যদি কোনও তরুণী নিজের বাসস্থানে রোমাঞ্চ খুঁজে না পায়, তবে তাকে অবশ্যই দেশ-বিদেশে ঘুরতে যেতে হবে
— জেন অস্টেন
ইংরেজি সাহিত্যের এক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক জেন অস্টেন। তার সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস’ এর জন্য সাহিত্য পাঠকদের মাঝে তিনি আজো অমর হয়ে রয়েছেন। তার এই উপন্যাসটি প্রকাশের দুশো উনিশ বছর পূর্ণ হলো। এখনও উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় নিয়মিত অনূদিত হচ্ছে এবং তা সমানভাবে পাঠকপ্রিয়। জেন অস্টেনের শৈশব কেটেছে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের এক ছোট্ট গ্রাম স্টিভেন্টনে।
হ্যাম্পশায়ার কাউন্টিতে প্রবেশের মুখেই চোখে পড়বে একটি ফলক, যেখানে লেখা রয়েছে, ‘ওয়েলকাম টু জেন অস্টেন কাউন্টি’। সত্যিই এই কাউন্টির তিনিটি স্থান স্টিভেনটন, চওটন আর উইনচেস্টর- জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই খ্যাতিনামা লেখকের জীবনের বহু স্মৃতিচিহ্ন। এছাড়া সামারসেট কাউন্টির বাথে জেন অস্টেন তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন। জেন অস্টেনের স্মৃতি বিজড়িত এই অঞ্চলগুলো তাই সাহিত্যপ্রিয় পাঠকদের কাছে এক জনপ্রিয় পর্যটন স্থান।
স্টিভেনটন
জেন অস্টেনের জন্ম হয়েছিল হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির স্টিভেন্টন নামের এক ছোট্ট গ্রামে। তার পিতা ছিলেন স্টিভেন্টনের ধর্মযাজক-রেক্টর। এই গ্রামীণ পরিবেশেই জেনের বেড়ে ওঠা। জীবনের একটা বিশাল সময় তিনি এখানেই কাটিয়ে ছিলেন। তাদের বাড়ির কাছেপিঠেই অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের বাস ছিল। সে সময় উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে বল ড্যান্সের প্রচলন ছিল। মাঝে মধ্যে জেনও সেই বল নাচে অংশ নিতেন।
এসব উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এবং তাদের আচার-আচরণ পরবর্তীকালে জেনের উপন্যাসগুলোতে স্থান পায়। স্টিভেনটনে ৬০০ বছরের পুরনো গির্জাটি আজও আছে, যেখানে জেন অস্টেনের বাবা রেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। তবে তাদের পারিবারিক বাড়িটির অস্তিত্ব এখন আর নেই।
চওটন
ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির আরেকটি ছোট্ট সাধারণ গ্রাম চওটন। এই গ্রামেই অবস্থিত ‘জেন অস্টেনস হাউস মিউজিয়াম’। আঠারো শতকের শুরুর দিকে ঔপন্যাসিক জেন অস্টেন তার মা ও বড় বোনকে নিয়ে জীবনের শেষ আট বছর চওটনের এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন। এই বাড়িতে থাকার সময়ে প্রকাশিত হয় তার চারটি বিখ্যাত উপন্যাস: ‘প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস’, ‘সেন্স অ্যান্ড সেনসিবিলিটি’, ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এবং ‘এমা’। তার লেখা আরও দুটি উপন্যাস– ‘নর্থঅ্যাঙ্গার অ্যাবে’ এবং ‘পারসুয়েশন’ও তিনি এই বাড়িতে বসেই লিখেছিলেন। তবে উপন্যাস দু’টি তার মৃত্যুর পর ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়। অস্টেন তার লেখালেখি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি এখানেই কাটিয়েছিলেন। তার উপন্যাস যারা ভালোবাসেন, সেসব ভক্তের কাছে চওটন তাই তীর্থস্থানস্বরূপ।
