থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ফুকেট। নীলাভ আন্দামান সাগরের পাশে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো এই দ্বীপটি। সমুদ্রসৈকত আর বিলাসবহুল রিসোর্টের কারণে এই দ্বীপটি পর্যটন এলাকা হিসেবে খুব জনপ্রিয়। এর একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট ট্রিসেরা। এই ট্রিসেরার মধ্যেই একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ ‘প্রু’। সম্প্রতি এই রেস্তোরাঁটি পেয়েছে মিশেলিন তারকার মর্যাদা। এটি ফুকেটের প্রথম এবং একমাত্র মিশেলিন তারকা পাওয়া রেস্তোরাঁ।
ভ্রমণের জন্য দর্শনীয় স্থানগুলোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী রেস্তোরাঁর চাহিদাও কম নয়। বিশ্বজুড়ে রয়েছে অনেক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁর মান নির্ণয়ের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রেটিং ব্যবস্থা। এমনই একটি হচ্ছে মিশেলিন স্টার বা মিশেলিন তারকা। ফ্রান্সভিত্তিক মিশেলিন গাইড বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানের রেস্তোরাঁর রেটিং দিয়ে থাকে। এরা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ক্রেতার ছদ্মবেশে তাদের পরিদর্শকদের পাঠায়। তারা খাবারের মান যাচাই করে এসে এটি নিয়ে পর্যালোচনা করে। একটি রেস্তোরাঁয় ছয় থেকে আটবার পর্যন্ত বিভিন্ন পরিদর্শককে পাঠানো হয়। তারপর তাদের মতামত অনুযায়ী রেটিং বা তারকা চিহ্ন দেয়া হয়। মিশেলিন গাইড থেকে রেস্তোরাঁর মান অনুযায়ী শূন্য, এক, দুই এবং তিন তারকা দেয়া হয়। ক্রেতার বেশে যাওয়া পরিদর্শকদের পরিচয় গোপন রাখা হয়।
মিশেলিন গাইডের এই রেটিং দেয়ার বিষয়টি নতুন নয়। বরং এটি প্রায় একশ বছর পুরনো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিশেলিন ছিল একটি চাকা কোম্পানি। ১৮৮৯ সালে দুই ভাই আন্দ্রে মিশেলিন এবং এডওয়ার্ড মিশেলিন এই চাকা কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন। মোটরযাত্রীদের সুবিধার জন্য তারা বিনামূল্যে একটি ভ্রমণ গাইডের ব্যবস্থা করেন। এতে যাত্রা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া থাকতো। এগুলোর মধ্যে থাকতো মানচিত্র, চাকা পাল্টানোর জায়গার নাম, পেট্রোল নেয়ার জায়গার নাম, পথের মধ্যে থাকা-খাওয়ার হোটেলের ঠিকানা ইত্যাদি।
১৯২০ সালের পর থেকে তারা রেস্তোরাঁর তালিকা দেয়া শুরু করেন। ১৯২৬ সাল থেকে তারা রেস্তোরাঁগুলোর মান অনুযায়ী তারকা পুরষ্কার দেয়া শুরু করে। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকা আর এশিয়ার কিছু দেশের রেস্তোরাঁর তালিকা মিশেলিন গাইডে দেয়া হয়। রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা তুমুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন এই তালিকায় তাদের রেস্তোরাঁর নাম দেখার আশায়।
