একপাশে সবুজ, অন্যপাশে ঝিলের টলটলে পানিতে ছুটে চলছে একের পর এক যাত্রীবাহী ওয়াটার বাস; আর তারই মাঝে সময় কাটানোর জন্য মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে এক বিনোদন কেন্দ্র। বলছি রাজধানীর বুকে অবস্থিত হাতিরঝিলের কথা। দূষণে আচ্ছাদিত ব্যস্ততম এই নগরীতে কর্মব্যস্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পড়ন্ত বিকেলে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন একটা আনন্দময় বিকেল!
গুলশান, বাড্ডা, তেজগাঁও, মৌচাক, কাওরান বাজার, রামপুরা, ফার্মগেট এবং মগবাজার যাওয়ার সহজ মাধ্যম হিসেবে হাতিরঝিল জায়গাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পর্যটকদের সময় কাটানোর জন্য হাতিরঝিলে স্থাপন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পুল, বোটিং সুবিধা। এছাড়াও রয়েছে ভিউইং ডে। হাতিরঝিলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি নান্দনিক ভাসমান এম্ফিথিয়েটার। সেখানে সাংস্কৃতিক শাস্ত্রীয় আচার পালন, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাট্য-নাটিকা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এই গ্যালারিযুক্ত রঙ্গমঞ্চে প্রায় দেড় হাজার দর্শক একত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাছাড়াও এম্ফিথিয়েটারের কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে দশতলা অত্যাধুনিক গাড়ি পার্কিং ভবন। এ ভবনে আরো রয়েছে হাতিরঝিলের প্রধান কার্যালয় ও জাদুঘর।
এখানের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে বিকেল, সন্ধ্যা বা রাতের সময়টায়। কেননা ঝিলের সৌন্দর্যবর্ধনে স্থাপন করা হয়েছে আকর্ষণীয় প্রস্রবণ, যা গোধূলিবেলার পর থেকে রংধনুর মতো বাহারি রঙের আলোকসজ্জায় আলোকিত হয়ে থাকে। সেইসাথে সঙ্গীতের তালে তালে অসাধারণ ফোয়ারা নৃত্য নজর কাড়বে যেকোনো পর্যটকের। বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী আসেন হাতিরঝিল পরিদর্শন করতে।
হাতিরঝিলের ইতিহাস ঘেঁটে লক্ষ করা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ রাজা ভাওয়ালের পোষা হাতিগুলোকে রাখা হতো ঢাকার পিলখানায় (বর্তমান যা বিডিআর সদরদপ্তর নামে পরিচিত) এবং হাতিগুলো অবগাহন করার জন্য কয়েকটি এলাকা অতিক্রম করে বেগুনবাড়ি ঝিলে যেত। অধিকন্তু, সেই ঝিলে তাদের আনাগোনা একটু বেশিই লক্ষ্য করা যেত। সেই থেকে ঝিলের আগে ‘হাতি’ নামটি যুক্ত করে হাতিরঝিল রাখা হয় এবং হাতির অতিক্রম করা এলাকাগুলোর নাম রাখা হয় হাতিরপুল ও এলিফ্যান্ট রোড।
২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি হাতিরঝিল প্রকল্পটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হলেও দর্শনার্থী স্থান হিসেবে বাস্তবায়ন করার জন্য পরবর্তীতে আরো কয়েক বছর লেগেছে। এক হাজার নয়শো ষাট কোটি টাকা ব্যয়িত এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ এবং রাজধানীর যানজট প্রশমন। হাতিরঝিল প্রকল্পের স্থপতি ইকবাল হাবিব এবং সমন্বিত এলাকার প্রকল্প পরিচালক মেজর জেনারেল সাঈদ মোহাম্মদ মাসুদ।