চওটনে এখনও জেন অস্টেনের সে সময়কার পরিবেশের বেশ ছোঁয়া পাওয়া যায়। এমনকি সে আমলের কয়েকটি খড়ের চালার বাংলোও চোখে পড়বে। ছিমছাম এই গ্রামের প্রধান সড়ক একটাই- উইনচেস্টার রোড। রাস্তার ওপরেই এই মিউজিয়াম। অস্টেনপ্রেমী ভক্তরা প্রায় প্রতিদিনই এই মিউজিয়াম দেখতে আসেন। সেই সংখ্যা নেহাত কম নয়।
বাংলোটা তিন তলা। এই বাড়িতেই জেনের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়গুলো কেটেছিল। জাদুঘরের নিচের তলায় রয়েছে দু’জন মহিলার বিশাল সাইজের দাঁড়ানো ভাস্কর্য। সেই মূর্তির পরনে ১৭/১৮ শতকের মহিলাদের পোশাক। মূর্তি দু’টির একজন জেন অস্টেন আর একজন তার প্রিয় বড় বোন কাসান্দ্রার। দুই বোন ছিলেন একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু, দু’জনেই বিয়ে করেননি।
দোতলায় যাওয়ার জন্য প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই ড্রয়িং রুমে বেশ পুরনো একটি পিয়ানো চোখে পড়বে। বড় বোনের সাথে পিয়ানোতে তাল মেলাতেন ছোট বোন জেনও। শোনা যায়, জেন প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে পিয়ানো বাজানো অনুশীলন করতেন। এখানে তার হাতে লেখা নোটেশনের কয়েকটি খাতা সযত্নে রাখা আছে।
সেসময় পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে মেয়েদের পিয়ানো বাজানো প্রধান একটি অনুসঙ্গ ছিল। জেন অস্টেনের প্রায় সব উপন্যাসের প্লটে পিয়ানোর এক অদৃশ্য ভূমিকা দেখা যায়। যেমন, ‘প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস’-এ বল নাচের আসরে নায়িকা এলিজাবেথের ছোট বোনের পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে যাওয়া আর তা নিয়ে তাদের মায়ের গর্বের আতিশয্য প্রধান চরিত্র ডার্সি আর এলিজাবেথের মধ্যে সংঘাতের কারণ হয়েছিল। ‘এমা’ এবং ‘পারসুয়েশন’ দু’টি উপন্যাসেই নায়িকাদের পিয়ানো বাজানো নিয়ে নানা গল্প রয়েছে।
দোতলায় অনেকগুলো ঘর। মিউজিয়ামে রয়েছে জেন অস্টেনের পরিবারের সদস্যদের পোর্ট্রেট, আসবাবপত্র, জেনের লেখার টেবিল, উপন্যাসগুলোর মূল পান্ডুলিপি ও তাদের প্রথম সংস্করণ। আর রয়েছে কয়েকটি স্মারকচিহ্ন যেমন, প্রিয় বোন কাসান্দ্রার জন্য জেনের অ্যাম্ব্রয়ডারি করা ফুল আঁকা রুমাল।
জাদুঘরের আরেক আকর্ষণীয় অংশ হলো একটি কাঠের আলমারি। এই আলমারি জেনের খুব প্রিয় ছিল। কারণ এ আলমারিতে থাকতো চা-পাতা। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে, চা-পাতা দুর্মূল্য তো ছিলই, সহজলভ্যও ছিল না। জেনের জন্য এই চা-পাতা ভারত থেকে আসতো। তাই জেন সবসময় আলমারিটি তালা দিয়ে রাখতেন যাতে কেউ সহজে সে চা-পাতা নিতে না পারে। সেই চা-এর স্মৃতি উসকে দেয়ার জন্য মিউজিয়ামের উল্টোদিকে উইনচেস্টার রোডের ওপরেই জেনের বোনের নামে নির্মিত হয়েছে ‘কাসান্দ্রা টি-শপ’।
মিউজিয়ামটি দেখতে আসলে বোঝা যায়, জেন অস্টেন কেমন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। বাড়ির চারপাশে সবুজ ঘাসের আস্তরণ আর সংলগ্ন বাগান, শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। এই শান্ত পরিবেশের প্রতিফলন পাওয়া যায় জেন অস্টেনের উপন্যাসগুলোতে। মারামারি, হানাহানি বর্জিত এই উপন্যাসগুলোতে ১৯ শতকের গোড়ার দিকের ইংল্যান্ড সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর তার সাথে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর রীতিনীতি, আদব-কায়দা, নৈতিকতাবোধ এবং বিশেষভাবে কন্যাদের পাত্রস্থ করা নিয়ে মায়েদের উদ্বেগের চিত্র উঠে এসেছে। তার দু’টি জনপ্রিয় উপন্যাস ‘প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস’ আর ‘সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি’-তে এসব বিষয়গুলো লেখক দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বাথ
