটারকে সংক্ষিপ্ত করে দর্শকদের জন্য নিয়ে এসেছে মাত্র ৪ কিলোমিটারে! প্রকৃত মহাপ্রাচীর যেখানে তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পাথর দিয়ে, সেখানে নানচাং শহরের নকল এই প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে মানুষের তৈরি পাথর দিয়ে। কিন্তু তবুও এই নকল প্রাচীরের প্রতি দর্শনার্থীদের আকর্ষণ কমেনি। বরং যারাই এখানে ঘুরতে এসেছেন, তারা প্রায় সবাই এটিকে আসল মহাপ্রাচীর মনে করে বসেছিলেন!
গিজার বিখ্যাত কোষাগার রক্ষী
মিসরের নীল নদের তীরে বিখ্যাত কোষাগারের মূর্তিটির কথা শুনেছেন নিশ্চই। একে নকল করে চীনের সিজিয়াঝং এর একটি পার্কে স্থাপন করা হয়েছিলো ২০১৪ সালে। তখন এই মূর্তির খবরটি কায়রোতে গিয়ে পৌঁছলে তারা সাথে সাথে ইউনেস্কোকে এই ব্যাপারে অবহিত করে। এই নকল মূর্তিটি গিজার ৪০০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক মূর্তিটির জন্য ছিলো এক অপমান। কায়রো সেটিকে নামিয়ে নিতে চীনের কাছে অনুরোধ করলে চীন থেকে বলা হয়, এটি একটি শুটিংয়ের কাজে তৈরি করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পার্কের কর্তৃপক্ষ নকল মূর্তিটির কেবল মাথাটি অপসারণ করেন। মূর্তির বাকি অংশে কোনো প্রকার হাত দেয়া হয়নি। সম্প্রতি পার্কের দর্শনার্থীরা লক্ষ্য করেন, নকল মূর্তিটির মাথা আবার জোড়া দেয়া হচ্ছে। এই খবর কায়রো কর্তৃপক্ষের কানে গেলে তারা চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে।
শেপিং পার্ক, চংকিং
আমেরিকার ৪ মহান নেতার স্মরণে তৈরি মাউন্ট রাশমোর কখনো দক্ষিণ ডাকোটার বাহিরে দেখতে পাওয়া যাবে তা ভেবেছিলেন? শুধু মাউন্ট রাশমোরই না। আপনি চাইলে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে আমেরিকাকে উপহার দেয়া স্ট্যাচু অব লিবার্টিও দেখতে পাবেন! এগুলো আপনি পাবেন চংকিং শহরের শেপিং পার্কে। দর্শনার্থী টানার উদ্দেশ্যে এগুলো ছোট আকারে নকল করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো আমেরিকাকে উৎসর্গ করে বানানো হয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধে চীনকে সমর্থন দেয়ার জন্য আমেরিকাকে এগুলো উৎসর্গ করা হয়।
এই শেপিং পার্কে যে আপনি কেবল স্ট্যাচু অব লিবার্টি আর মাউন্ট রাশমোর দেখবেন তা কিন্তু না। আপনি এখানে পিসার হেলানো মন্দির, সিঙ্গাপুরের অপেরা হাউজ এবং অন্যান্য বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানের দেখা পেয়ে যাবেন।
এগুলোর সবকটিই চীনের দর্শনার্থী আকর্ষণের জন্য তৈরি করা। বিষয়টা অনেকটা চুরি করা মনে হলেও, চীন যে চাইলে পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো সভ্যতাকে পুনরায় তৈরি করে দেখানোর ক্ষমতা রাখে তা এখান থেকেই বোঝা যায়। কাজটিকে চুরি হিসেবে না দেখে যদি আমরা এটিকে একটি শিল্প হিসেবে মূল্যায়ন করি, তাহলে এই ধরনের কাজের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এই লেখায় অল্প কয়েকটি জায়গার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ঘেটে দেখলে আপনি যে আরও কত জায়গার সন্ধান পাবেন, তার কোনো ইয়ত্তাই নেই!
ফিচার ইমেজ: youtube