ভ্যাটিকান সিটি নামটি শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষুদ্র এক রাষ্ট্রের নাম। তবে বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটি কেবল ইউরোপ মহাদেশেরই সবচাইতে ক্ষুদ্র দেশ। কেননা বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সিল্যান্ড। যা-ই হোক, ভ্যাটিকান সিটি ক্ষুদ্র, তবে স্বাধীন একটি দেশ, এবং ইতালি তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর রোমেই এই দেশটির অবস্থান। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পাশাপাশি দেশটির রহস্যময় গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্ব জুড়ে। আজকের আয়োজনে তাই ভ্যাটিকান সিটির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণী থাকছে।
প্রাচীন রোম নগরীর তিবের নদীর পাড়ঘেরা বর্তমান ভ্যাটিকান সিটির জায়গায় একটি পাহাড় ছিল, যাকে স্থানীয় ভাষায় মন্তেস ভ্যাটিকানি বা মাউন্ট ভ্যাটিকান নামে ডাকা হতো। মূলত এখান থেকে পরবর্তীতে এই স্থানের নাম ভ্যাটিকানে রূপান্তরিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর কথা, আগ্রাপিনা দ্য এল্ডার নিজের আরাম-আয়েশ আর বাগান বিলাসের জন্য রোমের তিবের নদীর পাড় ঘেরা পাহাড় অঞ্চল কেটে এক বিশাল উদ্যান বানান। তার বেশ কিছু বছর পর থেকে সেই উদ্যানের পাশের প্রধান সড়ক জুড়ে বেশ কিছু বসতি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে জনশূন্য জায়গাটি ঘনবসতিতে পূর্ণ হয়।
আগ্রাপিনা দ্য এল্ডারের ছেলে সম্রাট ক্যালিগুলা যিনি পরবর্তী সম্রাট ছিলেন, তিনি এই উদ্যানের স্থলে সার্কাস বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন চল্লিশ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে, কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি তা সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। ক্যালিগুলার পরবর্তী সম্রাট ছিলেন, সম্রাট নিরো যিনি পূর্ববর্তী সম্রাটের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন। সার্কাস প্রাঙ্গনটি ছিল ৫০০ মিটার লম্বা এবং ১০০ মিটার চওড়া। সার্কাসের নামকরণ করেন গাই সার্কাস দ্য নিরোনেস, যা নিরোর সার্কাস নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছিল।
জানা যায়, সার্কাসটি বর্তমান সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার অনুরুপ পূর্ব-পশ্চিম দিকেই সারিবদ্ধভাবে ছিল এবং এর মূল মঞ্চটা ছিল দক্ষিণ দিকে। প্রাচীন সেই ভ্যাটিকান আর আজকের দিনের ভ্যাটিকানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্যণীয়, তবে সেই প্রাচীন ভ্যাটিকানের একমাত্র দৃশ্যমান ভগ্নাবশেষ হচ্ছে ভ্যাটিকান ওবেলিস্ক, যা সার্কাসের স্পিনা সাজানোর কাজে সম্রাট ক্যালিগুলা হেলিওপেলিস থেকে আনিয়েছিলেন। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে পুরো রোম জুড়ে এক বৃহৎ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে যা ইতিহাসে দ্য গ্রেট ফায়ার অফ রোম নামে পরিচিত। তখন এই জায়গাটিকে খ্রিস্টানদের সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
প্রাচীন প্রথাগত বিশ্বাস মতে, এখানেই সেইন্ট পিটারের শরীরকে উল্টো করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তার সহচারীগণ সকলকে পুড়িয়ে আর নয়তো ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগ থেকেই ভ্যাটিকানের পরিবর্তন আসা শুরু করে সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের হাত ধরে। ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন এবং পুরো ভ্যাটিকানজুড়ে প্যাগান স্থাপনাসমূহ ভেঙে ফেলেন। নিরোর সার্কাসখ্যাত প্রাঙ্গনে সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, এই ব্যাসিলিকার নীচেই আছে পবিত্র সেইন্ট পিটারের সমাধি।
