টানা দু’দিনের প্রোগ্রাম শেষ করে সিলেট সদর থেকে রওনা হলাম মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে। সকাল এগারোটায় কদমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সিটিং সার্ভিসের দুটো টিকেট কেটে রওনা দিলাম আমরা। সাথে আমার সফরসঙ্গী ছিলেন পর্বতারোহী/লেখক বন্ধু। শীতের সকালটা কুয়াশাচ্ছন্ন না হয়ে প্রখর রোদেলা হওয়াতে শরীরটা চিটচিট করছিল। বেলা সাড়ে এগারোটায় কদমতলী থেকে বাস ছেড়ে দিয়ে মৌলভীবাজারের দিকে ছুটতে লাগল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বাস যাত্রার সমাপ্তি ঘটলে আমরা মৌলভীবাজার পৌঁছে যাই। ততক্ষণে সূর্যটি মাথার উপরে টনটন করে ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। দুপুর বেলা খাবার সময় হয়ে এসেছে, তাই সিলেটের বিখ্যাত হোটেল পানসিতে গিয়ে খানাপিনা সেরে ফেললাম।
এবার পালা শমসের নগর রওনা দেবার। সিনএনজিতে জনপ্রতি ৫০ টাকা করে ভাড়া। প্রথমে একে অপরের দিকে তাকালাম, পরে আলোচনা করে একটি সিএনজিতে উঠে পড়লাম, যেন পরবর্তীতে বাকবিতণ্ডায় জড়াতে না হয়। ইঞ্জিনচালিত সিএনজি (!) চালু হলো এবং শমসের নগরের পথ ধরে সামনে এগোতে থাকল। পাকা রাস্তার যে বেহাল অবস্থা, তাতে করে মনে হচ্ছিল ২০ কি.মি. পথ যেন শেষ হবার নয়।
মাথার উপরের সূর্য খানিকটা বিশ্রাম নিতে গিয়েছে। এর মধ্যে আমরা সমশেরনগর রেলস্টেশনে এসে পৌঁছলাম। তারপর কিছুটা পথ এগিয়ে চার রাস্তার মোড়ে এসে চা বাগান দেখার জন্য একটা রিকশায় উঠে পড়লাম। লেক পাড়ে নাকি কোনো খাবারের দোকান নেই। তাই দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে নিলাম।
ব্যাটারিচালিত রিকশা যত এগোচ্ছে, কাছের পথটাও যেন ততই দূরে মনে হচ্ছে। ছোট ছোট টিলা কেটে চলাচলের জন্য পাকা সরু রাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডান কিংবা বাম যেদিকে তাকাই না কেন, শুধুই চা বাগান। দীর্ঘ পথের ব্যবধানে দু-একটা করে ঘর আর টং দোকান। আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে চারপাশের প্রকৃতি। চলে এলাম পঞ্চাশ শয্যাবিশিষ্ট ক্যামেলিয়া ডানকান হসপিটালের অভিমুখে, আর ঠিক এখান থেকেই শুরু চির সবুজের চোখ ধাঁধানো চা বাগানের একাংশ।
চোখ দুটো যত দূরই যাচ্ছে ততবারই যেন সীমানা খোঁজার চেষ্টা করছে। চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া কাঁচা সরু পথটা দিয়ে আমরা রিকশায় করে সামনের দিকে যেতে থাকি। বেশ দূরে গিয়ে নেমে গেলাম একটি ব্রিজের উপর। ছোট ব্রিজ অতিক্রম করে হালকা উঁচু টিলা আর এর মাঝখান দিয়ে সরু কাঁচা পথ। আমরা সেই পথ দিয়েই লেকের দিকে যেতে থাকি। চোখ গেল ক্ষেতের মাঠে, বক আর মহিষের বন্ধুত্বের খুনসুটির দিকে। মহিষ আপন মনে ঘাস চিবিয়ে যাচ্ছে, আর বক হালকা আঁচে রোদ পোহাচ্ছে।
ক্যামেলিয়া লেকে যাওয়ার সময় খুব বেশি একটা ছবি তুলিনি, কেননা নয়নাভিরাম এই দৃশ্য খালি চোখে না দেখে ক্যামেরাবন্দি করলে মানায় না। একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম ক্যামেলিয়া লেকের ধারে। কেউ এই লেকটিকে ক্যামেলিয়া লেক বলে চেনেন, আবার অনেকেই বিসলারবান নামেও চেনেন। নাম যেমনই হোক, এমন জায়গা দেশে খুঁজে পাওয়া বড্ড মুশকিল। প্রকৃতির এমন অচেনা শহরে ঘুরতে যাওয়াটা ছিল আমার জন্য যেমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, ঠিক ততটাই হৃদয়-জুড়ানো। লেকের ধারে এসে দেখতে থাকলাম চারপাশ, জনশূন্য এই জায়গায় কী এক অজানা রহস্য যেন লুকিয়ে আছে। চারপাশ মায়া আর অচেনা গন্ধে ঘিরে আছে চা বাগানটিকে।
