হুট করেই গোটা সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড়ের গতিতে সারা ফেলে দেওয়া ‘ফিজেট স্পিনার‘ নিয়ে কমবেশি সবারই কৌতূহলের কমতি নেই। বাচ্চা থেকে শুরু করে সকল বয়সী মানুষ এই ট্রেন্ডিং ফিজেট স্পিনার নিয়ে সমান আগ্রহে মেতে উঠেছে। ২০১৭ সালের প্রথমদিকেও কিন্তু এই ফিজেট স্পিনার নিয়ে তেমন কোনো মাতামাতি চোখে পড়েনি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন যুক্তরাজ্যের একটি স্কুলে ফিজেট স্পিনারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তারপরেই যেন এই ফিজেট স্পিনার নিয়ে মাতামাতি তুঙ্গে চলে আসে। এমনকি গুগল সার্চে ফিজেট স্পিনার কিম কারদাসিয়ান ও ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
কী এই ফিজেট স্পিনার?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কী এই ফিজেট স্পিনার? ফিজেট স্পিনার হচ্ছে প্লাস্টিক ও মেটালের সমন্বয়ে বানানো এবং সহজে বহনযোগ্য ছোট সাইজের একটি ডিভাইস যার মাঝখানে একটি বিয়ারিং থাকে। ধরার জন্য মাঝখানে সেন্ট্রাল বিয়ারিং পয়েন্টের মাঝে গ্রিপ থাকে যেখানে আপনি আপনার দুই আঙ্গুলের মাধ্যমে চাপ দিয়ে ধরে রাখতে পারবেন ।
সহজ কথায় বলতে গেলে, ফিজেট স্পিনার হলো এক প্রকারের খেলনা, যা মানসিক চাপ কমানো, মনঃসংযোগ বাড়ানো বা স্নায়ু শিথিল করার জন্য তৈরি করা। আর এই স্পিনারের মাঝখানে একটি বিয়ারিং বসানো থাকে এবং এই বিয়ারিংটি ধরেই এটি ঘোরানো হয়।
কীভাবে হলো এই ফিজেট স্পিনারের আবিষ্কার?
দুই দশক আগে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ক্যাথেরিন হেটিংগার যখন তার বোনের সাথে দেখা করতে ইসরায়েলে যান, তখন তিনি লক্ষ্য করলেন রাস্তা দিয়ে লোকজন হেঁটে যাওয়ার সময় বাচ্চা ছেলেমেয়েরা তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারছে। তৎক্ষণাৎ হেটিংগার চিন্তা করতে লাগলেন এমন একটি খেলনা দরকার যাতে করে এই বাচ্চাদের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে ফেলা যায়।
হেটিংগারের সাত বছর বয়সী মেয়েটি ম্যাস্টেনিয়া গ্র্যাভিস রোগে আক্রান্ত ছিলো। মেয়েটিকে অসুস্থতা জনিত মানসিক অবসাদ থেকে বের করে আনতে গিয়ে প্রথমবারের মতো সফলভাবে ফিজেট স্পিনারের ডিজাইন করেন হেটিংগার। বলতে গেলে এটাই ছিল তার এই স্পিনার আবিষ্কারের অন্যতম অনুপ্রেরণা।
ফিজেট স্পিনারের ব্যবহার
প্রথম পর্যায়ে ফিজেট স্পিনার অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উদ্বেগ বা স্নায়বিক অস্থিরতা কমানোর খেলনা হিসেবে বাজারে ছাড়া হয়েছিল। অর্থাৎ এটি হাইপারটেন্সিবিলিটি ডিজঅর্ডার ও অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণের সম্ভাব্য খেলনা হিসেবে বাজারে এসেছিল। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সাড়া দেয় না। তাই তাৎক্ষণিক সাড়া পেতে অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে এই স্পিনারের ব্যবহার দেখানো হয়েছিল।
ফিজেট স্পিনারের আধুনিক ব্যবহার
সময়ের সাথে সাথে ফিজেট স্পিনার আজ লাভ করেছে বহুমাত্রিকতা। এর ব্যবহার এখন আর কেবল শারীরিকভাবে অসুস্থদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই।
- এটি সাধারণ যেকোনো মানুষের স্ট্রেস রিলিফ করতে সক্ষম বলে হেটিংগার দাবী করেন।
- কাজের চাপ কমিয়ে মনকে স্থিতিশীল রাখতে ফিজেট স্পিনার ব্যবহৃত হচ্ছে।
- অতিরিক্ত মানসিক অস্থিরতাগ্রস্থ ও বদমেজাজী বাচ্চাদের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও অস্থিরতা কমাতে এটি বেশ কার্যকর।
- অফিসে বসে একটানা একই ধরনের কাজ করতে করতে একঘেয়েমি কমাতে এর জুড়ি নেই।
- অনবরত পা নাচানো বা দাঁত দিয়ে নখ কাটার মতো বদভ্যাস দূর করতেও এটি কার্যকর।
- যাদের চোখে সমস্যা নেই কিন্তু ফোকাসে সমস্যা আছে, তাদের জন্য ফিজেট স্পিনার একাগ্রতা বাড়ানোর বুস্টার হিসেবে কাজ করে।
এগুলো তো গেলো কাজের কথা, কিন্তু বর্তমানে এই ফিজেট স্পিনার কে কত জোরে চালাতে পারে আর কী কী ফিজেট স্পিনারে রূপান্তরিত করা যায়, সেসব নিয়েও মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে। নিত্যদিনের ব্যবহার করা জিনিসপত্র থেকে শুরু করে ঘড়ি, মোবাইল কোনোকিছুই বাদ যাচ্ছে না এই ফিজেট স্পিনার ম্যানিয়া থেকে। এমনকি কার স্পিনার কত জোরে ঘোরে বা কে কোন উপায়ে ফিজেট স্পিনার ঘুরিয়ে দেখাতে পারে সেসব নিয়ে ভিডিও ও টিউটরিয়াল ইউটিউব মাত করে দিয়েছে।
কেন এটি স্কুলে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল?
