১
ইরাকের মসুলে নিজেদের খেলাফত ঘোষণা করেছিলো চরমপন্থী সংগঠন ইসলামিক স্টেট। দীর্ঘ প্রায় ন’মাস ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর এ বছরের ৯ জুলাই তাদেরকে সেখান থেকে হঠাতে সক্ষম হয় ইরাকি বাহিনী। টিভির সামনে বসে এ সংক্রান্ত খবরগুলো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলো মসুল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে থাকা জানাব ইসমাইল। আর ফেলবেই না কেন বলুন? ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট সকালে যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ শহরে আইসিস বাহিনীর প্রবেশের কথা, তখনই সপরিবারে তাদেরকে নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালান তার বাবা মোহাম্মদ।
ইরাকি বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ততা আছে এমন পরিবারগুলোর সাথে আইসিসের সদস্যরা কেমন আচরণ করছে, তা তাদের অজানা ছিলো না। বিশেষত নারীদের ধর্ষণ ও জোর করে বিয়ে করার খবরগুলো তাদের আরো বেশি মাত্রায় শঙ্কিত করে তুলেছিলো। কারণ মোহাম্মদের মেয়ে জানাবের বয়স তখন ছিলো ১৭। ওদিকে তাদের ২৬ বছর বয়সী ছেলে ইসমাইল কাজ করছিলো ইরাকি পুলিশ বাহিনীতে। ফলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচাতে শিক্ষক ও প্রোপার্টি ডেভেলপার বাবা আর অন্য কোনো উপায় খুঁজে পান নি।
বাগদাদ থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইরবিলের বাহার্কা ক্যাম্পে আসার সময় তারা ভেবেছিলেন, হয়তো মাসখানেকের মাঝেই তারা আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু নিয়তির লিখনে পাঁচ ভাইবোন ও বাবা-মাকে নিয়ে সেখানেই কেটে যায় জানাবের জীবনের মূল্যবান ৩টি বছর। মোহাম্মদ পেছনে ফেলে এসেছিলেন ৪টি সুদৃশ্য বাড়ি; একটিতে থাকতেন তারা নিজেরা, অন্য তিনটি ভাড়া দেয়া ছিলো। বাড়ির সামনে বাগান ছিলো, গরমে প্রশান্তি পেতে ছিলো ইনডোর সুইমিংপুলের ব্যবস্থা। ছুটির দিনগুলোতে জানাবের মা মাক্বলুবা (চাল, ভেড়ার মাংস ও টমেটো দিয়ে বানানো) এবং দোলমা (বেগুন কিংবা কুমড়ার ভেতর চাল ও গরুর মাংস পুরে বানানো) বানাতেন। বাড়ির পরিবেশ সরগরম হয়ে উঠতো পাড়াপ্রতিবেশীদের আড্ডা আর হাসিঠাট্টায়। কিশোরী জানাবের পরীক্ষারও আর বেশিদিন বাকি ছিলো না। বুকভরা স্বপ্ন ছিলো তার; বড় হয়ে ডাক্তার হবে, অকাতরে করে যাবে মানবসেবা।
কিন্তু আইসিসের আগমনে সবই ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে। একটি গুদামে আরো প্রায় দুশজনের সাথে একত্রে বাস করছে তারা। ত্রিপল দিয়ে ঘেরা ২০ ফুট X ৮ ফুট এক জায়গায় থাকছে জানাবের পুরো পরিবার। আশেপাশের পরিবেশও বেশ অস্বাস্থ্যকর। টয়লেট বাসস্থান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে! গত দেড় বছর ধরে কাছেরই এক ক্যাম্পের স্কুলে মাসে ২০০$ পারিশ্রমিকে পড়াচ্ছেন জানাবের বাবা মোহাম্মদ। এ দিয়েই চলছে তার পুরো পরিবার। গত নভেম্বর থেকে আবারো পড়ালেখা শুরু করেছে জানাব। তারপরও কি সবকিছু আর আগের মতো হতে পারবে? মাঝখানে যে ঝরে গেছে জীবনের মূল্যবান ৩টি বছর।
এখন তারা মসুলে ফিরে যাবে। তারপরও শহরে নিজেদের সেই বাড়িতে না, কারণ অনেক আগেই সেটা আইসিসের এক কমান্ডার নিজের দখলে নিয়ে ধ্বংস করে গেছেন। তারা উঠবে মসুলের ১৩ কিলোমিটার পূর্বে বার্তেল্লা উপশহরে।
হয়তো জানাবের বাবা আবারো চাকরি খুঁজে নেবেন, হয়তো জানাবও আবার পড়ালেখা শুরু করবে। কিন্তু এতদিনের নির্মম যুদ্ধমাখা বাস্তবতা দেখে মেয়েটা কি পারবে আবারও তার সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে?