ঢাকা মহানগরীর হাতিরঝিল প্রকল্পে পূর্ব-পশ্চিমে ৮ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট হাইওয়ে এক্সপ্রেস রোড, ৪৭৭ দশমিক ২৫ মিটার দূরত্বের চারটি ব্রিজ, এলাকা যানজট কমানোর জন্য ৪০০ মিটার বিশিষ্ট চারটি ওভারপাস, গমনকারী ও পর্যটকদের সুবিধার্থে ৮ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ফুটপাত এবং জলাভূমি অতিক্রম করার জন্য তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির অবকাঠামো ও বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন’ (এসডব্লিউও) ইউনিট।
প্রকল্পটি নগর পরিবেশ এবং গণপরিসর সৃষ্টিশীলতার জন্য ‘পরিসর পরিকল্পনা’ শ্রেণিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাডোরা)’-এর কাছ থেকে ‘গ্রেট প্লেস অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ অর্জন করে।
বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই হাতিরঝিল। সম্পূর্ণ ঝিল ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ‘হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিস’। ৩২ থেকে ৪৬ আসনের কয়েকটি বাস রয়েছে, যার মধ্যে দু’টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রামপুরা, এফডিসি, শ্যুটিং ক্লাব, বনশ্রী, মেরুল বাড্ডা ও কাওরান বাজারে বাসগুলোর কাউন্টার রয়েছে এবং সেখান থেকেই টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। সম্পূর্ণ হাতিরঝিল ঘোরার জন্য বাসে জনপ্রতি গুনতে হবে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা এবং রামপুরা থেকে কাওরানবাজার যাওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ টাকা।
ভ্রমণকে আরো আনন্দিত করার জন্য জলাশয়ে রয়েছে নৌ-ভ্রমণের সুযোগ। জলাশয়ে নৌ-ভ্রমণ করার জন্য রয়েছে প্যাডেল বোট আর ওয়াটার বাস। ঝিলে ভ্রমণের পাশাপাশি ওয়াটার বাসে করে গুলশান, খিলগাঁও, রামপুরা, মৌচাক ও মালিবাগ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হবে। যাত্রীবাহী ওয়াটার বাস সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চালু থাকে।
যাবার পথ
রাজধানী ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে সিএনজি অথবা বাসে করে যাওয়া যায় হাতিরঝিলে। আর যদি ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজস্ব পরিবহন বা গাড়ি নিয়ে আসেন, তাহলে বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি, বেইলি রোড, খিলগাঁও, মধ্য বাড্ডা, বনশ্রী অতিক্রম করে আসতে হবে।
খাওয়া-দাওয়া
উদরপূর্তির জন্য ব্রিজের দু’পাশে রয়েছে ফাস্টফুড ও ফুচকা-চটপটির দোকান। ভারি খাবারের জন্য এখানে রয়েছে হাতিরঝিল রেস্টুরেন্ট, হাতিরঝিল লেক রেস্টুরেন্ট এবং ক্রুয়া থাই রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও এফডিসি মোড়, পুলিশ প্লাজা, রামপুরা, মধ্য বাড্ডা সহ বেশ কিছু জায়গায় একাধিক রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। চাইলে যেকোনো একটাতে চেপে বসে অনায়াসে লাঞ্চ বা ডিনার সেরে নিতে পারবেন। খাবারের আগে দাম সম্পর্কে অবগত হয়ে নেওয়া উত্তম।
আশেপাশে যা আছে
হাতিরঝিল ছাড়াও এর আশেপাশে বেশ কিছু জায়গায় দর্শনার্থীদের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। আপনি চাইলে হাতে সময় নিয়ে হাতিরঝিল চিলড্রেন পার্ক, গুলশান লেক, এফডিসি (চলচ্চিত্র ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন), ধানমন্ডি লেক, বাংলাদেশ শ্যুটিং স্পোর্টস ফেডারেশন, গুলশান সাউথ পার্ক কিংবা মিল ব্যারাক পুলিশ শ্যুটিং ক্লাব থেকে এক ঝলক উঁকি মেরে আসতে পারেন।