এই সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা কেবল ভ্যাটিকানবাসীদের কাছেই নয়, বরং সারা বিশ্বের সব ক্যাথলিক খ্রিস্টানের কাছে পবিত্র এক স্থান। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পোপ এই ব্যাসিলিকার সংরক্ষণ এবং সংস্কার করেছিলেন। সম্রাট কন্সট্যান্টাইন নির্মিত এই ব্যাসিলিকা তখন থেকে এখন অবধি ভ্যাটিকান তথা পুরো বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানধর্মী মানুষদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা নির্মাণের মধ্য দিয়েই মূলত ভ্যাটিকান ও এর আশেপাশে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায় এবং অত্র অঞ্চল ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। পোপেরাই মূলত রাষ্ট্রনেতার মতো ঐ সমস্ত অঞ্চল শাসন করতো তখন।
৮২৪ খ্রিস্টাব্দে পোপ চতুর্থ লিওয়ের সময়কালে সারাসান পাইরেটস বা বেদুইন জলদস্যুদের দ্বারা সেইন্টা পিটার ব্যাসিলিকা এবং ভ্যাটিকান ও এর আশেপাশের অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পোপ লিও নদীপাড়ের উন্মুক্ত এই অঞ্চলকে চারিদিক দিয়ে সীমানা বেষ্টিত করার পরিকল্পনা করেন এবং সে মোতাবেক কাজও শুরু করে দেন। ৮৫২ খ্রিস্টাব্দেই ৩৯ ফুট লম্বা আর পাথরের তৈরি অত্যন্ত মজবুত এক প্রাচীর নির্মাণ করে পোপের নামেই লিওনাইন শহরের অভিষেক হয় ভ্যাটিকানের বুকে। পরবর্তীতে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পোপ অষ্টম আরবানের সময়কাল অবধি এই প্রাচীরের অনেক সংশোধন আর সংস্কার হয়।
তবে সেই প্রথম শতাব্দীর এক ক্যাথলিক চার্চই ভ্যাটিকানের গোড়াপত্তন করেছিল বলেই ইতিহাসবিদদের ধারণা। যদিও খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের আরো অনেক আগে থেকেই এই জায়গাটিকে পবিত্র মানা হয়। কেননা, এখানে রোমান দেবী সিবেল এবং তার স্বামী আটিসের উপাসনা করা হতো। সে যা-ই হোক, এই প্রাচীরঘেরা লিওনাইন শহর মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর সময়কালে আধ্যাত্মিকতার প্রধান প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। যদিও সেই সময় পোপরা লাতেরান প্রাসাদে বসবাস করতেন তবুও এই শহর তথা রোমের উপর পোপদেরই কর্তৃত্ব বিরাজমান ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে পোপ সিমাকাস সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার কাছাকাছি লাতেরান প্রাসাদের অনুকরণে কিংবা অনুপস্থিতিতে এখানকার কার্য পরিচালনার জন্য অ্যাপোলোস্টিক প্যালেস বা পাপাল প্যালেস নির্মাণ করেছিলেন পোপদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বা ধর্মগুরু সেইন্ট পিটারের কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে পোপ তৃতীয় ইউজিন এবং পোপ তৃতীয় ইনোসেন্টের সময়কালে এই প্যালেসের আরো বেশি সংস্কার হয়।
মধ্যযুগের একটা অন্ধকার সময় ছিল যখন চার্চের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছিল এবং এই সংক্রান্ত আরো নানা কারণে পাপাল প্রাসাদ তখন ফ্রান্সের এভিগগনে সরে যায় এবং রোমের সমস্ত কার্যক্রম প্রায় এক শতাব্দীর মতো সময়কাল বন্ধ ছিল। সময়টা ছিল ১৩০৭ থেকে ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার। পরবর্তীতে পোপ পঞ্চম নিকোলাস ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের কাজ শুরু করেন, এবং এই প্রাসাদই পরবর্তীতে তার উত্তরাধিকার হিসেবে আসা পোপদের স্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে এখন অবধি পরিগণিত হয়ে আসছে, এবং পোপ নিকোলাসের সংগ্রহে থাকা বইগুলো নিয়ে ভ্যাটিকান লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়।