২
এককালে ইরাকে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার ছিলো বেশ আশাব্যাঞ্জক। ২০১৩ সালে ইউনিসেফের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশটিতে তখন শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর হার ছিলো শতকরা ৮২ ভাগ! শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলগুলোতে সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি ছিলো না। শহরাঞ্চলের অর্ধেকের বেশি ছেলে-মেয়ে সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করতো। তাদের অনেকেরই স্বপ্ন ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিখ্যাত মসুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবার, যেখানে তখন প্রায় ৩২,০০০ শিক্ষার্থী ও ৪,২০০ জন ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন।
আজ সেই ক্যাম্পাস দেখে চেনার উপায় নেই। জায়গায় জায়গায় নানা ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে আইসিসের কৃতকর্মের সাক্ষী হয়ে। টানা ৩২ মাসের দখলে তারা আস্তে আস্তে ক্যাম্পাস বন্ধ করার আয়োজন করে। শুরুতে শিক্ষকদের তারা বাধ্য করতো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে। কেউ আসতে অস্বীকৃতি জানালে তারা তাকে শিরশ্ছেদ কিংবা গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতো। আস্তে আস্তে রাজনীতি ও দর্শনশাস্ত্রের মতো কোর্সগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে নিজেদের স্বার্থেই মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি ও ফার্মেসি বিভাগগুলো চালু রেখেছিলো তারা। ২০১৫ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলো আইসিস ব্যবহার করতে শুরু করে বিভিন্ন রাসায়নিক বোম ও সুইসাইড ভেস্ট তৈরির উদ্দেশ্যে। যদি কোনো নারী মেডিসিনে কোর্স না নিতো, তাহলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেও বাধা দেয়া হতো।
গত জানুয়ারিতে মসুল বিশ্ববিদ্যালয় আইসিসের দখলমুক্ত হয়। কিন্তু এজন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে এর অবকাঠামোগুলোকে। হাওউইট্সার, মর্টার, দূরপাল্লার নানা ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য বিষ্ফোরক তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ক্যাম্পাসের সর্বত্র। যাওয়ার আগে আইসিস পুড়িয়ে দিয়েছে নানা ভবন, যার মাঝে আছে ঐতিহাসিক এক লাইব্রেরীও। সেখানে প্রায় দশ লক্ষাধিক বই ছিলো, ছিলো নবম শতকের একটি কোরআন শরীফও।
৩
এককালে মসুলে আনুমানিক ১৪ লক্ষ মানুষ বসবাস করতো। নদীনালা, গাছপালা, বাজারঘাট, মসুল বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিশ্বের বেশ কিছু পুরাতন মসজিদ ও গির্জার উপস্থিতি শহরটিকে প্রাণবন্ত করে রাখতো সবসময়। কিন্তু আজ সেসব কেবলই পত্রপত্রিকার পাতা কিংবা ইউটিউবের ভিডিওতে খুঁজে পাওয়া যাবে। কেননা পুরো মসুল শহর আজ ধ্বংসস্তূপে পরিপূর্ণ। এককালে যে শহরটিতে প্রাণের স্পন্দন ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো, আজ সেখানে কেবলই ধ্বংসের হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে।
ধারণা করা হয়ে থাকে, আইসিসের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আনুমানিক ৯,২০,০০০ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এ বছরের ২৭ জুন পর্যন্ত মাত্র ২ লাখের মতো মানুষ তাদের বাড়িতে ফেরত এসেছে। শহরটি নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। তবে এটিও বেশ ব্যয়সাপেক্ষ একটি কাজ। কারণ জাতিসংঘের হিসেবমতে শহরটি গড়ে তুলতে কম করে হলেও ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থের প্রয়োজন। কারো কারো মতে, এই পরিমাণ অর্থও আসলে যথেষ্ট হবে না। আর ধ্বংস যে কেবল শহরের বিভিন্ন অবকাঠামোতে হয়েছে, সেটা বললে হবে না, ধ্বংস সংঘটিত হয়েছে এ শহরের অধিবাসীদের মনস্তাত্ত্বিক জগতেও।
