Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাজের চাপে মৃত্যু: জাপানের এক অস্বাভাবিক সমস্যা

বিশ্ব দরবারে প্রযুক্তি আর শৃঙ্খলার জন্য পরিচিত দেশ জাপান। অন্যসব দেশের মতো জাপানেরও রয়েছে কিছু সমস্যা। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে অতিরিক্ত কাজের চাপে মৃত্যু। ১৯৭০ সাল থেকে জাপান এই সমস্যায় ভুগছে। এই ধরনের মৃত্যুর জন্য জাপানে আলাদা একটি নাম প্রচলিত আছে, সেটি হচ্ছে ‘কারোশি’, যেটি বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বেশি কাজের চাপে মৃত্যু‘।

সাম্প্রতিক সময়ে কারোশি আবার আলোচনায় এসেছে ৩১ বছর বয়সী সাংবাদিক মিওয়া সাদোর মৃত্যুর পর। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর আগে এক মাসে তার নিয়মিত ডিউটির পাশাপাশি প্রায় ১৫৯ ঘণ্টা বেশি কাজ করেছিলেন। তার মৃত্যুর কারণ বের করতে তদন্ত করার পর, ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে এই সাংবাদিকের মৃত্যুর কারণ কারোশি বলে ঘোষণা করা হয়। তার আগে একটি জাপানিজ এড এজেন্সিতে কর্মরত ২৪ বছর বয়সী মাতসুরি তাকাহাসি তার নিয়মিত অফিস সময়ের বাইরে এক মাসে প্রায় ১০৫ ঘণ্টা বেশি কাজ করেছিলেন। ২০১৫ সালে ক্রিসমাসের দিন তাকাহাসি তার অফিসের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এক মাস পরে ডেন্টসু এড এজেন্সির সিইও নিজস্ব পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

নাওয়ার মা মিছিও নিশিগাকি; Source: bbc.com

মিছিও নিশিগাকি খুব গর্বিত বোধ করেছিলেন, যখন তার একমাত্র সন্তান নাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরপরেই একটি বড় টেলিকম প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছিলেন। নাওয়া কম্পিউটার ভালোবাসতো এবং জাপানের প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে এটি খুবই ভালো চাকরি ছিল। কিন্তু দুই বছর পার হতে না হতেই সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। “সে বলছিল সে খুব ব্যস্ত কিন্তু সে ভালো আছে”– বলছিলেন নাওয়ার মা। কিন্তু তারপর সে আমার বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে আসে এবং কোনোমতেই বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না। তিনি বলেন, “আমার ছেলে বলেছিল,আমাকে কিছুক্ষণ ঘুমাতে দাও, আমি খুব ক্লান্ত, দুঃখিত মা। কিন্তু আমাকে ঘুমাতে দাও।”

পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন, তার ছেলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছিল। সে রাতের একদম শেষ ট্রেন ধরতো এবং মাঝে মাঝে ট্রেন ধরতে না পারলে ডেস্কেই ঘুমিয়ে পড়ত। আবার অনেক সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে পরের দিন ১০টা পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৩৭ ঘণ্টা কাজ করতো। ২ বছর পরে মাত্র ২৭ বছর বয়সে নাওয়ার মৃত্যু হয় এবং তার মৃত্যুর কারণ ‘কারোশি’ বলে ঘোষণা করা হয়।

তাকাসাহির মৃত্যুর পরে ডেন্টসু এড এজেন্সির চেয়ারম্যান তাদাসি পদত্যাগ করেন; Source: Getty Images

কাজের চাপে মৃত্যুর এই সমস্যার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান অবকাঠামোগতভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ১৯৫০ সালের দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরো ইয়োশিদা জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালোর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার উপর ব্যাপক জোর দেন। জাপান সরকারের পক্ষ থেকে বড় বড় জাপানী কোম্পানিগুলোকে তাদের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদেরকে আজীবন চাকরির গ্যারান্টি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং বিনিময়ে কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা চালানোর আনুগত্য প্রকাশ করে। জাপানের এই নীতি কাজ করেছিল। শিগেরো ইয়োশিদার ৬৫ বছর আগে করা এই নীতির উপর ভর করে জাপান আজ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়েছে।

তারা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে; Source: tokyotimes.com

কথায় আছে, সাফল্য পেতে হলে ত্যাগ করতে হয়। জাপানের ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তা-ই। ইয়োশোদার এই নতুন নীতি প্রণয়নের ১০ বছর পেরোতেই দেখা গেল, জাপানের অনেক লোক অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং ঘুমের অভাবে আত্মহত্যা করছে। তাছাড়া অনেকে আবার স্ট্রোক সহ নানাবিধ হৃদরোগে ভুগতে থাকে। কারোশি নিয়ে গবেষণা করেছে এমন লোকদের মতে, প্রথমদিকে এটিকে ‘পেশাগত আকস্মিক মৃত্যু’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। কর্মচারীরা নিজেদের বসকে খুশি করার জন্য নিজেদের শারীরিক সক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেত, সেখান থেকেই এই সমস্যার উৎপত্তি। অনেক যুগ পেরিয়ে গেলেও বর্তমান সময়েও জাপানের কাজ এবং জীবনের যে ভারসাম্য, সেটির খুব একটা উন্নতি হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়েছিল; Source: ibiblio.org

