চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নে টিকোইল গ্রাম। কাগুজে বা দাপ্তরিক নাম টিকোইল হলেও ‘আলপনা গ্রাম’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। আলপনা নাম থেকেই অনেকটা ধারণা চলে আসে, কেমন হতে পারে সেই গ্রামের চিত্র। গ্রামটির প্রত্যেকটি বাড়ি আলপনা দিয়ে সাজানো। গ্রামের সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে যাবে।
রঙ, চিত্র, প্রকৃতি, রূপবৈচিত্র্য- সবকিছুর সংমিশ্রণে একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাধারণত কাঁচা বাড়িতে উঠোন-ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা হয়। এঁটেল মাটি ও পানির সংমিশ্রণ দিয়ে উঠোন, বারান্দা এবং ঘরের চারপাশে লেপে দেয়া হয়। এতে ঘরবাড়ি সুন্দর দেখা যায়। সামনে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান থাকলে এসব কাজ করা হয়।
কিন্তু ব্যতিক্রম হলো আলপনা গ্রাম। এই গ্রামের মানুষেরা ঘরবাড়ি সুন্দর রাখার জন্য অন্য উপায় বেছে নিয়েছেন। বাড়ির উঠোন, ঘরের চারপাশ, বারান্দায় আলপনা আঁকা হয়। বিভিন্ন ধরনের আলপনা আঁকা হয় এই গ্রামে। রঙ-তুলির স্পর্শে যত ধরনের প্রাকৃতিক চিত্র আঁকা যায়, তার সবই প্রতিটি বাড়িতে শোভা পায়। ছোট বাচ্চারাও খেলার ছলে অনেক কিছু আঁকাআঁকিতে নেমে পড়ে। কল্পনার রঙে পুরো গ্রাম রাঙিয়ে তুলেছেন সেই গ্রামের মানুষেরাই। মাটির ঘরের দেয়ালে অজস্র রঙের ছটায় রঙিন হয়ে উঠেছে চারপাশ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গ্রামের বধূ ও মেয়েরা ঘরের চারপাশে এঁকে থাকেন এসব। গ্রামীণ জনপদটির শৈল্পিক রুচি ও মননশীলতার পরিচয় মেলে এই আলপনা চর্চায়।
আলপনা চর্চার শুরু
স্থানীয়দের মতে, সুদূর অতীত থেকেই এই গ্রামে আলপনা আঁকার রীতি চলে আসছে। অনেক আগে, বিভিন্ন পূজা-পার্বণে এখানকার হিন্দু পরিবারের বধূরা বাড়ির দেয়ালে সাদা রঙের তিনটি ফোঁটা এঁকে তার নিচ দিয়ে দাগ দিয়ে খুব সুন্দর আলপনা আঁকতেন। এছাড়াও আগের দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখার সময় পাত্রীর বাড়িতে আলপনার সৌন্দর্যও দেখতেন মুরুব্বিরা। তারপর থেকেই ঘরের দেয়ালে আলপনা অঙ্কনের প্রচলন শুরু হলো।
তবে এখন আর তিন ফোঁটার সাদা আলপনা নয়, কল্পনার সব রংই এখন ব্যবহার করা হয়। কল্পনার নানান চিত্র ও ছবি উঠে আসে আলপনায় রঙের ছটায়। দেখতে যেন পরীর দেশের মতো। এখনে রঙ-তুলিতে আঁকা হয় নানান রকমের চিত্র। লাল, নীল, সাদাসহ হরেক রকমের সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়।
এই গ্রামের মেয়ে ও বধূরা আলপনায় প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেন। স্বয়ং প্রকৃতি যেন নিজস্ব রঙের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন তাদের জন্য। প্রায় সব ধরনের রঙ-ই প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করা যায়। রাসায়নিক রঙের জয়জয়কার, কিন্তু এখনো তারা এই প্রাকৃতিক রঙের উপরই ভরসা করেন। প্রকৃতি থেকে রঙ-রূপ-রস সবই নিংড়ে বের করে আনেন আলপনার গ্রামের মানুষেরা। একেক রঙ একেক পদ্ধতিতে তৈরি করতে হয়। রঙ তৈরি করার কাজটি খুবই কঠিন। তবুও রঙ তৈরি করার ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন আলপনা গ্রামের মানুষেরা।
রঙ তৈরির কৌশল
খড়িমাটি বা লাল মাটি ভিজিয়ে ‘আখির’ বের করে তা থেকে লাল রং তৈরি করা হয়। এছাড়াও আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় সাদা রং। এছাড়া এ অঞ্চলের মাটি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পানির উপরে সাদা স্তর পড়ে। এই সাদা স্তর দিয়েও সাদা রং তৈরি করা হয়। রঙের সাথে গিরিমাটি, চক, তারপিন তেল মিশিয়ে ব্যবহার করা হত, যা বেশিদিন স্থায়ী হতো না। সেজন্য বর্তমানে শুকনো বরই, চূর্ণের আঠা, আমের আঁটির শাঁসচূর্ণ, গিরিমাটি, মানকচু এবং কলাগাছের আঠার সঙ্গে রঙের মিশ্রণ কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে আলপনা আঁকার রং প্রস্তুত করা হয়।
কী ধরনের চিত্র আঁকা হয় আলপনার ক্যানভাসে?