যুদ্ধবিগ্রহ দেখতে দেখতেই বড় হয়েছে ইরাকের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। তাদের মানসিকতার উপর এর প্রভাবকে অস্বীকার কোনো উপায় নেই। ওদিকে দেশটির বর্তমান জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা। ২০১৪ সালে প্রাপ্ত হিসেবমতে, দেশটির জনসংখ্যার ৬১% এর বয়সই ২৪ বছরের নিচে, ২০% এর বয়স ১৫-২০ এর ভেতরে। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করে যাওয়া দাতব্য সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক মৈত্রীসংঘ অক্সফাম (Oxfam – Oxford Committee for Famine Relief) অপেক্ষাকৃত এ তরুণ সমাজ নিয়েই তাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। ECHO এর সহযোগিতায় তারা মসুল থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে আবার সেখানে ফিরে আসা তরুণদের নিয়ে বেশ ভালো রকমের গবেষণা চালিয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জেনে ইরাকের সামনের দিনগুলোতে তা কেমন প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা, স্থিতিশীল সমাজ বিনির্মাণের নানা নিয়মনীতি সম্পর্কে তাদের জানানো এবং একটি টেকসই যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান।
এ বিষয়ে জানার জন্য তারা মসুলের ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ক্বায়ারাহ উপজেলার ৩৫ জনের ইন্টারভিউ নিয়েছিলো, যাদের ৩০ জন তরুণ প্রজন্মের এবং ৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক। মসুল আইসিসের অধিকারে যাওয়ার আগে, থাকাকালীন সময়ে এবং দখলমুক্তির পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে এই ৩৫ জনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই তারা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
মসুল আইসিসের দখলে যাবার আগে সেখানকার তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি
- বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে সম্পর্ক এবং সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ়, স্থিতিশীল এবং বহুমাত্রিক।
- শিক্ষার সুযোগ, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং চাকরির নিশ্চয়তার কারণে জীবনটা ছিলো বেশ চমৎকার। ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে দারিদ্র, বেকারত্ব, দূর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত বৃদ্ধি পেলেও এমনটাই ছিলো তৎকালে সেখানকার তরুণ সমাজের বিশ্বাস।
- শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক বিভিন্ন প্রয়োজন ও জীবিকার তাগিদে তরুণ-তরুণীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতো।
- শিক্ষার আঙিনা সকলের জন্য ছিলো উন্মুক্ত, ছিলো অবারিত সুযোগ-সুবিধা।
সেখানকার অষ্টাদশী এক তরুণীর ভাষ্যমতে,
“আমাদের একটি স্বাভাবিক জীবন ছিলো। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিলো, কোনো দুশ্চিন্তা ছিলো না। ক্বায়ারাহ ছিলো বসবাসের জন্য নিরাপদ। সবাই দৈনন্দিন কাজকারবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আমাদের বাড়ির গ্যারেজে ছোট একটি দোকান ছিলো। আমার বাবা সেখানে কাজ করতেন এবং তিনি অবসর ভাতাও পেতেন। আমরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলাম এবং আমাদের বাড়তি আর কিছুই লাগতো না। আমি আর আমার দুই ভাই স্কুলে পড়াশোনা করতাম… আমরা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে স্বাধীনভাবে দেখা করতাম।”
মসুল আইসিসের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
- আইসিস সেখানে আসার পরপরই সরকারি বাহিনী সেখান থেকে পালিয়ে যায় বলে জানায় অনেক তরুণ, যা তাদেরকে বিস্মিত না করে পারে নি।
- প্রথম কয়েক মাস মসুলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার উপর তেমন কোনো শর্তারোপ করে নি আইসিস। কিন্তু এরপর থেকেই মুঠোফোনের ব্যবহার, পোশাক পরিচ্ছদ, একাকী চলাফেরা এবং পড়াশোনার ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করে দেয় তারা।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রথম কয়েক মাস তেমন একটা প্রভাব পড়ে নি। পরবর্তী সময়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম বাতিল করায় মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ হয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায় হঠাৎ করে। পাশাপাশি ভীতি প্রদর্শন এবং পরিবর্তিত পাঠ্যপুস্তকও এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
- শিক্ষকদের বেতন হ্রাস করায় আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় অনেক স্কুল। এর ফলশ্রুতিতে সেখানকার শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান দুটি শিক্ষাবর্ষ।
- চলাফেরা এবং বিভিন্ন স্থানীয় দোকান বন্ধ করে দেয়ায় প্রভাব পড়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে।