যেহেতু এই খেলনা চালাতে দুই হাতের ব্যবহার করা অপরিহার্য, তাই শিশুরা ক্লাসে বসে এটি ঘোরাতে গিয়ে ক্লাসে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তো। ক্লাসে মনোযোগের বদলে শিশুরা স্পিনারে মনোযোগ দিতো বেশি। তাই পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও শিশুদের মনোযোগ সরিয়ে নেয়া খেলনা হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষকরা একে স্কুলে নিষিদ্ধ করে দেন। পরে এটি যুক্তরাজ্যের সমস্ত স্কুলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর এই নিষিদ্ধ করার পরই যত পাগলামো শুরু স্পিনার কে ঘিরে।
ফিজেট স্পিনার কি সত্যিই কাজ করে?
অনেকেই মন্তব্য করেছেন ফিজেট স্পিনার কাজের জিনিস ঠিকই যদি সেটা চিকিৎসা ক্ষেত্রে অন্যান্য আরও কার্যকর কোনো মাধ্যমের সাথে সমন্বয় সাধন করে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কেবলমাত্র একটি খেলনা হিসেবে ফিজেট স্পিনার স্ট্রেস বা স্নায়বিক অস্থিরতা কমাতে পারে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা এ কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। ডিউক ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং প্রফেসর স্কট কলিন্স NPR-কে বলেন, “এমন অনেক ধরণের খেলনা মার্কেটে ছাড়া হয় যেগুলো কে ADHD বা অটিজমের জন্য কার্যকরী হিসেবে দাবী করা হয়, কিন্তু এসব খেলনা আদৌও সেই কাজের কিনা সে সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।”
তবে অনেকে আবার এটাও বলেছেন যে, অটিজমে আক্রান্ত রোগীর উদ্বেগ বা অস্থিরতা থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলতে এই ধরণের খেলনা বেশ ভালো অবদান রাখে।
ফিজেট স্পিনার ব্যবহারে সতর্কতা
যেহেতু এই স্পিনার অনেক দ্রুত গতিতে ঘোরে তাই বিপদ আসতে পারে এমন ভাবা খুব অস্বাভাবিক কিছু না। যখন চারিদিকে ফিজেট স্পিনার নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে, তখনই শোনা যায় অস্ট্রেলিয়ান এক ছেলে তার বন্ধুদের ফিজেট স্পিনার ঘোরানর কৌশল দেখাতে গিয়ে বেশ বাজেভাবে চোখে আঘাত পায়। পরবর্তীতে সেই ছেলের মা জানান ‘আমার ছেলে নিতান্তই ভাগ্যবান বলেই চোখটা রক্ষা পেয়েছে গেছে এ যাত্রায়।’ তাছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফিজেট স্পিনার বাজারজাত করা সত্ত্বেও কিছু কিছু ফিজেট স্পিনারে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষতিকর সীসার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে যা আসলেই বিপদজনক।
না ভিডিও গেম, না ট্যাব, এমনকি না খেলনা গাড়ি, সাম্প্রতিক সময়ে পুরো ভাবনার জায়গাটা জুড়ে রয়েছে যেন এই ফিজেট স্পিনার। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে অনলাইনে এই ফিজেট স্পিনার সাময়িক সময়ে সর্বাধিক বিক্রিত হওয়া ১০ খেলনার মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছে। ভালো কী মন্দ সেসব বিচার বিশ্লেষণ বাদ দিলে বলতে হবে- আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই জানতে চান এই স্পিনার কি আসলেই কোনো কাজের জিনিস কিনা, তাহলে হুজুগে গা ভাসিয়ে আপনিও একটি স্পিনার কিনে পরখ করেই দেখুন না!