১৪৭০ সালে পোপ চতুর্থ সিক্টাসের তত্ত্বাবধানে সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেসকোর কাজ শুরু করেন বিখ্যাত শিল্পী বতেচেল্লি এবং পেরুগিনো। অতপর ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে রেনেসাঁর মহাজাগরণের সময় পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস বিখ্যাত আর অমর শিল্পী মাইকেলেঞ্জোকে সিস্টিন চ্যাপেল তথা সমগ্র ভ্যাটিকানকে আধুনিকায়নের দায়িত্ব দেন। একইসাথে ১২০০ বছরের পুরাতন আর জরাজীর্ণ সেইন্টা পিটার ব্যাসিলিকাকে ভেঙে একই আদলে এবং নকশায় কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয় দোনাতে ব্রামান্তেকে। পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস মারা গেলে ব্রামান্তেকে এই কাজে সাহায্য করেন স্বয়ং মাইকেলেঞ্জোলো।
ভ্যাটিকানের বিখ্যাত গোলাকার গম্বুজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৫৯০ সালে গিয়াকার্মো দেল পোত্রের হাতে এবং তা শেষ হয় ১৬২৬ সালে। ১৯৮৯ সালে আইভরি কোস্টের ব্যাসিলিকা অফ আওয়ার লেডি অফ ইয়ামাসুক্রো নির্মাণের আগ অবধি ৪৫২ ফুট লম্বা এবং ৫.৭ একর জায়গা জুড়ে থাকা এই সেইন্ট পিটার স্কয়ারই ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম এবং বিখ্যাত ক্যাথলিক চার্চ। ১৮৭০ সালের আগ অবধি ভ্যাটিকান এবং এর আশেপাশের এলাকা পোপীয় রাষ্ট্র বা পাপাল স্টেট নামেই পরিচিত ছিল। কিন্তু ঐ বছর ইতালীয় সরকার দেয়ালঘেরা ভ্যাটিকানের বাইরের সমস্ত অঞ্চল সরকারি সম্পত্তি বলে ঘোষণা দেয়। এই এক ঘোষণা ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার এবং চার্চের মধ্যে আগামী ৬০ বছরের জন্য দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়।
অবশেষে, পোপ সম্প্রদায় এবং ইতালীয় সরকারের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলমান বিতর্কের অবসান হয় ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ক্যাথলিকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত পোপ একাদশ পায়াস এবং ইতালীয় রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েলের পক্ষ থেকে বেনিটো মুসোলিনি আসেন এক সমঝোতা চুক্তি করতে। এই চুক্তির সম্পূর্ণ দায়ভার ছিল কার্ডিনাল পিয়েত্রো গ্যাস্পেরির কাঁধে। লাতেরান চুক্তি নামে এই চুক্তির মাধ্যমেই ভ্যাটিকান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে কেবল ভ্যাটিকান ব্যতীত অন্যান্য পোপীয় রাষ্ট্রীয়সমূহ থেকে দাবী প্রত্যাহার করে নিতে হয়। অবশ্য সেজন্য ইতালীয় সরকার ক্ষতিপূরণও দিয়েছিল।
সেই লাতেরান চুক্তির মধ্য দিয়ে ভ্যাটিকান স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পোপের নিজস্বভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সারাবিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের কাছে ক্যাথলিক গির্জার বিশ্ব সদর দফতর হিসেবে কাজ করা শুরু করে। ভ্যাটিকানের ইতিহাস একদিনের ইতিহাস নয়; তিলে তিলে সময়ের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছে এই দেশ। পবিত্রতা আর ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে সারা বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে এই ভ্যাটিকান সিটি।
পৃথিবীর একমাত্র এবং শেষ পোপীয় রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটি। দ্য হলি সী অথবা ইতালীয় ভাষায় সিটা ডেল ভ্যাটিকানো নামেও পরিচিত এই দেশটির আয়তন হচ্ছে প্রায় ১১০ একর বা ০.৪৪ বর্গ কিলোমিটার। ২ মাইল সীমানাপ্রাচীর বেষ্টিত এই দেশটির আরো প্রায় ১৬০ একরের মতো জায়গার মালিকানা আছে অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সেইন্ট পিটার্স স্কয়ার (পিয়াজ্জা সান পিয়েত্রো) ব্যতীত মধ্যযুগীয় আদলে এবং রেনেসাঁর সময়ে নির্মিত প্রাচীর সীমানা দিয়ে চারিদিক থেকে বেষ্টিত। ছয়টি প্রবেশপথের মধ্যে তিনটি- দ্য পিয়াজ্জা, আর্ক অফ দ্য বেল (আর্কো ডেল কোম্পেইন) যা মূলত সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার সম্মুখভাগ, এবং উত্তর দিকের প্রাচীরের ভ্যাটিকান যাদুঘর এবং গ্যালারিগুলো জনসাধারণের জন্য একদমই উন্মুক্ত।