- অনেক পরিবার পালানোর সময় স্নাইপার কিংবা আইইডি’র কবলে পড়া, আত্মীয়স্বজনের উপর প্রতিশোধ নেয়ার ভয়, মানব প্রতিরক্ষাব্যূহ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থেকে শুরু করে নিজেদের বাড়িঘর ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি হাতছাড়া হবার ভয়ে মসুল ত্যাগ করে নি।
- তরুণ সমাজ ভয়াবহ সব নির্যাতন চোখের সামনে সংঘটিত হতে দেখেছে। এই ইন্টারভিউয়ে অংশ নেয়া ৩৫ জনের প্রত্যেকেই বন্ধু কিংবা পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে হারিয়েছে।
- তরুণদের অনেকেই স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো আইসিসের হাত থেকে দখল হওয়া এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার অভিযানে।
হাজী আলী ক্যাম্পের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণের ভাষ্যমতে,
“আমরা সবসময়ই অনিরাপদ বোধ করতাম, আমাদের কোনো স্বাধীনতা ছিলো না, আইসিসই এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো। আমি এতটাই কষ্টে ছিলাম যে মনে হতো দোজখে আছি। আমি আইসিসকে ভয় পেতাম। আমার পালাতে চাওয়া নেফিউকে তারা হত্যা করেছিলো। অন্য আরো আটজনের সাথে তারা তাকে ধরে ফেলে এবং সবাইকেই হত্যা করে। তার কথা মনে করতে তার নাম আমি হাতে ট্যাটু করে রেখেছি। জায়গাটা একেবারেই নিরাপদ ছিলো না, কিন্তু আমাদের কিছু করারও ছিলো না। প্রতিদিনই মর্টার হামলা হতো আর আমরা ভয় পেতাম। মাঝে মাঝে বিমান হামলা হতো, কিন্তু আমরা জানতাম সেগুলো আইসিস যেন আমাদের ধরতে না পারে সেজন্য (করা হচ্ছে)। একবার ভুল হয়ে যায় এবং বিমান হামলায় আমার গ্রামের ২০ জন মারা যায়। যদি আমি সেদিনটায় ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে আমি সোজা পালিয়ে যেতাম। আমি থাকতাম না, সোজা পালিয়ে যেতাম।”
মসুল মুক্ত হবার পরের জীবন সম্পর্কে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি
- পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে গিয়ে আবারো নতুন করে জীবনটা শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলো অনেকেই।
- আর্থিক ও সামাজিক বিভিন্ন সুযোগসুবিধা নিয়ে অনেকের মাঝেই সংশয় রয়েছে।
- মতপ্রকাশ ও চলাফেরার স্বাধীনতার পাশাপাশি শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ছে। তবে তরুণীদের জন্য বিষয়টি এখনো চ্যালেঞ্জিং।
- ভবিষ্যতে আইসিস আবার মসুলে ফিরে আসবে কিনা আর আসলে তাদের ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রাই বা কেমন হতে পারে তা নিয়ে শঙ্কিত অনেকে।
- জীবন থেকে মূল্যবান দুটি শিক্ষাবর্ষ হারিয়ে যাওয়ায় সবাই হতাশ। আপাতত তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শুরু করে তা সম্পন্ন করা এবং আয়-উপার্জনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ইরাক গড়ে তোলাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
- তরুণীরা সমাজ গঠনে আরো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে চান।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, গত বেশ কয়েকটি বছর ধরে আইসিস অধিকৃত মসুলের তরুণ সমাজ প্রতিদিন যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাত আর নৃশংসতা দেখে এসেছে। এ ব্যাপারগুলো তাদের মানসিকতায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তাদের মনে যুদ্ধ পরবর্তী ভয় আসন গেড়ে বসেছে, যা সামনের দিনগুলোতে তাদের স্বাভাবিক আচার-আচরণে প্রভাব ফেলবে বেশ ভালোভাবেই। পাশাপাশি পড়াশোনায় ক্ষতি তাদের সামনের দিনগুলোতে আয়-উপার্জন নিয়েও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আর সেই সাথে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার দরুন হতাশা তো রয়েছেই। তাই এ ব্যাপারে আশু কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনগুলোতে যে অন্য এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে ইরাককে, তা বোধহয় না বললেও চলে। এরপরও আশার আলো খুঁজে পাওয়া যায় ক্বায়ারাহ-এর এক অষ্টাদশীর বক্তব্যে,
“এখন আমার লোকজনের মুখোমুখি হতে, তাদের সাথে সরাসরি কথা বলার সাহস আছে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমার পরিবর্তন এসেছে, এটা আমাকে বাড়তে সাহায্য করেছে। আমার বয়সে এমন অনেক কিছুই আমি দেখেছি, যা আমার দেখা উচিত নয়…। যেসবের ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি, (তারপর) আমি আর কোনোকিছুই ভয় পাই না, যেকোনো সময়ের চেয়ে (এখন) আমি অনেক শক্তিশালী।”