Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যামেরুনের অ্যাংলোফোন সংকটে সৃষ্ট নতুন রাষ্ট্র অ্যামবাজোনিয়া

আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী ক্যামেরুন ফুটবলবিশ্বে আফ্রিকা মহাদেশের ‘অদম্য সিংহ’ হিসেবে পরিচিত। দেশটি আফ্রিকা মহাদেশের মধ্য এবং পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত। প্রায় ৪,৬৬,০৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দেশটিতে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস রয়েছে। ১৮৮৪ সালের ৫ জুলাই ক্যামেরুন জার্মানির উপনিবেশে পরিণত হয়, এবং এটি ‘কামেরুন’ নামে পরিচিত ছিল।

বৈশ্বিক মানচিত্রে ক্যামেরুনের অবস্থান; image source: Encyclopædia Britannica

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ক্ষেত্রে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ফ্রান্সের প্যারিসের ভার্সাই রাজপ্রাসাদের মিরর হলে জার্মানি এবং মিত্রপক্ষের ৩২টি দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া এই চুক্তির শর্তগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তির দেশগুলো কর্তৃক যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই চুক্তিতে সর্বমোট ৪৪০টি অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ‘ভার্সাই চুক্তির ১১৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান জার্মানির উপনিবেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার বিধান রাখা হয়। এর ফলে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জার্মানি নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরুন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ক্যামেরুনের অধিকাংশ এলাকা ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে আসে, এবং কিছু অংশে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভার্সাই চুক্তির শর্তানুযায়ী, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জার্মানি নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরুন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল; image source: Wikimedia Commons

১৯৬০ সালের পহেলা জানুয়ারি ফ্রান্সশাসিত ক্যামেরুন স্বাধীনতা অর্জন করে, এবং একে ‘ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুন আবার উত্তর এবং দক্ষিণ এই দুটো অংশে বিভক্ত ছিল। ১৯৬১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের উত্তর এবং দক্ষিণ– এই দুটো অংশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই গণভোটে ব্রিটিশ শাসিত ক্যামেরুন এই দুটো অংশের জন্য ‘ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র’ অথবা প্রতিবেশী রাষ্ট্র নাইজেরিয়া– এই দুটো দেশের মধ্যে যেকোনো একটি দেশের সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। মুসলিম-অধ্যুষিত ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০ শতাংশ জনগণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র নাইজেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, খ্রিস্টান-অধ্যুষিত ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৭০.৫ শতাংশ জনগণ ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেন। গণভোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৬১ সালের পহেলা জুলাই ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুন এর উত্তরাঞ্চল প্রতিবেশী রাষ্ট্র নাইজেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয়। ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের উত্তরাঞ্চল নিয়ে বর্তমানে নাইজেরিয়ার তিনটি প্রদেশ বর্নো, আদামাওয়া এবং তারাবার অংশবিশেষ গঠিত হয়েছে।

অন্যদিকে, গণভোটের পর ১৯৬১ সালের ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ফোমবান শহরে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চল এবং ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত হতে যাওয়া একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। দু’পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ফ্রান্স সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের মতামত প্রধান্য বিস্তার করে, এবং এর ফলে পরবর্তী সময়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ফরাসি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফোমবান শহরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের পর ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চল ১৯৬১ সালের পহেলা অক্টোবর ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়ে একত্রে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র’ গঠন করে।

ভৌগোলিকভাবে, ব্রিটিশশাসিত ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চল নবগঠিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্যামেরুনের পশ্চিমাঞ্চলে এবং ফ্রান্স শাসিত ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র দেশটির পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে ক্যামেরুনের বৃহত্তর পূর্বাঞ্চলে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির একধরনের প্রভাব রয়েছে। ফ্রান্স আফ্রিকা মহাদেশ থেকে উপনিবেশগুলো গুটিয়ে নিলেও সাবেক উপনিবেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ‘ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব’ নামক একটি মতবাদের প্রবর্তন করে। এই মতবাদ অনুযায়ী, বিশেষত আফ্রিকা মহাদেশের যেসব রাষ্ট্রে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে, সেসব রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে ফ্রান্সের নেতৃত্বে একটি ‘বৃহত্তর পরিবার’ গঠন করবে।

