Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্যক্তিগত ডায়েরি প্রকাশ: বর্ণবাদী-জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য লিখেছিলেন আইনস্টাইন!

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কিংবদন্তী বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভ্রমণবিষয়ক ব্যক্তিগত বেশ কিছু ডায়েরি। বিস্ময়করভাবে সেখানে উঠে এসেছে নানা বর্ণবাদী ও জাতি-বিদ্বেষমূলক বক্তব্য। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী উঠেছে আলোচনার ঝড়। সেখানে চীনাদের ‘পরিশ্রমী, নোংরা, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন’ বলে মন্তব্য করেছেন আইনস্টাইন! শুধু চীনারাই নয়, ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯২৩ সালের মার্চ অবধি ভ্রমণ করা বিভিন্ন দেশের লোকেদের নিয়ে তার রয়েছে এমন আরো বিতর্কিত মূল্যায়ন। এ সময়টায় তিনি স্ত্রীর সাথে স্পেন থেকে সিলন (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) হয়ে মিশর, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং তারপর সিঙ্গাপুর থেকে চীন, হংকং হয়ে জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। এ দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে ডায়েরি বা ব্যক্তিগত চিঠির পাতায় অকপটে তিনি কখনো ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপারে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছেন, নতুবা বিতর্কিত সাধারণীকরণ (জেনারেলাইজেশন) করেছেন একটি গোটা জাতিকে ধরে!

দীর্ঘদিনের কর্মস্থল প্রিন্সটনের ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকেই বেরিয়েছে ‘দ্য ট্র্যাভেল ডায়েরিজ অব আলবার্ট আইনস্টাইন’ নামের বইটি, যেখানে সংকলিত হয়েছে উক্ত ভ্রমণকালে আইনস্টাইনের লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরি আর চিঠির পাতা। ডায়েরিসমূহ জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা সহ পুরো বইটি প্রকাশের গুরুদায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি হচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ‘আইনস্টাইন পেপার্স প্রজেক্ট’ এর সহপরিচালক জে’এভ রোজেনক্রাঞ্জ। সংকলন করতে গিয়ে তিনি যখন আইনস্টাইনের বয়ানগুলো পড়ছিলেন, তখন ভাবছিলেন, “কী করে এমন (বর্ণবাদী) মানুষ একজন মানবতাবাদী আইকন হলেন!” আইনস্টাইনকে কেন মানবতাবাদী আইকন মানা হতো, সে আলোচনায় পরে আসছি। তার আগে চলুন দেখে নিই তার ডায়েরির পাতাগুলো।

আইনস্টাইনের ডায়েরি-চিঠির পাতা থেকে; Source: The Independent

চীন সম্পর্কে আইনস্টাইনের পর্যবেক্ষণ-

“ওরা খাওয়ার সময়ে বসে না, কিন্তু গাছ-পাতার ফাঁকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঠিকই ইউরোপিয়ান কায়দায় উবু হয়ে বসে।”… … “এমনকি শিশুদেরও দেখতে নির্জীব, অলস মনে হয়।”

তার দৃষ্টিতে চীনারা ‘একটি আজব দলপ্রেমী’ ও “সাধারণের চেয়ে অধিকতর যান্ত্রিক’ জাতি। তার দাবি, চোখের দেখায় চীনা পুরুষ আর নারীতে তফাৎ নাকি ‘খুবই সামান্য’। বিশ্বের জনসংখ্যার ১৯ ভাগই চীনারা। তাই তাদের ‘উর্বরাশক্তি‘ প্রসঙ্গেও ফোড়ন কাটতে ভোলেননি আইনস্টাইন।

“আমি বুঝি না, চীনা মেয়েরা কী এমন বিধ্বংসী আকর্ষণের ক্ষমতা রাখে যে, তাদের বিমোহিত পুরুষেরা নিজেদের সন্তানলাভের আশীর্বাদধন্য হওয়া ঠেকাতে পারে না!”  

শ্রীলঙ্কার কলম্বো গিয়ে তার মনে হয়েছে সেখানকার মানুষেরা ‘ময়লা’ আর ‘দুর্গন্ধ’র মাঝে বসবাস করে। তার সাফ মূল্যায়ন, “এরা কাজও করে অল্প। এদের চাহিদাও অল্প।”

মিশরের পোর্ট সৈয়দ বন্দরে পৌঁছালেন যখন, তার জাহাজ থেকে নামার তক্তা বিছিয়েছিলেন এক মিশরীয়। আইনস্টাইন তার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, “নোংরা ডাকাত-দর্শন লেভান্টাইন”। উল্লেখ্য, ভূমধ্যসাগরীয় পূর্ব দ্বীপের বাসিন্দাদের লেভান্টাইন বলা হয়। পুরো পোতাশ্রয়ের আবহকে তিনি রূপায়িত করেছেন ‘নরক’ অভিধায়!  