শহরের প্রাচীরের মধ্যে থাকা দ্য ভ্যাটিকান প্যালেস বা ভ্যাটিকান প্রাসাদটি মূলত পোপের আবাসস্থল। পোপ কেবল ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরুই নন, বরং তিনি ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রনেতাও বটে। তবে ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রনেতা তথা পোপ নির্বাচনেও আছে বিশেষ আর নিজস্ব ঐতিহ্য। পোপ নির্বাচনের এই পুরো পদ্ধতিকে বলা হয়ে থাকে কনক্লেভ। ল্যাটিন ভাষায় এই শব্দটির অর্থ রুদ্ধ কক্ষ। আর পোপ নির্বাচনের সময় বহির্জগতের সাথে কার্ডিন্যাল এবং বিশপদের কোনো যোগাযোগ থাকে না; এমনকি কনক্লেভের জন্য নির্বাচিত সিস্টেন চ্যাপেলের অভ্যন্তরে সবাইকে রেখে পেছন থেকে দুটো লোহার চেইন ঝুলিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিলগালা করে দেয়া হয়। নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া অবধি গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা আর মৃত্যুই তাদেরকে সেই কক্ষ থেকে বের করতে পারবে।
সাধারণত, চারজন প্রেফারিতি বা বিশপ থাকেন এবং কলেজ অফ কার্ডিন্যাল থেকে বাছাইকৃত শ’খানেকের মতো (সংখ্যাটা কম-বেশিও হতে পারে) কার্ডিন্যাল থাকেন যারা মূলত পোপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নীতিগতভাবে যেকোনো ক্যাথলিক ধর্মপ্রাণ মানুষই পোপের জন্য নির্বাচিত হতে পারেন। তবে চতুর্দশ শতাব্দীর পর থেকে কেবল কার্ডিন্যালদের মধ্য থেকেই কাউকে পোপ নির্বাচিত করা হচ্ছে। কনক্লেভের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধান করা হয়ে থাকে। নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণাটাও জানা যায় সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া দেখে। প্রত্যেক কার্ডিনালকেই একাধিক ভোটপত্র দেয়া হয়ে থাকে, কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কয়েকবার ভোট দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। পোপ হতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ কার্ডিনালদের সমর্থন পেতে হবে। কিন্তু যদি ঐ ভোটে পোপ নির্বাচিত না হন, তাহলে ভোটের কাগজগুলো ফেলা দেয়া হয় পোড়ানোর জন্য, সাথে কিছুটা আলকাতরা বা তেল অথবা রাসায়নিক তরল মিশিয়ে দেয়া হয়, যার ফলে সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়, যার অর্থ পোপ এখনো নির্বাচিত হয়নি।
তবে যদি কোনো কার্ডিন্যাল সমবেত কার্ডিনালদের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন বা ভোট পেয়ে যান তাহলে সেই কাগজগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়, তবে সেবার শুধু কাগজ পোড়ানো হয়, যার জন্য চিমনি থেকে সাদা ধোঁয়া নির্গত হয়; যার অর্থ ক্যাথলিকরা তাদের নতুন পোপ পেয়ে গেছেন। একইসাথে সেইন্ট পিটার্স গির্জার সকল ঘন্টা একইসাথে বাজতে শুরু করে। কার্ডিন্যালদের মধ্যে যিনি সবচাইতে প্রবীণ তিনি সিস্টিন চ্যাপেলের বারান্দায় আসেন এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হাবেমুস পাপাম’ অর্থাৎ আমরা আমাদের পোপকে পেয়ে গেছি। এরপর স্বয়ং নবনির্বাচিত পোপ সেইন্ট পিটার্স স্কয়ারে আসেন এবং সমবেত জনতাকে নিজের আশীর্বাদ দিয়ে পোপ বলে নিজেকে স্বীকৃতি দান করেন।
পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর সকল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে পোপের নাম নির্বাচনটাও একধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই পড়ে। পোপ নিজেই নিজের নাম দেন। যেমন- জার্মানির কার্ডিন্যাল ইয়োসেফ রাৎসিতা, যাকে আমরা পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট নামেই জানতাম। খ্রিষ্টীয় বেনেডিক্টাইন মঠের প্রতিষ্ঠাতা নুর্সিয়ার বেনেডিক্টকে শ্রদ্ধা ও স্মরণে রাখার জন্যই এমন নামকরণ। পোপের মৃত্যু হলে দেহাবসানের ১৫ দিন পর আবারো নতুন কনক্লেভ আহবান করেন ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক প্রধান এবং পোপের সবচাইতে কাছের এবং পোপের পর ভ্যাটিকানের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ক্যামারলেঙ্গো। ঐতিহ্যগতভাবে রূপোর হাতুড়ি পোপের মাথায় ঠুকে পোপের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়, তবে যদি পোপ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন সেক্ষেত্রে এই একই নিয়ম মানা হয় না। যেমনটা- শেষ পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের বেলায় ঘটেছিল।
পোপের হাতে একটি সিগনেট আংটি থাকে যাতে সেইন্ট পিটার্সের ছবি এবং পোপের নাম খোদাই করা থাকে। এই আংটিকে ফিশ্যারম্যান রিং নামে ডাকা হয়। কেননা, পেশায় জেলে ছিলেন এই খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক। পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগে এই আংটি খুলে ফেলা হয় এবং ঐ একই রূপোর হাতুড়ি ব্যবহার করে এটিকে ভেঙে ফেলা হয়। পরবর্তী কনক্লেভের আগে আগে এই আংটি আবারো বানানো হয় এবং নবনির্বাচিত পোপ হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই এই ফিশারম্যান আংটি তৈরি হয়ে যায়। আংটি অবশ্য পোপ ভেদে ভিন্নও হয়ে থাকে বটে। যেমন, পোপ জন পল লম্বা ধাঁচের আংটি পড়েছিলেন আবার পোপ বেনেডিক্ট পড়েছিলেন একদম গোল ডিম্বাকৃতি ধাঁচের। এছাড়াও, পোপ নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে পোপের রোব এবং মাথার টুপি প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।
ছোট বা ক্ষুদ্র দেশের তকমা থাকলেও ভ্যাটিকান সিটিকে সমৃদ্ধ একটি দেশ বলা যায়। কেননা, ভ্যাটিকান সিটির আছে নিজস্ব সংবিধান, সীলমোহর, পতাকা, রাষ্ট্রীয় প্রতীক, ডাকব্যবস্থা, টেলিফোন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রেডিও এবং নিজস্ব সংবাদপত্র ও অনলাইন ওয়েবসাইট। ভ্যাটিকানে ইউরোর পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থাও আছে। অবশ্য ভ্যাটিকানের মুদ্রায় তাদের পোপের ছবি খোদাই করা থাকে। এছাড়াও, ভ্যাটিকানের মধ্যে আছে একটি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এবং ভ্যাটিকানের নিজস্ব লাইব্রেরি।
পোপ এবং দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য আছে সুইস গার্ড বা পটেনশিয়াল সুইস আর্মি নামে খ্যাত একদল সেনাবাহিনী। ৫ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি লম্বা এবং ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী ক্যাথলিকরাই কেবল এই পদে যোগদান করতে পারে। তবে এদের জন্য সবচেয়ে কঠোর নিয়মটা হচ্ছে তাদের বিয়ে করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিগত ৫০০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে এই সেনাবাহিনী পোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে। ভ্যাটিকানে আছে পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষুদ্র রেলওয়ে ব্যবস্থা, যার নাম সিটা ডেল ভ্যাটিকানোই। মাত্র ৩০০ মিটারের এই রেলওয়েটি কেবল মালামাল আনা-নেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয়।
ভ্যাটিকানের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য স্থায়ীভাবে দেশটিতে বসবাসের পাশাপাশি পোপ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। ভ্যাটিকানের নাগরিকরা বৃদ্ধ হলে তাদেরকে ইতালিতে প্রেরণ করা হয় এবং পরবর্তী যুবকদের নিয়ে আসা হয় বাকিটা পথ ধর্মের পথে অতিবাহিত করার জন্য। হাজার জনসংখ্যার দেশটিতে এত নিয়মকানুন থাকা সত্ত্বেও এই দেশটির অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও, দেশটির জনগণ প্রচণ্ড রকমের মদ্যপ। ভ্যাটিকানে বিবাহ বিচ্ছেদ এককথায় নিষিদ্ধ। কোনো কারণেই বিবাহের বিচ্ছেদের ভ্যাটিকানে সম্ভব নয়। এমনকি আপিল বিভাগে আপিল করেও বিশেষ কোনো লাভ হয় না।
