‘দ্য ইন্সটিটিউট ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড পিস’ (আইইপি) -এর তত্ত্বাবধানে তৈরি ‘গ্লোবাল পিস ইনডেক্স’ অনুসারে, বিগত ১০ বছর ধরে আইসল্যান্ড পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে শান্তির দেশ হিসেবে প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। শুধু তা-ই নয়, আইসল্যান্ড তালিকায় থাকা শীর্ষ ৪টি দেশের তুলনায় কম সামরিক শক্তিসম্পন্ন দেশ। উল্লেখ্য, তালিকায় থাকা অন্য শীর্ষ দেশগুলো হলো নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল ও ডেনমার্ক।
‘দ্য ইন্সটিটিউট ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড পিস’ মূলত বিশ্বের শতকরা ৯৯.৭ হার মানুষের আবাসস্থল ১৬৩টি স্বাধীন দেশকে নিয়ে এই তালিকা তৈরি করে। তিনটি মানদণ্ডের অধীনে ২৩টি গুণগত ও সংখ্যাগত নির্দেশকের প্রেক্ষিতে এই তালিকা গঠিত হয়।
সেই তিনটি মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে- সামাজিক নিরাপত্তা, দেশের বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এবং সামরিক শক্তির অবস্থা। এই বছর ৯২টি দেশের অবনতি হয় এবং মাত্র ৭২টি দেশের উন্নতি হয়। তবে ২০০৮ থেকে এই পর্যন্ত আইসল্যান্ডই প্রথম অবস্থানটি ধরে রেখেছে।
যেসব কারণে আইসল্যান্ড শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় প্রথম
একটি দেশ কতটা শান্তির তা পর্যালোচনা করার জন্য সেই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রের অবস্থা, যেমন- সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং এরকম সকল ক্ষেত্রের অবস্থাই দেখতে হবে।
১. কোনো শ্রেণীভেদ না থাকা
আইসল্যান্ডের অধিবাসীদের মধ্যে ধনী-গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই। সেখানকার ৯৭ ভাগ নাগরিক নিজেদের মধ্যবিত্ত বলেই আখ্যায়িত করে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে আর্থিক কোনো অস্থিতিশীলতা নাই। তারা তাদের সন্তানদের একই ধরনের স্কুলে পাঠান এবং খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। আবার তাদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো বিষয় নিয়েও উত্তেজনা নেই। সেই দেশে বেশিরভাগ নাগরিকই ইভানজেলিকাল লুথেরান ধর্মে বিশ্বাসী। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই লুথারান স্টেট চার্চের অংশ বা এর অনুসারী। প্রায় ১০,০০০ মুসলিমও রয়েছে আইসল্যান্ডে। এছাড়া অন্যান্য ধর্মের মানুষও আছে এখানে।
২. লিঙ্গ বৈষম্যহীনতা
‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি’ এর তালিকা অনুসারে, আইসল্যান্ড পর পর ৭ বছর ধরে লিঙ্গ সমতার দিক থেকে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ১৪৪টি দেশের তালিকায় এই ছোট দেশটি শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থানটি বেশ পোক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের প্রায় শতকরা ৬৬ ভাগ নারী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।
অবস্থাটা আসলে অন্যান্য দেশের তুলনায় একদম উল্টো। কারণ আইসল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় বেশি। পার্লামেন্টের ৬২টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসনই নারীদের অধীনে অর্থাৎ শতকরা ৪৮ ভাগ ক্ষমতা নারীদের হাতে। এছাড়াও দেশটির ৮০ ভাগ নারীই বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে জড়িত। পারিবারিক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যতামূলক পিতৃত্বকালীন ও মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে ভিগদিস ফিনবোগাদোত্তির শুধু আইসল্যান্ডের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।
৩. কোনো সেনাবাহিনীর বা পুলিশের প্রয়োজন হয় না
আইসল্যান্ড উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত। অর্থাৎ এর চতুর্দিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। জনসংখ্যা মাত্র তিন লাখ ৩৪ হাজারের কাছাকাছি এবং সকলে বেশ শান্তিপ্রিয়। এই দেশ রাজনৈতিকভাবেও বেশ নিরপেক্ষ।
তাই তাদের নিরাপত্তার জন্য বেশি কোনো কষ্ট করা লাগে না। তবে তারা এখনও একটি ছোট উপকূলীয় বাহিনী বহাল রেখেছে যেখানে ৩০০-৪০০ সৈনিক, ৪টি যুদ্ধবিমান এবং ৩টি পেট্রোলের মজুদ সমেত জাহাজ আছে।
এছাড়া তারা নিরাপত্তার জন্য ন্যাটোর সদস্য হিসেবেও সই করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের একটি চুক্তিও আছে। যার মতে, যুক্তরাষ্ট্র কখনও আইসল্যান্ডের উপর হামলা করবে না। ১৯৪৪ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ৭৪ বছরে এভাবেই দেশটি আছে এবং এই অবস্থা কেউ পরিবর্তনের চেষ্টাও করেনি।