গত নভেম্বরে মিশেলিন ২০১৯ সালের থাইল্যান্ড গাইড প্রকাশ করেছে। এতে প্রু রেস্তোরাঁ পেয়েছে তারকা চিহ্নের পুরষ্কার। ব্যাংককের বাইরে এই প্রথম থাইল্যান্ডের কোনো রেস্তোরাঁ মিশেলিন পুরষ্কার পেল। প্রু একটি থাই ভাষার শব্দ। এর মানে হচ্ছে এটি এমন এক জায়গা, যেখানে বন-জঙ্গল এসে সাগরের সাথে মিশেছে। মূলত এটি উর্বর মাটিকে নির্দেশ করে। তবে এই রেস্তোরাঁর প্রধান শেফ জিমি ওফ্রোস্টের ভাষ্য অনুযায়ী– PRU শব্দটি দিয়ে ইংরেজি Plant Raise Understand নির্দেশ করে। রেস্তরাঁর দর্শনও নাকি এই শব্দগুলোই।
ট্রিসেরা রিসোর্টের ভেতরে এই রেস্তোরাঁর যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর পরিবেশ মুগ্ধ করে দেয়ার মতো সুন্দর। মূল দরজার সামনে মিশেলিন তারকা দেয়া লাল কার্ড ঝোলানো। ভেতরের জায়গা ছোট হলেও খুব গোছানো। সাধারণত দুই সপ্তাহ আগে থেকেই এখানে জায়গা সংরক্ষণ করে রাখতে হয়, নাহলে খালি পাওয়া যায় না। বাইরেও বসার সুন্দর জায়গা রয়েছে।
প্রুর বিশেষত্ব হচ্ছে এর নিজস্বতা। এখানের খাবারগুলো সব থাইল্যান্ডের। তার মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই ফুকেটের। যদিও শুরুতে তারা ৮০/২০ নীতিতে চলতো। অর্থাৎ, খাবারের ৮০ ভাগ থাকতো থাইল্যান্ডের আর ২০ ভাগ থাকতো বাইরের দেশগুলোর। পরে বাইরে থেকে আনা খাবারগুলো তারা ট্রিসেরার নিজস্ব খামারে ফলানো শুরু করে। ট্রিসেরা থেকে গাড়িপথে এটি ২০ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত। প্রু জাম্পা নামের এই খামারটি প্রায় ৯৬ হেক্টর জায়গা জুড়ে ছড়ানো। এর ৬.৫ হেক্টর এলাকায় বিভিন্ন ফল, সবজি আর মসলার চাষ হয়, বাকি অংশ ঘন সবুজ বন।
খামারটি দেখতে অনেকটা নার্সারির মতো, যার চারপাশ বন দিয়ে ঘেরা। এখানে ফলানো সবজির মধ্যে আছে টমেটো, গাজর, লেটুস ও পেঁয়াজ। ফলের মধ্যে আছে কমলা ও লেবু। এছাড়া এই খামারে মুরগি আর হাঁসও পালন করা হয়। একটি প্রাকৃতিক হ্রদও রয়েছে এখানে। এতে বিভিন্ন মাছের চাষ হয়। প্রুর বর্জ্য পদার্থগুলো এখানের সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বন থেকে বিভিন্ন ধরনের ফুল আর বাঁশ নিয়ে আসা হয়। এগুলো রেস্তোরাঁর খাবারে শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খামারের খাবার ছাড়াও বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার থাকে প্রুর মেনুতে।
এখানের খাবারের মেনু বিভিন্ন ধরনের। তেমনই দুটি হচ্ছে ছয় কোর্স আর আট কোর্স। কয়েক মাস পর পরই মেনু বদলানো হয়। নিত্যনতুন উদ্ভাবনী খাবারের ব্যবস্থা থাকে নিয়মিত। এখানে খেতে হলে স্বাভাবিকভাবেই খরচ করতে হবে মোটা অংকের অর্থ। খাবারের দামের পাশাপাশি সার্ভিস চার্জ আর ট্যাক্সও ক্রেতাকেই দিতে হয়। ছয় কোর্স খেতে গেলে খরচ পড়বে বাংলাদেশি টাকায় ১২,৩৩০ টাকা। অন্যদিকে আট কোর্সের দাম বাংলাদেশি টাকায় ১৫,৪১২ টাকা।