দেশটির আরেকটি কঠোর নিয়ম হচ্ছে, আপনি চাইলেই যেকোনো পোশাক পরেই ভ্যাটিকান সিটি থেকে ঘুরে আসতে পারবেন না। হাফ প্যান্ট বা শর্ট স্কার্ট পরিধানে বিধিনিষেধ আছে; আর যদি অতিরিক্ত চামড়া প্রদর্শনীদায়ক কোনো পোশাক থাকে সেক্ষেত্রে দেশ থেকে বেরও করে দিতে পারে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, দেশটির কোনো পাসপোর্ট স্ট্যাম্প নেই। অর্থাৎ আপনি ভ্যাটিকানে বেড়াতে গেলেও আপনার পাসপোর্টের কোনো সীল বা স্ট্যাম্প পড়বে না।
রহস্য আর গোপনীয়তার শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ভ্যাটিকান সিটিকে। কিন্তু কেন? এই সকল রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ভ্যাটিকান সিটি আর্কাইভ বা সংগ্রহশালা, যেটা স্টোর হাউজ অব সিক্রেট নামেও পরিচিত। সপ্তদশ শতকে পোপ পঞ্চম পলের হাত ধরেই এই সংগ্রহশালার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই সংগ্রহশালায় ঢুকতে হলে চাই পোপের অনুমতি। পোপের অনুমতি ব্যতীত এখানে প্রবেশ অসম্ভব। ৮০০ শতক থেকে সংগ্রহে থাকা ডকুমেন্টসমূহের নিরাপত্তা আর সংরক্ষণের জন্যই এত কঠোর নিয়মকানুন।
তবে গবেষণার কাজে পোপের অনুমতি নিয়ে পন্ডিতগণ এখানে গবেষণার কাজ চালাতে পারেন, তা-ও সেটা স্বল্প সময়ের জন্য। ধারণামতে, এখানে প্রায় ৮৪ হাজার বই আছে। এর মধ্যে খ্রিস্টান মিশনারী, প্যাগানসহ আরো বিভিন্ন ধর্ম আর মতবাদের বই এখানে মজুদ আছে। এছাড়াও, বিজ্ঞানের আবিষ্কার বিষয়ক বিজ্ঞানীদের বইগুলোর কপিও এখানে সুরক্ষিত আছে। তবে সবচাইতে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, এখানে বাইবেলের আদি সংস্করণ এবং হারিয়ে যাওয়া গসপেলগুলো সুরক্ষিত আছে।
ভ্যাটিকানের আরেকটি প্রচলিত রহস্য হচ্ছে ভ্যাটিকানেই আছে টাইম মেশিন। অর্থাৎ যে যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে অতীত আর ভবিষ্যতের ঘটনা বর্তমানে বসেই জানা যাবে। ধারণা করা হয়, ১৯৫০ সালে এই যন্ত্র গোপনে বানানো হয় এবং এখন তা ভ্যাটিকানের সবচাইতে গোপন আর সুরক্ষিত স্থানেই আছে যা লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রকৃতিবিজ্ঞানী এবং ফাদার মারিয়া আর্নেত্তির নেতৃত্বে ১২ জন বিজ্ঞানী মিলে এই যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এমনকি ফাদার মারিয়া আর্নেত্তির অতীতে যেয়ে যীশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও দেখেছিলেন বলে দাবী করেছিলেন।
নানাবিধ রহস্যের দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে বরং ঘুরে আসতে পারেন ভ্যাটিকান সিটি থেকে। কেননা, প্রায় হাজার জনসংখ্যার এই দেশটিতে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ আসে পর্যটক হয়ে। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সিস্টিন চ্যাপেল, সেইন্ট পিটার্স স্কয়ার, সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা এবং ভ্যাটিকান মিউজিয়াম। সিস্টিন চ্যাপেলেই আছে রেনেসাঁ যুগের অমর শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর বিখ্যাত আর অমর শিল্পকর্ম দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম। এছাড়াও, সিস্টিন চ্যাপেল এবং পুরো ভ্যাটিকানজুড়েই মাইকেলেঞ্জোলো, রাফায়েল, ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি কিংবা দোনোতেল্লোর মতো বিখ্যাত শিল্পীদের ফ্রেসকো, ওবেলিস্ক কিংবা ভাষ্কর্য অথবা স্থাপত্যশিল্প চোখে পড়বে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি