দরজায় কড়া নাড়ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তিনমাস সময়ও আর বাকি নেই। আগামী ৩ নভেম্বরের নির্বাচনেই নির্ধারিত হবে, কে হচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। এদিনই জানা যাবে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ক্ষমতা আরো চার বছর ধরে রাখতে পারবেন, নাকি আসবেন নতুন কোনো প্রেসিডেন্ট।
ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হচ্ছেন বারাক ওবামার সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা জো বাইডেন। প্রশ্ন ছিল তার রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কে হচ্ছেন, তা নিয়ে। গত ১২ আগস্ট ডেমোক্রেটিক সমর্থকদের ইমেইলে জানিয়ে দেন, ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও বর্তমান সিনেটর কমলা হ্যারিসই হচ্ছেন তার রানিং মেট। টুইটারেও কয়েকটি পোস্টের মাধ্যমে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস তাদের সমর্থকদের জানিয়ে দেন এই সংবাদটি।
কমলা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে এই প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ-এশীয় নারী এ পদে প্রার্থিতার লড়াই করছেন। শ্বেতাঙ্গ নারীও এর আগে কেবল দু’জনই এ পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ওয়াল্টার মন্ডেলের রানিং মেট হিসাবে জেরাল্ডিন ফেরারো এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইনের রানিং মেট হিসাবে সারাহ পোলিন প্রার্থী হন। কিন্তু তারা কেউই নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলে কমলা হ্যারিসই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ডেমোক্রেটিক পার্টিও কারিশম্যাটিক কমলা হ্যারিসকে নিয়ে সে স্বপ্নই দেখছে। জো বাইডেন টুইটার বার্তায় বলেছেন,
কমলা হ্যারিস একজন নির্ভীক যোদ্ধা, যিনি সংখ্যালঘুদের হয়ে লড়াই করেন। একইসাথে তিনি দেশসেরা সরকারি কর্মচারীদের একজন। তাকে আসন্ন নির্বাচনে আমার রানিং মেট হিসাবে ঘোষণা করতে পেরে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি।
কমলা হ্যারিসের প্রশংসা করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। ২০০৪ সাল থেকেই তারা ভালো বন্ধু। ওবামা টুইটারে এক বার্তায় বলেছেন,
আমি সিনেটর কমলা হ্যারিসকে দীর্ঘদিন ধরেই চিনি। তিনি এ দায়িত্বের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত। তিনি পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আমাদের সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে আসছেন। আজ আমাদের দেশের জন্য একটি চমৎকার দিন। এখন চলুন, এই নির্বাচন জয় করে আসি।
কমলা হ্যারিসও প্রার্থী হওয়ার পর বলেছেন,
জো বাইডেন আমেরিকান জনগণদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন। কারণ, তিনি সারাজীবন আমাদের জন্য লড়াই করে আসছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকাকে সে পর্যায়ের নিয়ে যাবেন, যা আমাদের আদর্শের সাথে যায়।
আমাদের পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমি তার সাথে যোগ দিতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। তিনি যেন এ পদে পৌঁছাতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্য সাধ্যমতো সব করব।
কে এই কমলা হ্যারিস?
কমলা হ্যারিসের পুরো নাম কমলা দেবী হ্যারিস। তিনি ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। তার মা শ্যামলা গোপালান ভারতের কেরালার নাগরিক ছিলেন। তিনি একজন ক্যান্সার গবেষক ছিলেন। তার বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস ছিলেন জ্যামাইকান এক অর্থনীতিবিদ।
তারা ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া বা ইউসি বার্কলিতে স্নাতক করার সময় পরিচিত হন। দু’জনেই নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। কমলা যখন ছোট, তখন তারা তাকে নিয়েও আন্দোলনে যেতেন। শৈশব থেকেই কমলা হ্যারিস একটি অভিবাসী পরিবারে বড় হয়ে অধিকার আদায় আন্দোলনের সাথে পরিচিত ছিলেন।
ছোটবেলায় তিনি ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং হিন্দুদের মন্দির- দুই প্রার্থনাস্থলেই যেতেন। পরবর্তী সময় থেকে তিনি অবশ্য নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান নারী হিসাবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। শিক্ষকতা পেশার জন্য তার মায়ের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে এবং ক্যান্সার গবেষক হিসাবে জিউইশ জেনারেল হাসপাতালে চাকরি হওয়ায় কমলা হ্যারিসকে মাধ্যমিক স্কুল জীবনটা মন্ট্রিলে কাটাতে হয়।
পরে তিনি ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বিখ্যাত। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৯০ সালে তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেন আলমেদা কাউন্টিতে সহকারী ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসাবে। এরপর সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির কার্যালয়ে আসেন, সেখানে কাজ করেন কিশোরী যৌনকর্মীদের ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ে।