২০১৬ সালে কারোশি এবং এর সাথে সম্পর্কিত মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি দল ১০,০০০ জাপানীর উপর জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, এদের মাঝে ২০% কর্মজীবী প্রতি মাসে কমপক্ষে ৮০ ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করেছে। অর্ধেকেরও বেশি কর্মজীবী জানিয়েছে, তারা অফিস থেকে বরাদ্দ করা ছুটিগুলো নেয় না।

শুরুর দিকে জাপানী পুরুষরা এই সমস্যায় ভুগলেও, পরবর্তীতে নারীরাও বাদ যায়নি। মৃত্যুর আগে নারী সাংবাদিক মিওয়া সাদো টুইটারে টুইট করেন,

“এখন ভোর ৪টা বাজে, আমার শরীর কাঁপছে। আমি খুব তাড়াতাড়িই মৃত্যুবরণ করবো, আমি খুব ক্লান্ত।”

তারা অফিস থেকে বরাদ্দ করা ছুটিগুলোও নেয় না; Source: alamy

জাপানে এটি খুব সাধারণ যে, তরুণ কর্মীরা বেশি ঘণ্টা কাজ করবে। বসের মন জয় করার জন্য তারা অফিসে আসেও আগে এবং যায় সবার শেষে, বেশিরভাগ সময়েই মধ্যরাতে। তাড়াতাড়ি পদোন্নতি পাওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। ৩১ বছর বয়সী সেলসম্যান তাকেহিরো অনুকি জানায়, সে প্রায়শই সকাল ৮টায় সবার আগে অফিসে আসে এবং মধ্যরাতে অফিস ত্যাগ করে। সপ্তাহে একবার করে সে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করে। তাকেহিরোর মতো অবস্থা জাপানের বেশিরভাগ হোয়াইট কলার চাকরি করে এমন কর্মজীবীদের। হাড়ভাঙা খাটুনীর পরেই আসে পদোন্নতি। আবার বেশিরভাগ সময়েই অনেক বেশি খাটুনি হলেও তারা চাকরি ছেড়ে যায় না। কারণ, নতুন করে শুরু করতে হলে আবার প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে এবং বেশিরভাগ সময়েই তারা মনমতো উপযুক্ত চাকরি পায় না।

উন্নত দেশগুলোর মাঝে জাপানের কর্মঘন্টা সবচেয়ে বেশি; Source: theculturetrip.com

এই সমস্যার সমাধান কোথায় ?

কারোশির হাত থেকে মুক্তি পেতে সাম্প্রতিক সময়ে জাপান সরকার এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। ২০১৬ সালে সর্বশেষ তাকোশি আত্মহত্যার পর জাপান সরকার ‘প্রিমিয়াম ফ্রাইডে’ নামে একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার যেকোনো চাকুরীজীবী চাইলে বিকেল ৩টার মধ্যে কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে। আট মাস পেরিয়ে গেলেও জাপান সরকার এই পদক্ষেপের দরুন খুব একটা সাফল্যের দেখা পায়নি। জাপানী প্রতিষ্ঠানগুলো মাসের শেষ শুক্রবারে তাদের ফাইনান্সিয়াল রিপোর্ট তৈরি করে এবং সেলস টার্গেট পূরণ করতে চায়। কর্মঘণ্টা কম মানে আগের চেয়ে আরও বেশি কর্ম ব্যস্ততা।

“ভোক্তা খরচ বৃদ্ধি এবং দরকারি কাজ এবং জীবনযাপনের সামঞ্জস্যতা আনতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত শুনবো এবং দরকার হলে নীতিতে পরিবর্তন আনবো।”

জাপান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন জাপানের রাজনীতিবিদ এবং কারোশি হ্রাস প্রতিরোধ ক্যাম্পেইনের প্রধান হিরোশি সেকো।

অনেক জাপানী কোম্পানি নিজস্বভাবে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কারোশি হ্রাস করার উদ্দেশ্যে। যেমন- কিছু প্রতিষ্ঠান যেসব কর্মী সকালে আগে আগে আসে, তাদের জন্য সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে আবার বেশি কাজ না করার জন্য প্ররোচনা দেওয়া হয়। জাপান বিষয়ক অভিজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে। যা-ই হোক, তারা বিশ্বাস করে যে, জাপানের সত্যিকারের সমস্যাটি তাদের লিঙ্গীয় ভূমিকার দৃষ্টিভঙ্গি ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক সায়েন্সের অধ্যাপক ফ্রান্সিস রোসেনবাথের মতে, বেশি করে নারী কর্মী নিয়োগ দিলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ট্যাক্স কম দিতে হবে, এরকম পদক্ষেপ নিয়ে কর্মঘণ্টা কমানো যাবে। এতে করে শ্রমবাজার অনেক বড় হবে। তিনি আরও যোগ করেন, এটি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। যখন সামাজিক সমস্যা আর প্রতিষ্ঠানের সমস্যা এক নয় এবং উভয় দল একসাথে কাজ করে না, তখন পরিবর্তন নিয়ে আসা কষ্টসাধ্য।

ফিচার ফটো- accidentalfactory.com

Related Articles