কিছুক্ষণ পর পর চোখে পড়ছে দু-একজন চা বাগান শ্রমিকদের। আরো খানিকটা সময় পার হতেই কোথা থেকে যেন একঝাক দর্শনার্থী ভিড় জমালেন এবং তারা নিজেদের মতো করে আড্ডায় মেতে উঠলেন। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ঐ দূরের চা বাগানে, মাটির তলানি থেকে চারটি মাথা বের করে পানি ছিটিয়ে চায়ের পাতাগুলোকে সতেজ করে যাচ্ছে মেশিনটি। চায়ের গাছগুলো ২-২.৫ ফুটের মতো উঁচু, কিন্তু বয়স যে তার বেশ হয়েছে সেটা ডালপালা দেখলেই বোঝা যায়।
লেকের পাশে ছোট করে একটা ছাউনি আর একটা সিঁড়ি বানিয়ে রেখেছেন ক্যামেলিয়া ডানকান কর্তৃপক্ষ। যেকোনো দর্শনার্থী আসলে যেন সিঁড়ির ধারে বসে বা দাঁড়িয়ে এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। লেকের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যাচ্ছে উঁচু-নিচু টিলার মাঝে ছোট খুপরির টিনের চালের একটি করে ঘর। আবার বিজিবির বেঁধে দেওয়া সীমানা।
ঐদিকে আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসার সময় হয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় অতিথি পাখিগুলোর কলরব ও গুঞ্জনের শব্দ বাড়তে শুরু করছে, তাদের আবাসস্থল খুঁজে নিয়ে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাথে আবার ঝিঁঝিঁপোকাগুলো ডাকছে, মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম তাদের আমন্ত্রণের ভাষা।
আবারও সেই সরু পথ ধরে বের হয়ে যাচ্ছি। শেষ মুহূর্তে চোখে পড়ল তিনজন কাঠুরে মিলে লাকড়ি সংগ্রহ করছে। পশ্চিম আকাশের সূর্যটি লালচে আকার ধারণ করছে, পশমওয়ালা ভেড়াগুলো ঘরে ফেরার চেষ্টায় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর সামনের দিকে এগোচ্ছে।
বিসলারবান থেকে বেরিয়ে, প্রবেশ করলাম ডানকান হাসপাতালে। সেখানে প্রবেশপথেই চোখে পড়ল ছবি তোলা নিষেধ। এত গোছালো, সুন্দর কোলাহল মুক্ত পরিবেশে স্থান পেয়েছে বিদেশি সংস্থার এই বেসরকারি হাসপাতাল। হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর চায়ের দেশের সতেজ পাতায় চা চুমুক দিয়ে মন জুড়ালাম। চা শেষ করে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করেই তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম, এবং রিকশা ধরে সমশেরনগর বাসট্যান্ড এলাম। এরপরে সিএনজি করে নতুন গন্তব্য শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।
যেভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার জন্য যেকোনো একটি দূরপাল্লার কোচের টিকেট কেটে রওনা দিতে হবে। মৌলভীবাজার পৌঁছানোর পর বাসট্যান্ড থেকে রিক্সা কিংবা অটোরিকশায় ৩০ টাকা খরচ করে চৌমুহনা নামক স্থানে যেতে হবে। পরবর্তীতে চৌমুহনার চার রাস্তা থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়ায় সিনএনজি করে শমসের নগর। রিক্সা করে ৩০ টাকা ভাড়ায় শমসের নগর বাজার থেকে ক্যামেলিয়া লেক কিংবা বিসলারবান যেতে হবে।
আমাদের দেশেই আছে চোখজুড়ানো সব জায়গা। যেসব স্থানের পরিবেশ আমাদের অসতর্কতার কারণে নষ্ট হতে পারে। তাই ভ্রমণকালে প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কাজ করা আমাদের কর্তব্য। সকলের ভ্রমণ হোক আনন্দময়।