প্রু রেস্তোরাঁর সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এর প্রধান শেফ জিমি ওফ্রোস্টের। ২৯ বছর বয়সী এই শেফ নেদারল্যান্ডের নাগরিক। তিনি ট্রিসেরাতে আছেন ৬ বছর ধরে। এর আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রান্নাবান্না নিয়ে কাজ করে এসেছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা রেস্তোরাঁ গ্যাগানেও ছয় মাস কাজ করেছেন। তার কাজে খুশি হয়ে ট্রিসেরার পরিচালকরা তাকে নিজের রেস্তোরাঁ বানানোর জায়গা দেন। তখন থেকেই প্রুর যাত্রা।
নেদারল্যান্ডে তার বাড়ি ছিল সমুদ্র থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে। তাই ছোটবেলা থেকেই সমুদ্রের মাঝেই তার বসবাস। এখন থাকেন সমুদ্র তীরবর্তী ফুকেটে। সমুদ্রের তীরে কাজ করার অনুপ্রেরণা ছোটবেলা থেকেই পান জিমি ওফ্রোস্ট। আর সেই অনুপ্রেরণা থেকেই দুই বছরের মাথায় প্রুকে এনে দিলেন মিশেলিন তারকার মর্যাদা। তার মতে, এটা ফুকেটে আগত পর্যটকদের কাছে আরো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফুকেটও আরো বেশি আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠবে মনে করেন তিনি।
ওফ্রোস্টের মনে করে,ন তার মিশেলিন তারকা পাওয়া অন্যান্য শেফকেও অনুপ্রেরণা যোগাবে। কারণ ফুকেটের বেশিরভাগ শেফ একটু ভয়ে থাকেন পর্যটকদের নিয়ে। পর্যটকরা বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন। তাদের জন্য থাই খাবার রান্না করলে রেস্তোরাঁ চলবে কি না সেটা নিয়ে অনেকে থাকেন শঙ্কিত। প্রু তাদের এই ভয় দূর করবে বলেই বিশ্বাস ওফ্রোস্টের। কারণ, এখানের খাবার পুরোপুরিই থাইল্যান্ডের নিজস্ব।
জিমি ওফ্রোস্ট শুধু একজন শেফই নন, খাবারে নিত্যনতুন উদ্ভাবনও করে থাকেন অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি বলেন, “অতিথিরা এখানে প্রথম পা ফেলা থেকে শুরু করে এখান থেকে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমরা তাদেরকে একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা উপহার দেয়ার চেষ্টা করি।” তার কথার প্রমাণ ভালোভাবেই মেলে। মাত্র দু’বছরের মাথায় এটি পর্যটক ও মিডিয়ার কাছে আকর্ষণীয় একটি স্থান হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডের নতুন একটি দর্শনীয় স্থান এটি।
প্রুকে নিয়ে বলার পাশাপাশি ট্রিসেরাকে নিয়ে কিছু না বলাটা অন্যায় হবে। থাইল্যান্ডের সেরা সামুদ্রিক রিসোর্ট এটি। এর রয়েছে ৩৯টি ভিলা। প্রতিটির সাথে সংযুক্ত আছে একটি করে সুইমিং পুল। এছাড়া আছে আন্দামান সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করার ব্যবস্থা। বিলাসবহুল এই রিসোর্টে পর্যটকেরা এসে স্বপ্নের মতো সময় কাটিয়ে যান।
মিশেলিন তারকা পাওয়া যেকোনো রেস্তোরাঁর জন্য অবশ্যই একটি সম্মানের ব্যাপার। তবে এটিই শেষ নয়। মিশেলিন পাওয়া রেস্তোরাঁর কাছে ক্রেতাদের প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। মান ধরে রাখতে না পারলে তারকা কেড়ে নেয়াও হয়। এটা রেস্তোরাঁর জন্য যেমন লজ্জাজনক, একইসাথে এর ভবিষ্যতও তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে প্রু মিশেলিনের দুই তারকা আর তিন তারকার সম্মানও পাবে, এটিই প্রত্যাশা এর পরিচালকদের।