জাপান সম্পর্কে অবশ্য দারুন ইতিবাচক ছিলেন আইনস্টাইন। তার মতে, এত বিশুদ্ধ মনের মানুষ তিনি আর কোথাও দেখেননি। তার ভাষায়, “জাপানিরা আড়ম্বরহীন, নম্র, সব মিলিয়ে খুবই আকর্ষণীয়”। তবে উপসংহারে ঠিকই কিছুটা তীর্যকতা রেখেছেন। তিনি বলেন, “শিল্পগত চাহিদার থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা ওদের কম বলে মনে হলো – প্রাকৃতিক বিষয় কি?”

জাপানে স্ত্রীসমেত আইনস্টাইন; Source: SmithSonian

বিজ্ঞানীরা একটু মুখচোরা হন, সমাজের বিতর্কিত কিছু নিয়ে তারা সাধারণত কথা বলেন না, এটি একটি প্রচলিত ধারণা। এই ধারায় সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম মানা হতো আইনস্টাইনকেই। জার্মানিতে থাকাকালীন তিনি নিজেই ইহুদি-বিদ্বেষের স্বীকার হয়েছিলেন। উগ্র জাতীয়তাবাদ, সমরবাদ ও জাতিবিদ্বেষ নিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের দরুন তিনি চক্ষুশূল হয়েছিলেন নাৎসিদের। দেশান্তরী হয়ে মার্কিন মুলুকে পা রেখে তিনি সামাজিক সমস্যার নতুন চিত্র দেখলেন, কিন্তু নিজেকে বদলাননি। তাই সেখানে গিয়ে বনে গেলেন কৃষ্ণাঙ্গদের রাজনৈতিক অধিকার আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী। যেহেতু ‘সেলেব্রিটি’, কিছু বললে দশজন লোকে শোনে, সেহেতু জনস্বার্থে ব্যক্তি ইমেজ কাজে লাগিয়ে ‘কথা বলা’কেই নিজের গুরুদায়িত্ব ভাবলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আইনস্টাইন বললেন-

“এদেশে সাদা আর কালো মানুষে বিভাজন টানা হয়েছে। এই বিভাজন কালো লোকেদের সমস্যা নয়। এটা হলো শ্বেতাঙ্গদের একটা রোগ।”

২০ বছরের বন্ধু মার্কিন অভিনেতা ও আফ্রিকা-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার নেতা পল রবার্টস (সর্বডানে) এর সাথে আইনস্টাইন; সঙ্গে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ওয়ালেস (সর্বডানে); Source: Getty Images

অথচ এই মানুষটিই তিনি, যিনি কিনা ওপরের বর্ণবাদী বেশ কিছু কথা লিখেছেন। ইনি সেই আইনস্টাইন, যাকে ঘিরে চালানো হয়েছে UNHCR এর শরণার্থী সম্পর্কিত নানা ক্যাম্পেইন। তাদের একটি স্লোগান ছিল,

“শরণার্থীরা কেবল একবস্তা জিনিসপাতিই সঙ্গে করে আনে না তার নতুন দেশে। আইনস্টাইনও শরণার্থী ছিলেন।”

শরণার্থীদের প্রতি মূলধারার মানুষের ইতিবাচক ধারণা তৈরি ও বিদ্বেষ হ্রাসের এ প্রচারণায় ‘আইকন’ হয়েছিলেন যে ব্যক্তি, তিনিই কিনা আবার চীনের অধিক জনসংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন-

“ব্যাপারটা দুঃখজনক হবে যদি চীনারা অন্যান্য সব জাতিবর্ণের লোকেদের জায়গা নিয়ে ফেলে!”

তার মানে তিনি গোটা একটি জাতিকে নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে ‘হুমকি’ ভেবেছিলেন! স্পষ্ট জাতিবিদ্বেষ যাকে বলে। এসব পড়ে পাঠক হয়তো ভাবছেন, “কাকে বিশ্বাস করবো তবে?” আপনাদের জন্য বইটির সম্পাদক ও প্রকাশক রোজেনক্রাঞ্জ বলেছেন, যেহেতু প্রকাশের উদ্দেশ্যে ডায়েরিগুলো লেখেননি আইনস্টাইন, তাই ভাবপ্রকাশেও খুব একটা লাগাম তিনি রাখেননি এবং সেগুলোতে বর্ণবাদ-জাতিবিদ্বেষের বাইরে অনেক ভালো কথাও আছে! তো এবার ভাবুন, বিশ্বের সবচেয়ে ঝানু ও সতর্ক কূটনীতিকও কি শোবার ঘরে একা থাকলে পোশাক নিয়ে অতি-সতর্কতা অবলম্বন করেন? যা-ই হোক, আইনস্টাইনের নৈতিক দ্বিচারিতা বিচারের ভার দিনশেষে পাঠকের হাতেই ন্যস্ত রইলো।

Featured Image Source: Gamma-Keystone

Related Articles