Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাতৃপ্রধান সমাজ: নারীরা যেখানে শাসন করে পুরুষদের

কালের পরিক্রমায় ২০১৮ সালের অত্যাধুনিক পৃথিবীতে অনেক নিয়ম নীতিই বদলে গেছে, হাজারো নীতি হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। তবে একটি ব্যাপার মোটামুটি একই রয়ে গেছে, তা হলো পুরুষতন্ত্রের প্রতি নারীদের বিদ্বেষ। সবার মনে একটি পাকাপাকি ধারণা এই যে, যুগ যুগ ধরে পুরুষেরা শাসন করে আসছে সমাজ ও দেশকে, নারীদের চিরকাল থাকতে হয়েছে পুরুষের ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কেউ কি জানেন যে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গেলেই সমাজের ব্যবস্থার পুরোপুরি উল্টো একটি চিত্র দেখা যাবে অনেক জায়গাতেই?

শুধু অতীতে নয়, বর্তমানেই সারা পৃথিবীতে অনেক জায়গায় সমাজের শাসনব্যবস্থার হাল ধরেছে নারীরা, আর ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ গৃহস্থালির কাজকর্মও করছে পুরুষেরা। তাদের মাঝে বেশিরভাগই উপজাতি বা আদিবাসী সমাজ। আজ জেনে নেওয়া যাক সেরকমই কিছু নারীপ্রধান সমাজের কথা। 

খাসিয়া জনগোষ্ঠী

সবার শুরুতেই দেখে নেওয়া যাক, নিজ দেশের মাতৃপ্রধান একটি সমাজের চিত্র। স্কুলের পাঠ্যবইতে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নাম কম-বেশি সবারই পড়া আছে। এর মাঝে একটি হলো খাসিয়া। অনেকেই হয়তো জানেন না, খাসিয়া সমাজে চলে নারীতন্ত্র। অর্থাৎ নারীরাই এখানে সমাজপ্রধান। 

খাসিয়া জনগোষ্ঠী; Image source: The Wire

বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল জুড়ে খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। তবে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যেও দেখা মেলে তাদের। প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে তারা এদেশে এসেছিল আসাম থেকে। আর আসামে তারা এসেছিল খুব সম্ভবত তিব্বত থেকে, তবে সময়কাল এখনও অজানা।

খাসিয়ারা বিশ্বাস করে, নারীদের হাত ধরেই মানসভ্যতার সূচনা ঘটেছে। আর তাই জন্মলগ্ন থেকে তারা এখনও পর্যন্ত মাতৃতন্ত্র ধরে রেখেছে নিজেদের সমাজে। নারীরা পছন্দমতো অন্য গোত্রের পুরুষ বিয়ে করতে পারে, স্বামীকে বাকি জীবন স্ত্রীর বাড়িতে কাটাতে হয়। বিয়ের ব্যাপারটাতে মেয়েরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নিজের পছন্দের ছেলেকে তারা বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আনে, মাঝে মাঝে একসঙ্গে কিছুদিন কাটায়। পরবর্তীতে নিজ নিজ অভিভাবকের মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে।

খাসিয়াদের বিয়ের অনুষ্ঠান; Image source: Raiot

তবে ভিন্ন গোত্র ব্যতীত নিজ গোত্রে বিয়ে খাসিয়া সমাজে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরূপ কাজ কেউ করলে তাদের মারাত্মক শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। ছেলে-মেয়ে দুজনকেই গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়, হারায় সম্পত্তির অধিকার। এছাড়া মৃত্যুর পর তাদের সৎকার করা হয় না।

খাসিয়া স্বামী-স্ত্রী নিজেদের সুন্দর বোঝাপড়ার মাধ্যমে মিলেমিশে কৃষি ও সংসারের কাজ করে। নারীদের সবাই সমীহ করে চলে, সংসারে নারীরাই প্রধান। খাসিয়া শিশুরা তাদের মাতৃনামেই পরিচিত হয়। সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা এই সমাজে নারীদের হাত দিয়ে হয়ে থাকে। মালিকানা সচরাচর সবচাইতে ছোট কন্যার ওপর অর্পিত হয়, তবে অন্য বোনেরাও তার ভাগ পেতে পারে। খাসিয়া সমাজে বহুবিবাহের রীতি নেই। তবে নারীরা একের অধিক বিয়ে করার অধিকার রাখে, যা কি না পুরুষদের ক্ষেত্রে একটি বিরল ঘটনা।

ভারতের মেঘালয়ের একটি খাসিয়া পরিবার; Image source: Firstpost

নারীপ্রধান হলেও খাসিয়া সমাজে পুরুষদের অধিকার রক্ষিত হয়। পুরুষরা কোনো অনাচারের শিকার হয় না, তাদের সামাজিকভাবে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয় না। এছাড়া যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে খাসিয়াদের মাতৃতন্ত্র খানিকটা শিথিল হয়ে এসেছে।