গাছ, লতা-পাতা, ফুল, ফল, পশু, পাখি, নদ-নদীসহ গ্রামবাংলার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তুলির প্রতিটি আঁচড়ে। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ সব মৌসুমেই গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে ফুটে থাকে আলপনা। বাড়ির দেয়ালে আঁকা আলপনা যেন বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে না যায়, তাই ঘরের চাল থেকে পলিথিন বেঁধে রাখেন অনেকেই। বৃষ্টি এলেই খুলে দেন, আবার বৃষ্টি চলে গেলে পলিথিন গুটিয়ে রাখেন।
গ্রামের সবাই আলপনার কারিগর। বংশপরম্পরায় তারা আলপনার ঐতিহ্যকে এতদূর নিয়ে এসেছেন, টিকিয়ে রেখেছেন। বধূরা, জননীরা তাদের হাতের মমতাময় ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্যকে চলমান রেখেছেন যুগের পর যুগ। বিশেষ করে গ্রামটির ঘরে ঘরে যেন নারীরা হয়ে উঠেছেন একেকজন দক্ষ চিত্রশিল্পী। গ্রামের শিশুরাও খেলাচ্ছলে রং নিয়ে মেতে ওঠে আলপনা আঁকায়। আলপনা আঁকতে যেন এই গ্রামের মানুষের কোনো ক্লান্তি নেই। শরীরে বয়সের ভার, কিন্তু মন যেন সেই শৈশবের মতোই রঙিন।
কেন আঁকা হয় আলপনা?
বাড়ি ঘর সুন্দর ঝকঝকে চকচকে দেখতে কে না ভালোবাসে! বাড়ি সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে সমস্ত দেয়ালজুড়ে আলপনায় কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়। পূজায় ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেবতার সুদৃষ্টি আর আশীর্বাদ কামনা করে আলপনা আঁকা হয়। বাড়ির সৌন্দর্যের বৃদ্ধির জন্যেও আলপনা আঁকা হয়। এছাড়াও ছেলেমেয়েরাও প্রতিযোগিতা করে নানা ধরনের আলপনা এঁকে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে পরিচিতি
‘আলপনা গ্রাম’ মিডিয়া ও ইন্টারনেটের সুবাদে দেশ-বিদেশে এর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বিদেশ থেকে অনেক দর্শনার্থী এই গ্রাম দেখতে আসছেন। এই গ্রামেরই বাসিন্দা দাসু বর্মণের বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য একটি পরিদর্শন খাতা রাখা আছে। আলপনা গ্রামের সৌন্দর্য দেখে দর্শনার্থীরা পরিদর্শন খাতায় তাদের মন্তব্য লিখে রেখে যান। গ্রামটি মানুষের বসবাসের স্থান, দর্শনীয় স্থান না হলেও বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখতে আসেন এই সুন্দর সাজানো গোছানো আলপনায় আঁকা গ্রামটি।
যেভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তেই থাকুন না কেন, আপনাকে প্রথমে বাস বা রেলযোগে আসতে হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বাস না পেলে রাজশাহী বাসস্টেশনে এসে নামবেন। আর ট্রেনে আসলে রাজশাহী রেলওয়ে টার্মিনালে নামবেন। দুটো জায়গাই পাশাপাশি অবস্থিত।
রাজশাহী রেল বা বাস স্টেশন থেকে হাঁটলে দু’ মিনিট লাগবে রেলগেটে যেতে। পাঁচ টাকা ভাড়ায় আপনি অটোতে করেও যেতে পারেন। এরপর রেলগেটে যে গোলচত্বরটি আছে, তার পশ্চিম পাশে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী বাস দাড়ানো দেখতে পারবেন। বাসে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডাইংপাড়া নেমে পড়বেন। ডাইংপাড়া থেকে আমনুরার উদ্দেশে রওনা দেবেন। এরপর সেখান থেকে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থল টিকোইলে যেতে পারবেন।
মাটির ঘরের সুবিধা
মাটির ঘরে শীতকালে গরম এবং গ্রীষ্ম মৌসুমে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। মাটির ঘর সহজে ভেঙে যায় না। মাটির ঘরে সবসময় একটা পরিমিত তাপমাত্রা বজায় থাকে। এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এসব ঘর যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে। ঘরগুলো অনেক টেকসই, মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে মাটির ঘর। নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায় এই ঘরগুলোতে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আলপনা আঁকার রীতি এখনো প্রচলিত আছে। গৃহবধূর রংতুলির আঁচড়ে এখন রঙিন জনপদ টিকোইল। আলপনা আঁকা নিত্যনৈমিত্তক কাজের অংশ হিসেবেই তারা এই কাজ করে থাকেন। ঠিক কোন সময় থেকে আলপনা আঁকা শুরু হয়েছে, তা কারোরই স্পষ্ট করে জানা নেই। তারা প্রাকৃতিক রং ব্যবহারের রীতি এখনো বজায় রেখেছেন। বাংলাদেশের মাঝে টিকোইল গ্রামটি রং তুলির আঁচড়ে গড়ে তোলা একটি রঙিন আলপনার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ভ্রমণ সংক্রান্ত চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/