মানচিত্রে ক্যামেরুনের পশ্চিমাঞ্চলে ইংরেজি ভাষাভাষী অ্যাংলোফোন অঞ্চল; image source: The Washington Post

একইভাবে, একসময়কার ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা ক্যামেরুনের পশ্চিমাঞ্চলে ইংরেজি ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত রাষ্ট্রগুলো ‘অ্যাংলোফোন বিশ্ব’ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্বের সঙ্গে অ্যাংলোফোন বিশ্বের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে এবং বিশেষত আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন সংঘাতের অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে অনেক সময় এই দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয় উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

বিভিন্ন সময়ে ক্যামেরুনে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সহিংসতার পেছনে এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্যামেরুন গঠিত হওয়ার পর থেকেই দেশটির কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ফরাসি ভাষাভাষীদের আধিপত্য বজায় ছিল। এমনকি, ফরাসি ভাষাভাষী শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে ১৯৭২ সালে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র’-এর পরিবর্তে দেশটির নাম ‘সংযুক্ত ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র’ করা হয়। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থার নিদর্শন দুই তারকা সম্বলিত ক্যামেরুনের জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করে একটি তারকা সম্বলিত জাতীয় পতাকা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৮৪ সালে সংযুক্ত ক্যামেরুনের পরিবর্তে দেশটির নাম পুনরায় ‘ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র’ করা হয়, যেখানে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসরত ইংরেজি ভাষাভাষীদের আলাদা রাজ্যের অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালের ৬ই নভেম্বর ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা পল বিয়া একটানা ৩৯ বছর ধরে দেশটির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন। পল বিয়া ক্যামেরুনের ফরাসি ভাষাভাষী ফ্রাঙ্কোফোন জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

অ্যাংলোফোন অঞ্চলে টহলরত ক্যামেরুন এর সামরিক বাহিনীর সদস্যরা; image source: BBC

ক্যামেরুনের ইংরেজি ভাষাভাষী অ্যাংলোফোন জনগোষ্ঠী ফ্রাঙ্কোফোন প্রভাবিত সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের উপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ তুলেছেন। তারা ১৯৬১ সালে এপ্রিলে পাস হওয়া জাতিসংঘের রেজ্যুলেশন অনুযায়ী অধীনে সমমর্যাদাসম্পন্ন দুটো স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছেন। অ্যাংলোফোন অঞ্চলে ফরাসি ভাষাভাষী বিচারক নিয়োগের প্রতিবাদে ২০১৬ সালের অক্টোবরে অঞ্চলটির আইনজীবীরা ধর্মঘট পালন শুরু করেন। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনের সময় অঞ্চলটির বুয়া, বামেন্দাসহ কয়েকটি শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আইনজীবীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছিল। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফরাসি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া এবং ফরাসি ভাষাভাষী শিক্ষক নিয়োগের বিরুদ্ধে অঞ্চলটির শিক্ষকেরা বিক্ষোভ করেন।

ক্যামেরুন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অ্যামবাজোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে; image source: GeoCurrents

ইতোমধ্যে, দেশটির সরকার ধর্মঘটে যোগ দেওয়া অ্যাংলোফোন অঞ্চলের কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এছাড়াও, ক্যামেরুন সরকার অ্যাংলোফোন অঞ্চলে সংঘবদ্ধ আন্দোলন প্রতিহত করতে, বিভিন্ন সময় ইন্টারনেট সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছে। ২০১৭ সালের পহেলা অক্টোবর অ্যাংলোফোন অঞ্চলের ইংরেজি ভাষাভাষী স্বাধীনতাকামীরা ক্যামেরুন থেকে বিছিন্ন হয়ে ‘অ্যামবাজোনিয়া’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অ্যামবাজোনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। এরপর থেকে অঞ্চলটিতে স্বাধীনতাকামীদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এসব সংঘর্ষে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে, আফ্রিকান ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ দু’পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে অ্যাংলোফোন সংকটের সমাধানের উপর গুরুত্বারোপ করেছে।

Related Articles