মসুও গোত্র

এমন একটি রাজ্যের কথা চিন্তা করুন, যেখানে বিয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। নারীরাই সেখানে সর্বেসর্বা। যে রাজ্যে কি না পরিবারপ্রধান একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী, তার রক্তের প্রবাহই নির্ধারণ করে পরবর্তী পরিবারপ্রধান কে হবে। কী? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? তাহলে একটু নড়েচড়ে বসুন।

মসুও গোত্র; Image source: clera elliott

সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালার আড়ালে, বিস্তৃত লুগা লেকের ধারে বাস করে হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ছোট্ট এক জাতি। তারা পরিচিত মসুয়া নামে, তবে নিজেদের ‘না’ নামেও পরিচয় দেয় তারা। চীন আর তিব্বতের সীমারেখার একেবারে কাছাকাছি বসবাসরত এই গোত্রটি পৃথিবীতে রয়ে যাওয়া একমাত্র শুদ্ধতম মাতৃতান্ত্রিক জাতি।

শুদ্ধতম মাতৃতান্ত্রিক বলার অনেক বড় কারণ রয়েছে এই জাতির। তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, মসুয়াদের মাঝে বিয়ের রীতি নেই। বরং আছে একটি অদ্ভুত রীতি, যাকে বলা হয় ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’। এর মানে হলো নারী-পুরুষ চাইলেই কিছু সময় পর পর নিজেদের সঙ্গী পরিবর্তন করতে পারে। দুজনের মাঝে এই মিলনের ফলে দুটো পরিবার কখনোই এক হয় না। মেয়েরা তার পরিবারের সাথেই থাকে, ছেলেরা থাকে তার নিজের মায়ের পরিবারের সাথে। কেবলমাত্র একটা নির্দিষ্ট সময়ে দুজন মিলিত হয়।

মসুও গোত্রের একটি অনুষ্ঠান; Image source: Uno sguardo al femminile

পারিবারিক সব কাজ নারীরা সম্পন্ন করে। জীবিকা অর্জন থেকে শুরু করে বাজার সদাই, ঘরের কাজ, ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলা- এই সবই নারীরা করে থাকে। পুরুষেরা সত্যিকার অর্থে সন্তান উৎপাদনে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। যৌনতার স্বাধীনতা থাকায় দুজন নারী-পুরুষের মিলনের পেছনে কেবলই ভালবাসা, দুজনের সঙ্গ এবং ক্ষেত্রবিশেষে সামাজিক মর্যাদাও কাজ করে। বিবাহ বিচ্ছেদের অস্তিত্ব নেই, যেহেতু বিয়েই হয় না এখানে। আর সঙ্গী বদলানোর পর সন্তান নিয়ে ঝামেলা হয় না, সন্তান-সন্ততিরা সবসময়েই মায়ের কাছেই থাকে।

সকল সম্পদের মালিক পরিবারের নারীরা হয়। এক নারী থেকে আরেক নারীতে ক্ষমতার চাবি হস্তান্তরিত হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যদি কারো মেয়ে না হয়ে সব ছেলে হয় সেক্ষেত্রে তারা কী করে? খুব সোজা ব্যাপার, এ ধরনের নারীরা অন্য পরিবার কিংবা নিজ পরিবারের ছোট ছোট মেয়েদের দত্তক নেয়। পালিতা মেয়েকে বড় করে তাদের হাতেই সবকিছুর ভার অর্পণ করে।

এই এলাকার অন্যতম আকর্ষণ হলো এটি একটি পর্যটনস্থল। তাই প্রতি বছর পর্যটকের অভাব হয় না মসুওদের এলাকায়। এখানে যারা বেড়াতে গেছেন, তারা একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন। আর তা হলো মসুও নারীদের শারীরিক গঠন এবং কর্মক্ষমতা পুরুষদের চাইতে অনেক বেশি উন্নত। অর্থাৎ, মসুও নারীরা পুরুষদের চাইতে বেশি শক্তিশালী। এর কারণ হিসেবে তারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বহু বছর ধরে শক্ত কাজকর্ম না করে করে পুরুষদের শারীরিক কর্মক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবে কমে গেছে বলে মনে করা হয়। 

একজন মসুও নারী; Image source: Mrie Claire

আধুনিক মসুও পুরুষেরা কট্টর নারীতন্ত্র থেকে অবশ্য খানিকটা হলেও সরে আসতে পেরেছে। কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতি খানিকটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তাদের, এমনকি তারা বিয়ের ব্যাপারেও বেশ আগ্রহী হচ্ছে।