২০০৩ সালে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির পদে নির্বাচন করেন কমলা। তিনি ৫৬.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসাবে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি নির্বাচিত হন। তার সময়ে তিন বছরের দণ্ডাদেশের সংখ্যা ৫২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশে চলে আসে।
তবে তিনি যে সবসময় সফলভাবেই তার কাজ করে গেছেন, এমন নয়। কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও আছে। ২০০৪ সালে তরুণ পুলিশ অফিসার আইজাক এসপিনোজা কর্তব্যরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশের বিরোধিতা করেন কমলা হ্যারিস। শেষপর্যন্ত ২০০৭ সালে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১০ সালে কমলা হ্যারিস প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসাবে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িওয়ালা পরিবারদের হয়ে ব্যাংকগুলোর বিপক্ষে লড়েন, যারা অন্যায্যভাবে মর্টগেজ নিয়ে নিচ্ছিল। এ মামলায় তিনি জেতেন এবং সেই বাড়িওয়ালাদের জন্য ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেন।
তবে এসময় তিনি মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ আইনের বিরোধিতা করেন। এখানে বিতর্কিত ইস্যুগুলোতে তার অধারাবাহিক অবস্থান দেখা যায়। তাকে রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানী হিসাবেও সমালোচনা করা হয়।
২০১৬ সালে সিনেট নির্বাচনে ঝানু প্রতিদ্বন্দ্বী লরেটা সানচেজকে হারিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর নির্বাচিত হন তিনি। সিনেটর থাকা অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে আলোচনায় এসেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি নভেম্বরের প্রেসিডেন্সি প্রার্থীর জন্যই মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু প্রাইমারিতে সফল হননি।
ব্যক্তিজীবনে তিনি আইনজীবী ডগ অ্যামহফের সাথে ছয় বছর ধরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। অ্যামহফের আগের পক্ষের দুই সন্তানকে নিয়েই তাদের সংসার।
যে কারণে বাইডেন কমলা হ্যারিসকে রানিং মেট নির্বাচন করেছেন
অতীতে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদটি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আল গোর, ডিক চেনি, এমনকি জো বাইডেন নিজেও এ ধারণার পরিবর্তন করেন। ডিক চেনি নাইন ইলিভেন ঘটনার পর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, সিনেটর হিসাবে ছিলেন তুলনামূলক অনভিজ্ঞ। অন্যদিকে তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছিল চার দশকের বেশি সময় রাজনীতির অভিজ্ঞতা। ওবামা তাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাইডেনের পরামর্শ নিতেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখার ভার বাইডেনের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দেন।
কমলা হ্যারিসও সম্ভবত এরকম ভাইস প্রেসিডেন্টই হবেন। বাইডেন নিজেও এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওবামার সময় তিনি যেমন দায়িত্ব পালন করতেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কমলার হাতেও হয়তো অনেক কিছু ছেড়ে দেবেন।
জো বাইডেন আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, রানিং মেট হিসাবে তিনি কোনো নারী প্রার্থীকে বাছাই করবেন। সম্প্রতি মিনেসোটার পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর কারণে যুক্তরাষ্ট্র উত্তাল হয়ে ওঠে। এ ঘটনার কারণে বাইডেন চাপে পড়েন, নারী প্রার্থী হিসেবে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে বাছাই করার। কৃষ্ণাঙ্গ ও নারীদের ভোট নিশ্চিত করার জন্য তার এটি করা প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল। এক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসই ছিলেন আপাত যোগ্য প্রার্থী। তাই প্রেসিডেন্সি প্রার্থিতার সময় তারা তর্কে জড়িয়ে পড়লেও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাচ্ছেন সব ভুলে।
ডেমোক্রেটিক পার্টির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন বাইডেন। ৭৮ বছর বয়সী জো বাইডেন নির্বাচিত হলে সম্ভবত এক মেয়াদের জন্যই থাকবেন। সেক্ষেত্রে ২০২৪ নির্বাচনের জন্য উত্তরসূরী রেখে যাওয়ার জন্যই হয়তো ৫৫ বছর বয়সী কমলা হ্যারিসকে বাছাই করেছেন। হ্যারিসের কারিশম্যাটিক নেতৃত্ব আর ক্যাম্পেইন পরিচালনায় দক্ষতাও ভালো প্রভাব ফেলেছে।
এদিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাইডেনের এ ঘোষণায় অবাক হয়েছেন। তিনি বলেছেন, কমলা হ্যারিসের চেয়ে মাইক পেন্স অনেক যোগ্য লোক। একইসাথে কমলাকে গালাগালিও করেছেন।
কথায় ট্রাম্পের সাথে পারা মুশকিল হলেও কমলা কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন, বিভিন্ন সময়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সেটা। মাইক পেন্সের সাথে বিতর্কে কমলা যে তাকে অনেক বিপদে ফেলবেন, সেটা সহজেই অনুমেয়। সময়ই বলে দেবে, কমলা হ্যারিস হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করতে পারবেন কি না।