জেন অস্টেন পরিক্রমায় বাথ শহরের গুরুত্বও কম নয়। বাথ শহরটি সম্পর্কে জেন অস্টেনের উপন্যাসগুলোতে বর্ণিত সামাজিক মেলামেশার স্থল ‘আপার রুম’, ‘লোয়ার রুম’ আর পাম্প রুমের বর্ণনা প্রায় ট্যুরিস্ট গাইডের মতো কাজ করে।
১৮ শতকের শেষের দিকে পাম্পরুম তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে পাম্পরুমের বিশাল কক্ষে রয়েছে এক রেস্তোরাঁ, পুরোপুরি অভিজাত পরিবেশ, তবে সেই পাম্পের বিখ্যাত পানি সেখানে আজও বিক্রি হয়। আজও বিত্তশালীরা স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য এ শহরটিতে আসেন ।
জেনের উপন্যাসগুলোতে এই শহরটির কথা অনেকবার এসেছে। তাই জেনের কাছে এ শহরের অধিবাসীরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। আর সেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এখানে একটি স্থায়ী জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে, নাম দেয়া হয়েছে ‘জেন অস্টেন সেন্টার’।
জেন অস্টেন তার পরিবার নিয়ে গ্রে স্ট্রিটে থাকতেন। সেন্টারটিও ওই সড়কের ওপর, তবে তারা যে বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়িতে নয়। সেন্টারের প্রবেশপথে রয়েছে জেন অস্টেনের ভাস্কর্য। জেন অস্টিনের স্মৃতি বিজড়িত জিনিসপত্র দিয়ে এই জাদুঘর সাজানো হয়েছে।
সেন্টারের একটি ঘরে বসে গল্প পাঠের আসর। সেখানে আগত শ্রোতাদের সামনে জেনের বিভিন্ন উপন্যাস থেকে পাঠ করে শোনানো হয়। বাকি ঘরগুলোয় জেনের বিভিন্ন উপন্যাস থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রোমো, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ইমেজ ও বিবরণ প্রদর্শিত হয়।
উইনচেস্টার
জেন অস্টেন পরিক্রমার অন্তিম পর্ব উইনচেস্টার। এখানকার উইনচেস্টার ক্যাথেড্রালে জেনকে সমাধিস্থ করা হয়। পাহাড়ঘেরা ছবির মতো সুন্দর উইনচেস্টারের পরিবেশ খুবই শান্ত, স্নিগ্ধ। এমন পরিবেশেই জেন অস্টিন অন্তিম শয্যা নিয়েছিলেন। এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল তৃতীয় শতাব্দীতে। শহরে প্রবেশমুখেই রয়েছে নবম শতাব্দীর ইংরেজ রাজা অ্যালফ্রেড দ্য গ্রেটের বিশাল দণ্ডায়মান মূর্তি।
গথিক শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত উইনচেস্টার ক্যাথেড্রাল ও জেন অস্টেনের সমাধি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন। এই ক্যাথিড্রালেই ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের সাথে ইংল্যান্ডের রানি প্রথম মেরির (ইতিহাসে যিনি ‘ব্লাডি মেরি’ নামে কুখ্যাত) বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়া গির্জার ভেতরে রয়েছে কয়েকজন বিখ্যাত ধর্মযাজকদের সমাধি।
জেন অস্টেনের লেখা যারা ভালোবাসেন, তারা জেন অস্টেনের স্মৃতি বিজড়িত ইংল্যান্ডের এই স্থানগুলো একবার হলেও দেখতে আসেন। আর সেসব ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান উপভোগ করেন।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ভ্রমণ’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/