মিনাংকাবাউ

ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম সমাজের মাঝে সারা পৃথিবীর আড়ালে থেকে যাওয়া একটা গোত্রের নাম মিনাংকাবাউ। পশ্চিম সুমাত্রায় আবাস গড়ে তোলা সুশৃঙ্খল সভ্য এই সমাজটি অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। এ সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও এখানে পুরুষদের চেয়ে নারীরা প্রাধান্য পেয়ে থাকে বেশি।

মিনাংকাবাউ গোত্রে আদিবাসী আইন মেনে সকল সম্পদের অধিকার মা থেকে মেয়ের ওপর বর্তায়। পরিবারে মাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করা হয়, আর ছেলেরা পরিবারে পায় সাধারণ সদস্যের মর্যাদা। মোটামুটি কৈশোরে পদার্পণ করার পর ছেলেরা জাগতিক বিষয়ে শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ এবং ভাগ্য নির্ধারণের জন্য নিজের বাড়ি ত্যাগ করে। সবাই থাকা ও ঘুমানোর জন্যে প্রাথমিকভাবে স্থানীয় মসজিদ ব্যবহার করে। এটি একটি খুব সাধারণ প্রথা, যার নাম ‘রানতাউ’।

মিনাংকাবাউ গোত্রের নারী; Image source: mm.studies.com

এ গোত্রের লোকজন ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও তারা আধুনিকতার সাথে ধর্মের একটি সংমিশ্রণ মেনে চলে। যেমন, মিনাংকাবাউ নারীদের জন্যে হিজাব বা মাথার কাপড় বাধ্যতামূলক নয়। কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় হিজাব পরে, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। বিয়ের আগে নারীর কুমারীত্ব সবাই আশা করে, তবে কুমারী থাকা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এখানে হালের ’ডেটিং’, অর্থাৎ প্রেমের সম্পর্ক কিংবা বিয়ের আগেই একসাথে সময় কাটানো খুবই স্বাভাবিক একটি সংস্কৃতি- যা কি না সাধারণ একটি মুসলিম সমাজে কল্পনাতীত।

মিনাংকাবাউ পরিবারের মায়েরা আশা করেন, তাদের মেয়েরা সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার ভিত্তিতে নিজেদের স্বামীকে পছন্দ করে নেবে। বিয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নারীরা আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী বিধায় এখানে বিবাহবিচ্ছেদ খুব অহরহ ঘটছে বলে পর্যটক ও বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে থাকেন।

তবে এ ব্যাপারগুলোতে মিনাংকাবাউ নারীদের রয়েছে ভিন্ন মত। তারা মনে করে, স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে নারী ও পুরুষ সবাই সমান। কেউ কারো ঊর্ধ্বে নয়, আর তাই গোত্রপ্রধান হিসেবে নির্ধারণ করা হয় একজন পুরুষকেই- যদিও তা বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের পছন্দেই হয়ে থাকে।

মিনাংকাবাউদের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি; Image source: wikifresh

মিনাংকাবাউ গোত্রটি নিজেদের তাল মিলিয়ে চলা সংস্কৃতির মাধ্যমে সমস্ত বিশ্বে জাগিয়েছে আলোড়ন। বিশেষ করে নিজেদের ধর্ম আর সামাজিক প্রথার সংমিশ্রণ বিভিন্ন দেশের মানুষের মাঝে নতুন চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে।

এই তিনটি গোত্র ছাড়াও সারা পৃথিবীতে এমন অনেক ছোট ছোট মাতৃতান্ত্রিক সমাজ রয়েছে, যেখানে নারীরা ধরেছে সমাজের হাল। সন্তানেরা মায়ের পরিচয়ে বড় হয়, মায়ের রক্তের পরিচয়টি প্রাধান্য পায় বেশি। বিশেষত আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে সেরের, ওভাম্বো, নুবিয়ান, কুং সান,আ’কান, ব্রি ব্রি, নাগোভভিসি, কম ইত্যাদি গোত্র। এছাড়া বাংলাদেশের গারো ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কিছু কিছু জায়গার নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা সচরাচর মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থার অনুসারী।

ইতিহাসের পাতা উল্টালেও নারীপ্রধান সমাজের উল্লেখ পাওয়া যাবে অহরহ। বিখ্যাত নারীযোদ্ধা জাতি অ্যামাজন, কিংবা দুর্দান্ত রোমান নারীযোদ্ধা সাইটন জাতি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অতীতের ইতিহাসে সাহসী নারীদের দেখানো পথে পা ফেলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। যদিও আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এখন এ সমাজগুলোতে নারীদের দাপট অনেকাংশেই কমেছে, তবুও সেখানে নারীরাই এখনও সর্বেসর্বা তাতে কোনো সন্দেহ নেই!

ফিচার ইমেজ: Fandom.wikia.com

Related Articles