আইসল্যান্ডের পুলিশ সাধারণত বন্দুক, পিস্তল বা এ ধরনের কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না, যদিও প্রশিক্ষণের সময় তাদেরকে এগুলো চালানো শেখানো হয়। সেখানে সাধারণ কোনো জনগণ চাইলেই নিজের কাছে কোনো অস্ত্র কিনতে বা রাখতে পারে না এবং অবৈধ পন্থায় সেখানে তা কেনার কোনো সুযোগও নেই। আরো একটি ব্যাপার হলো আইসল্যান্ডের পুলিশদের প্রশিক্ষণের ধরন।
যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীতে ১৯ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেখানে আইসল্যান্ডে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। রটগার্স ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক পল হির্সফিল্ড এ ব্যাপারে বলেন, “আপনাকে যদি ১৯ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে আপনি শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে শিখবেন। দুঃখজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণ শুধু আপনাকে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শেখাবে। কিভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারেন তা শিখতে সহায়তা করবে। যদি আপনাকে তিন বছরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে আপনি অন্যদের রক্ষা করাও শিখবেন।”
আরো একটি বিষয় হলো আইসল্যান্ডবাসীর মধ্যে খুন করার প্রবণতাও অনেক কম। প্রতি বছর শতকরা ০-১.৫ ভাগ খুনের ঘটনা দেখা যায়। এছাড়া কোনো বড় অপরাধ তো দূরের কথা, ছোটখাটো চুরিও সেখানে বিরল ব্যাপার। তাই পুলিশের বেশি একটা দরকার পড়ে না।
৪. মশার কোনো উপদ্রব নেই
লেখাটা পড়তে পড়তে প্রায় শেষ পর্যন্ত চলে এসেছেন; এবার তাহলে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি? আজকে কোনো মশার কামড় খেয়েছেন? বা এই সপ্তাহে? আমার বিশ্বাস, কোনো কোনো পাঠক অনেকটা চেঁচিয়েই উঠবেন এত স্পষ্ট বিষয়টি জিজ্ঞাসা করার জন্য। আমাদের প্রায় সবার জীবনে তো মশা নিত্যদিনের সঙ্গী। এমতাবস্থায় যদি আপনাকে বলি, এমন এক স্থান আছে যেখানে কোনো মশা নেই, তাহলে সেই স্থানকে আপনি কী বলবেন? স্বপ্নের দেশ?
বলছি, আইসল্যান্ডের কথাই। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মশার উপদ্রব থাকলেও এই দেশে দেখা মিলবে না কোনো মশার। মশার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি ছড়ায়। কেননা, এগুলো বিভিন্ন ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। জিকা ভাইরাস বহনকারী মশার জন্য বিশ্বজুড়ে যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা সবারই জানা। এখন কথা হলো, কেন এই দেশে মশা নেই।
এর একটি কারণই বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পেরেছেন। তা হলো আইসল্যান্ডে খুব জলদি আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে মশা তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে না, যার দরুন মশার বংশবৃদ্ধি বা তাদের বেঁচে থাকা সেখানে সম্ভব হয় না।
৫.বিশ্বের চতুর্থ সুখী দেশ
গত বছরের তুলনায় এক ধাপ পিছিয়ে গেলেও এখনও আইসল্যান্ড বিশ্বের শীর্ষ ৫টি সুখী দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। চতুর্থ অবস্থানে থাকা আইসল্যান্ড যেসকল ইতিবাচক দিকগুলোর জন্য এই অবস্থান অর্জন করেছে সেগুলোর মধ্যে আছে- তুলনামূলক কম আয়কর, বিনামূল্যে শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি। মূলত কোনো দেশের নাগরিকদের মধ্যে ৬টি নির্দেশকের উপস্থিতির ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরী হয়। যেমন- মাথাপিছু জিডিপি, সুস্থভাবে জীবনযাপনের আয়ুষ্কাল, সামাজিক সহায়তা, বিশ্বাস, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া বা স্বাধীনতা এবং উদারতা।
এছাড়াও আরও অনেক কারণ রয়েছে যার জন্য আইসল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ হতে পেরেছে। তাদের কাছ থেকে যদি অল্প কিছুও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তাহলে হয়তো বাংলাদেশও ‘বিশ্ব শান্তি সূচক’ এর ১৬৩টি দেশকে নিয়ে তৈরি তালিকার ৯৩ তম অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সম্মুখ দিকে এগিয়ে আসতে পারবে। এই দেশ সারা বিশ্বের জন্য শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের বিভিন্ন পদ্ধতি আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
ফিচার ইমেজ: bookmundi.com