সেন্ট অগাস্টাইনের একটা উক্তি আছে, “পুরো পৃথিবী একটি বই, এবং যারা ভ্রমণ করে না তারা কেবল এর একটি পৃষ্ঠা পড়ে।” জানার ইচ্ছা আর নতুন অভিজ্ঞতার আগ্রহ এই দুইয়র সমন্বয় ঘটলে মানুষ বেরিয়ে পড়ে নতুন কোথাও, নতুন কিছুর সন্ধানে। সে হোক কোনো ঐতিহাসিক স্থান, পাহাড়, কিংবা সমুদ্র- পৃথিবীর আনাচেকানাচে থাকা এসব বৈচিত্র্য মুগ্ধতা ছড়াবেই। আজ শোনাব বাংলাদেশের এমন এক জায়গার গল্প, যেখানে এই পাহাড়ের বন্য প্রকৃতি আর সমুদ্রের অসীম মায়া সবটাই পাওয়া যায় খুব সহজেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি উপজেলা সীতাকুণ্ড। এই এলাকাতেই আছে সুন্দর কিছু পাহাড়ি ঝর্ণা এবং কাছেই রয়েছে সমুদ্র সৈকত।
ময়মনসিংহ শহর থেকে বিজয় এক্সপ্রেসে চেপে আমরা ক’জন রওনা দিয়েছিলাম পাহাড়-সমুদ্রের টানে। ঢাকা থেকে যাওয়ার ক্ষেত্রে মহানগর প্রভাতী, মহানগর এক্সপ্রেস, তূর্ণা এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ইত্যাদি ট্রেনের সময়সূচী জেনে চট্টগ্রামে যাওয়া যাবে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল মিরসরাই, যেখান থেকে বোয়ালিয়া ট্রেকিংয়ের কাছে হওয়ায় আমরা মিরসরাই বাজারে প্রথম গন্তব্য ঠিক করলাম। ফেনী শহর থেকে মিরসরাই কাছে হওয়ায় (৩৬ কি.মি.) আমরা ফেনি স্টেশনে নেমে যাই। ট্রেনে যাওয়ার সময় বন্ধুদের মাঝে আড্ডা আর লুডু খেলায় দ্রুতই রাত ফুরিয়ে যায়। বিজয় এক্সপ্রেস খুব ভোরে ফেনিতে পৌঁছে। একটু ভোরের আলো ফুটলে আমরা অটোতে রওনা দেই মহীপালের উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে চট্টগ্রামগামী লোকাল বাসে মিরসরাই পৌঁছান যায়। আমরা মহীপালে সকালের নাস্তা করে নেই, চাইলে মিরসরাইতেও ভাল নাস্তার ব্যবস্থা আছে।
আমাদের দুই দিনের ট্যুর প্লানের প্রথমদিন বোয়ালিয়া আর সোনাইছড়ি ট্রেকিংয়ের কথা ছিল। সোনাইছড়ি একটু বড় ঝর্না শুনে আমরা শুরুতে সেটাতেই যাওয়ার পরিকল্পনা করি। চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই পাহাড় রেঞ্জের হাদি ফকিরহাট বাজার এলাকায় সোনাইছড়ি ট্রেইল (Sonaichhari Trail) অবস্থিত। এবং এটি বারৈইয়াঢালা অভয়ারণ্যের আওতাভুক্ত একটি পাহাড়ি এলাকা। এই ট্রেইলের বাদুইজ্জাখুম বা বাঁদুরে কুম নামের সংকীর্ণ অথচ বিস্তৃত গভীর কুমের দু’পাশের পাথুরে দেয়াল খাড়া ১০০-১৫০ ফুট উচু! সিএনজি আমাদের রেললাইন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পরে আমরা একজন গাইড ঠিক করি। সীতাকুন্ডে বিভিন্ন স্পটে যাওয়ার ক্ষেত্রে রিজার্ভ গাড়ির তুলনায় লোকাল বাসে যাতায়াত সাশ্রয়ী। মহাসড়ক থেকে বিভিন্ন ট্রেকিংয়ের রাস্তা শুরু হওয়ায় সহজেই বিভিন্ন যায়গায় পৌঁছান যায়। সিএনজি কিংবা গাইড ঠিক করার সময় একটু দরদাম করার চেষ্টা করুন। এখানকার বিভিন্ন স্পটে গাইড ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যেই হয়ে থাকে। সোনাইছড়ি ট্রেকিং শুরু হয় গাইডের বাসায় আমাদের ব্যাগগুলো রাখার মাধ্যমে। ঝর্নার পানি না পান করাই ভাল, তাই সাথে খাবার পানি, স্যালাইন, ফার্স্ট এইড টুলস, শুকনো খাবার- এরকম খুব দরকারি জিনিস নেবেন, যেহেতু সাথে ব্যাগ থাকবে না। বর্ষাকালে পাহাড়ে ট্রেকিং করার সবচেয়ে বড় বিপদ জোকের আক্রমণ; এ বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। আমাদের ট্রেকিংয়ের সময়ও কয়েকজনকে জোক ধরেছিল। সোনাইছড়ি বাজার থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা এবং গাইডের সহায়তায় আমরা সে যাত্রায় রক্ষা পাই।
পাহাড়ি পথে আমাদের হাঁটা শুরু হলো ঝিরি পথ ধরে। ধীরে ধীরে ঠান্ডা জলের ধারা আমাদেরকে দিচ্ছিল অসাধারণ প্রশান্তি। ট্রেকিং করার জন্য আলাদা জুতা কেনা ভাল। নির্জন জংলি রাস্তায় গাইডের নির্দেশে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সোনাইছড়ি ঝর্না খুব বেশি পরিচিত না হওয়ায় মানুষের আনাগোনা এদিকে কম। এমনকি আমরাও পুরোপুরি জানতাম না কত সময় লাগতে পারে পুরো ট্রেক শেষ করতে। সীতাকুন্ডের ঝর্নাগুলোর অসাধারণ দিক হলো- ঝিরিপথে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতি মূহুর্তেই আপনার জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করবে। কিছু জায়গায় হয়তো সমতল পাথরের উপর দিয়ে খুব বেগে পানি চলে যাচ্ছে। চুপ করে শুয়ে পড়ুন পাথরের উপর, তারপর সবুজের বুক চিরে আকাশের দিকে তাকান। ঠান্ডা জলের স্রোত আর মিষ্টি কুলুকুলু ধ্বনি আপনাকে আরো অনেকদিন হাসিমুখে বাঁচার শক্তি যোগাবে।
কিংবা হঠাৎ সামনে পড়বে দুই পাহাড়ের মাঝে তৈরি গুহা। গুহার মধ্যে দিয়ে ভীষণ স্রোতের ধারা অতিক্রম করার সেই মুহূর্তগুলো জমা করবে আপনার ঝুলিতে অজস্র গল্পের সমাহার। এজন্যেই হয়তো ইবনে বতুতা বলেছিলেন,
“Traveling—it leaves you speechless, then turns you into a storyteller.”
এভাবেই একের পর এক বিস্ময় দেখতে দেখতে প্রায় চার ঘন্টা ট্রেক করে আমরা সোনাইছড়ির শেষ ঝর্নায় এসে পৌঁছাই। ক্লান্ত দলের সবার মাঝেই তখন বিরাজ করছিল অসাধারণ এক প্রশান্তি।
সোনাইছড়িতে জোকের আক্রমণ এবং সারাদিনের ট্রেকিংয়ের পর বিকেল হয়ে যাওয়ায় মহাসড়কের কাছের এক দোকানে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ঐদিনের জন্য ট্রেকিং না করার সিদ্ধান্ত নেই। হঠাৎ পরিকল্পনা থেকে বোয়ালিয়া বাদ পড়ায় অনেকেই হতাশ হচ্ছিল। কিন্তু ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানুষের নিরাপত্তার কথাই বেশি মাথায় রাখা উচিত। রাতে থাকার জন্য আমরা সীতাকুণ্ড বাজারে চলে যাই। সেখানে বাজেটের মধ্যে ভাল হোটেল পাবেন। দুই রুম ১,৩০০-১,৫০০ এর মধ্যেই ঠিক করা যায়। আমরা সীতাকুণ্ড বাজারে রাতের খাবার খেয়ে ঐ রাতে হোটেলে ফিরে গেলাম। আমাদের হোটেলের ছাদ থেকে রাতে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ার আলো দেখা যাচ্ছিল।
শুরু হলো আমাদের দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ। এদিন আমরা শুধু কিছুটা আরামদায়কভাবেই ঘোরাঘুরির চিন্তা করলাম। সীতাকুণ্ড থেকে সিএনজিতে সকালে চলে গেলাম ইকো পার্কে। এখানে সুপ্তধারা আর সহস্রধারা ঝর্ণা দেখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। খুব সকাল সকাল যেতে পারলে মানুষ কম থাকে এবং প্রকৃতিকে গভীরভাবে উপভোগ করা যায়।
সহস্রধারাতে যাওয়ার পথে আমরা দেখছিলাম অনেক দূরে সমুদ্রের সীমানা। পাহাড়ের মাঝে সবুজের মাঝ থেকে দূরের সমুদ্র যেন আমাদের বার বার হাতছানি দিচ্ছিল। পাহাড়ি রাস্তায় সাইনবোর্ডে প্রকৃতি নিয়ে লিখা সুন্দর কথাগুলো কিংবা হঠাৎ পথের মাঝে খুঁজে পাওয়া শিউলি ফুল ইকো পার্কে খুব সতেজ করেছিল আমাদের সময়গুলো।
ইকোপার্কের সকালের পর বিকেল ছিল আমাদের শুধুই সমুদ্রের জন্য। কারণ, রাতেই আমাদের ছিল ময়মনসিংহের ফিরতি বাস। সীতাকুণ্ড থেকে ঢাকা আসতে চাইলে রাতের অনেক বাস থাকলেও ময়মনসিংহ আসার ক্ষেত্রে শুধু শামীম এন্টারপ্রাইজ রয়েছে, যাকে আমাদের আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়েছিল। এরপর প্রথমেই আমরা চলে যাই বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে। সারাদিন পাহাড় দেখার পর সমুদ্রের পানিতে যখন আপনি এসে দাঁড়াবেন, আপনাআপনিই আপনার চোখ বুজে যাবে; এ যেন এক অন্যরকম প্রশান্তি।
দিনশেষে আমাদের শেষ গন্তব্য গুলিয়াখালি সি বিচ। যদিও অনেক কাদা মাড়িয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়েছিল। কিন্তু গুলিয়াখালি আমাদের করেছিল শান্ত সমুদ্রের মতো স্থির, যেন বিকেলের ডুবন্ত সূর্য নিয়ে আকাশকে রঙিন করে চলেছে প্রতিনিয়তই। সম্পূর্ণ ট্যুরে আমরা স্থানীয় নিয়মকানুন ঠিকভাবে মেনে চলেছি, এবং পরিবেশের ক্ষতি করে এমন সব ধরনের কাজ থেকেই বিরত থেকেছি।